ক্রীড়া ডেস্ক
ডিসেম্বর ১৯, ২০২২, ০৭:০২ পিএম
ক্রীড়া ডেস্ক
ডিসেম্বর ১৯, ২০২২, ০৭:০২ পিএম
অবশেষে আর্জেন্টাইন ফুটবলার লিওনেল মেসির অধরা স্বপ্ন পূরণ হলো। রবিবার (১৮ ডিসেম্বর) কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে হাজার হাজার দর্শকের সামনে বিশ্বকাপ নামক স্বর্ণগোলক তুলে ধরলেন ক্ষুদে জাদুকর, অবসান ঘটলো `সর্বকালের সেরা`র বিতর্কের। আকাশি-সাদা জার্সিতে লিওনেল মেসির নিজেকে প্রমাণের শেষ সুযোগ ছিল গতকাল; কারণ ফাইনালের আগেই মেসি জানিয়ে রেখেছিলেন যে এটাই হবে তার ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ। আর শেষ বেলায় সমর্থকদের হতাশ করেননি সাবেক বার্সা কিংবদন্তি। বিশ্বকাপ, গোল্ডেন বল এবং গোল্ডেন গ্লাভস সবগুলোই গিয়েছে আর্জেন্টিনার ঘরে। আলবিসেলেস্তেদের ৩৬ বছরের শিরোপা খরা ঘুচিয়ে তাদেরকে নতুন জীবন দেওয়ার অন্যতম কাণ্ডারি হয়েছেন লিওনেল মেসি।
আর সে কারণেই রবিবার কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে মেসিকে রাজকীয়ভাবেই বরণ করে নিয়েছেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি। যে রাজকীয়তা মেসি পেতে পারতেন ২০১৪ সালে, তা গতকাল পেয়েছেন তিনি; আর সারা বিশ্ব সাক্ষী হয়েছে সেই বিরল মুহূর্তের।
লুসাইল স্টেডিয়ামে সাজানো মঞ্চে মেসির হাতে বিশ্বকাপ তুলে দিতে প্রস্তুত ছিলেন কাতারের আমির। কিন্তু বিশ্বকাপ হাতে তুলে দেওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে তিনি মেসিকে পরিয়ে দেন ‘বিশত’ নামক কালো-সোনালি এক ধরনের আলখাল্লা যার সঙ্গে মিশে আছে হাজার বছরের আরব ঐতিহ্য। ৩৫ বছর বয়সী মেসির জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিনটিতে ফুটবলের সঙ্গে আরব সংস্কৃতি এবং মেসিই যে সর্বকালের সেরা- সেটি স্বীকার করে নেওয়ার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটলো এই আলখাল্লা পরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে।
কিন্তু কাতারের আমিরের পরিয়ে দেওয়া এই কালো-সোনালি আলখাল্লার মাহাত্ম্য আসলে কী? এ প্রসঙ্গে কাতারের টুর্নামেন্ট আয়োজক কমিটির সেক্রেটারি জেনারেল হাসান আল থাওয়াদি বিবিসি স্পোর্টকে বলেন, “এটা এমন একটা পোশাক যা অফিসিয়াল কোনো উৎসবে এবং উদযাপনের জন্য পরা হয়। আর আজকের দিনটা ছিল মেসির উদযাপনের দিন।”
তিনি আরও যোগ করেন, “এবারের বিশ্বকাপের মাধ্যমে আরব ও মুসলিম সংস্কৃতিকে পুরো বিশ্বের সামনে তুলে ধরার সুযোগ মিলেছে। এটা শুধু কাতারের নয়, এটা একটা আঞ্চলিক উদযাপনের উপলক্ষ্য ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ বিশ্বকাপ দেখতে কাতারে এসেছেন, অনেক অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছেন, তারা বুঝতে পেরেছেন যে আমরা সবাই হয়তো সব বিষয়ে একমত নাও হতে পারি কিন্তু তবুও একসঙ্গে উদযাপন তো করতে পারি।”
সতীর্থদের সঙ্গে বিশ্বকাপ জয় উদযাপন করছেন মেসি।
এদিকে শেখ তামিম টুইটারে লিখেছেন, “আমরা আরব দেশগুলোর পক্ষ থেকে একটা অসাধারণ বিশ্বকাপ আয়োজন করার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পেরেছি। এর ফলে সারা বিশ্বের মানুষ আমাদের সংস্কৃতির সমৃদ্ধতা ও আমাদের মূল্যবোধের উৎস সম্পর্কে জানার সুযোগ পেয়েছে।”
মেসির গায়ে ‘বিশত’ পরিয়ে দেওয়ার বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করে বিবিসির ধারাভাষ্যকার গাই মওব্রে বলেন, “আজকের রাতটা বুয়েনোস আইরিস এবং এর বাইরের সব আর্জেন্টিনা সমর্থকদের। এটা এমন একটা রাত যেদিন ফুটবলের সত্যিকার রাজার রাজ্যাভিষেক ঘটেছে।”
তবে মেসি যে কাতারের আমিরের এই উপহার পেয়ে খানিকটা অবাক হয়েছিলেন তা স্পষ্ট, তবে হাসিমুখেই তিনি দুই হাত বাড়িয়ে সেটা পরেছেন এবং আলখাল্লা গায়ে দিয়েই বিশ্বকাপ হাতে সতীর্থদের সঙ্গে উদযাপনের জন্য এগিয়ে গিয়েছেন।
মেসিকে সম্মানসূচক কালো-সোনালি আলখাল্লা পরিয়ে দেওয়ায় আরব অঞ্চলের সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটিজেনরা প্রশংসা করলেও, এটি নিয়ে সমালোচনায় মেতেছেন পশ্চিমা অনেক ফুটবল বোদ্ধা। দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাবেক ইংলিশ ফুটবলার গ্যারি লিনেকার জাতীয় দলে মেসির সাবেক সতীর্থ পাবলো জাবালেতাকে প্রশ্ন করেছেন, “তুমি কি মনে করো পাবলো? মেসির আর্জেন্টিনা জার্সিকে এভাবে ঢেকে দেওয়াটা কী লজ্জাজনক নয়?” উত্তরে জাবালেতা বলেন, “কিন্তু কেন? এই কাজটা না করলে কি হতো না?”
একই ধরনের আরও মন্তব্য টুইটারে দেখা গেছে। জনৈক সাংবাদিক লিখেছেন, “বিশ্বাস করতে পারছি না যে শেষ পর্যন্ত মেসি বিশ্বকাপ জিতলো এবং তাকে একটা আলখাল্লা গায়ে দিয়ে বিশ্বকাপ তুলে ধরতে হলো। এটা কখনোই সম্ভব না! এটা নিয়ে আমি খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছি না, তবে নিয়ম তো এটাই যে খেলোয়াড়রা তাদের দেশের জার্সি গায়েই ট্রফি তুলে ধরবে। কিন্তু এখন সেই মজাটা নষ্ট হয়ে গেল। আমি জানিনা এই আলখাল্লার সাংস্কৃতিক মাহাত্ম্য কী, তবে যা এতকাল চলে এসেছে সেটাই তো নিয়ম।”
কালো-সোনালি `বিশত` এর মাহাত্ম্য কী তা তো আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ এই ঘটনাকে কাতারের `স্পোর্টসওয়াশিং` হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এ ঘটনার মাধ্যমে ফুটবলের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসির বিশ্বকাপ জয় ও তার ইমেজের সাথে কাতারের নাম জড়িয়ে থাকবে।
আবার একই সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় কাতারি আমিরের এ উদ্যোগকে অনেকেই স্বাভাবিকভাবেই দেখছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে সংবাদমাধ্যম আরটির এক প্রতিবেদনে। সমালোচনার কড়া জবাব দিয়ে জনৈক তুর্কি টুইটার ব্যবহারকারী লিখেছেন, “সাংস্কৃতিক দিক থেকে চিন্তা করলে, কাউকে `বিশত` পরিয়ে দেওয়াকে কাতারে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন বোঝায়। কাতারের আমির এভাবেই মেসিকে সম্মান দেখাতে চেয়েছেন। অজ্ঞ পশ্চিমা মিডিয়ার উচিত বরাবরের মতো ঘ্যানঘ্যান না করে একটি দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা।”
১৯৭০ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে ব্রাজিল জয়লাভ করার পর কিংবদন্তি ফুটবলার পেলের মাথায় সমব্রেরো (মেক্সিকোর ঐতিহ্যবাহী হ্যাট) পরা ছবি পোস্ট করে আরেকজন লিখেছেন, “তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ের পর পেলে সমব্রেরো পরেছেন এবং জয় উদযাপন করছেন। তাহলে আপনাদের সমস্যাটা কী?”
ওয়াশিংটনভিত্তিক এনবিসির আরব বংশোদ্ভূত এক সাংবাদিক লিখেছেন, "হতে পারে মেসির গায়ে আলখাল্লা পরিয়ে দেওয়া একটু দৃষ্টিকটূ লেগেছে, কিন্তু এই আরব-বিরোধী, বর্ণবাদী আচরণ কী এবার থামানো যায় দয়া করে?" সেই সাথে তিনিও পেলের মেক্সিকান হ্যাট পরার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছেন।
তিনি আরও লিখেছেন, “মেসি যদি বিতর্কিত `ওয়ান লাভ রেইনবো` প্রোপাগান্ডার আর্মব্যান্ড পরতেন, তাহলে লিনেকার ও বাকিরা তাকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিতেন। কিন্তু আরব `বিশত` পরায় এখন তা নেতিবাচক সম্প্রচার পাচ্ছে। বিশ্বকাপ নিয়ে বিবিসির এসব কর্মকান্ড খুবই ঘৃণ্য ও কুৎসিত।”
এসএম