জুন ২৫, ২০২২, ১২:৫০ পিএম
শরীয়তপুর সরকারি কলেজের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী সাইফুল। জেলার আঙ্গারিয়া এলাকায় বাবা-মা আর দুই ভাইবোনের ছোট্ট পরিবার। গত নভেম্বরে মায়ের আকস্মিক মৃত্যুতে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। সুখের সংসারে আজ করুণ সুর। কী হয়েছিল মায়ের জানতে চাইলে মুঠোফোনের ওপাশ থেকে সাইফুল ফুপিয়ে কেঁদে বলেন, শীতের রাতে সেদিন স্ট্রোক করেছিলেন মা।
জেলা সদর হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক দ্রুত ঢাকায় রেফার্ড করেন। অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে বাংলাবাজার ঘাটে পৌঁছালেও ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ মা আমাদের এতিম করে চলে যান।
আজ পদ্মা সেতু চালু হচ্ছে অসুস্থ বাবা-মা নিয়ে কত সন্তান নিমিষেই ভালো হাসপাতালে যেতে পারবে। কিন্তু আমি সেদিন ফেরির জন্য মায়ের লাশ নিয়ে ফিরেছি! ২০১৯ সালের ঘটনা নিশ্চয় সবার জানা। রাষ্ট্রের একজন আমলার জন্য তিন ঘণ্টা ঘাটে ফেরি অপেক্ষমাণ রাখা হয়। এসময় অ্যাম্বুলেন্সে থাকা নড়াইল কালিয়া পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তিতাস নামে এক স্কুলছাত্রের মৃত্যু হয়। দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার প্রায় প্রতিটি পরিবারে রয়েছে এমন বিষাদের স্মৃতি।
দক্ষিণাঞ্চলে এখনো বড় কোনো টারশিয়ারি হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি। ফলে ২১ জেলার কোটি মানুষের ভরসা শুধুই রাজধানী। সেখানে এতদিন বিপত্তি ছিল প্রমত্তা পদ্মা। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের নদী পারাপারে কেটে গেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এতে উন্নত চিকিৎসা তো দূরে থাক নদীর পাড়ে ফেরির জন্য অপেক্ষায় থেকে, মাঝ নদীতে কিংবা ঢাকায় আসার আগেই রোগীর মৃত্যু হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে পদ্মা পাড়ে স্বজন হারানোর কত আর্তচিৎকারে আকাশ ভারী হয়েছে তার হিসাব নেই। আবার সময়ও অর্থের কথা চিন্তা করে রোগ নিয়েই বসবাস মফস্বলের অনেকের। যাতায়াত ব্যবস্থার অচলাবস্থার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলে তেমন একটা চেম্বার করেন না।
এতে রোগ পুষে রাখা মানুষের সংখ্যাও বছর বছর বেড়েছে। এখন সব সমস্যার সামাধানে রাজধানীর সাথে দক্ষিণাঞ্চলের মেলবন্ধন ঘটিয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। দক্ষিণাঞ্চলে কেউ অসুস্থ হলে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। সাধ্যমতো উন্নত চিকিৎসার জন্য নিমিষেই পৌঁছে যাবে রাজধানীতে। নাড়ির টানে ২১ জেলার অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাসেবায় ব্রত হতে ছুটবেন নিজ নিজ এলাকায়। ফলে বাড়ির পাশে কম খরচে খ্যাতিমান চিকিৎসকের পরামর্শ পাবে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ।
পদ্মা সেতুর স্বাগতিক উপজেলা জাজিরার কৃতী সন্তান এবং জাজিরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্তকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মাহমুদুল হাসান বলেন, আমাদের উন্নত চিকিৎসা অনেকটা রাজধানীকেন্দ্রিক। জটিল রোগীদের আমরা যথাযথ চিকিৎসার জন্য রাজধানীতে রেফার্ড করে থাকি। পদ্মা নাদী পারাপারের জটিলতায় অনেকে পদ্মার পাড়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতেন। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সেই সমস্যা কেটে যাবে। জটিল রোগীদের আমরা যখন তখন উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় রেফার্ড করতে পারব। তারাও দ্রুত সময়ের মধ্যে রাজধানীতে পৌঁছাতে পারবেন।
তিনি বলেন, আরেকটি দ্বারও উন্মুক্ত হবে। যাতায়াত ব্যবস্থার বেহাল দশার কারণে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা পদ্মার এপাড়ে কম চেম্বার করতেন। এখন সেই সমস্যাটি মিটে গেল। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মুহূর্তের মধ্যে ঢাকা থেকে শরীয়তপুরে আসতে পারবেন। এই পাড়ের বেসরকারি হাসপাতালে চেম্বার করবেন। রোগীরা বাড়ির কাছে দেশের শীর্ষ স্থানীয় চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে পারবেন। শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার আরেক কৃতী সন্তান ডা. হেলাল উদ্দিন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) সহকারী প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ডা. হেলাল উদ্দিন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গতকাল (শুক্রবার) শরীয়তপুরের উদ্দেশে যাত্রাপথে ফেরিতে অবস্থানকালে এই প্রতিবেদককে মুঠোফোনে বলেন, এই মুহূর্তে আমি ফেরিতে পদ্মা নদী পার হচ্ছি। এবারই সম্ভবত আমাদের শেষবারের মতো ফেরিতে পদ্মা পাড়ি দেয়া। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর আমরা রাজধানীর সাথে দ্রুততম সময়ে যুক্ত হবো। আপনি হয়তো জানেন, দক্ষিণবঙ্গে টারশিয়ারি মানের বড় কোনো হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি। স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, নিউরো, সার্জারি ও গাইনোকলজিক্যাল জটিল রোগের চিকিৎসা দক্ষিণবঙ্গে নেই। এই অঞ্চলের মানুষের একমাত্র ভরসা রাজধানীর টারশিয়ারি হাসপাতাল। এ জন্য আশা নিয়ে রোগীর স্বজনরা ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলেও বিপত্তি বাধে পদ্মা পাড়ে। ঘণ্টার পার ঘণ্টা অপেক্ষার পরও নাদী পার হতে না পেরে অনেক জটিল রোগীর স্বজনকে অশ্রুসজল নয়নে লাশ নিয়ে ফিরতে হয়েছে বাড়ি। রাতে ফেরি পাওয়া অনেক সময় সোনার হরিণ। নাব্য সংকট, স্রোতের কারণে বিভিন্ন সময় চলত না ফেরি। আবার শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন দিনে কিংবা নৌ-সতর্কতা সংকেত জারি হলেও বন্ধ থাকত ফেরি চলাচল।
এসব প্রতিবন্ধকতার কারণে উপযুক্ত চিকিৎসা না পেয়ে অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি পরিবারে এমন অন্তত একটি বিষাদের স্মৃতি আছে। আমার বিশ্বাস পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে মেলবন্ধন হিসেবে কাজ করবে।
গোপালগঞ্জের কৃতী সন্তান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে গতকাল এক শুভেচ্ছা বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, দক্ষিণবঙ্গের গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানির সন্তান হিসেব এমন অনেক নির্মম ঘটনার সাক্ষী। বোধসম্পন্ন মানুষের কাছে এসব ঘটনা অনেক কষ্টের। কত শত রোগী কাওড়াকান্দি, কাঁঠালবাড়ি ঘাটে বিনা চিকিৎসায় অ্যাম্বুলেন্সে মারা গেছে তার হিসাব কারো কাছে নেই। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার ফলে এসব ঘটনার থেকে জাতি মুক্তি পাবে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হলে স্বাস্থ্য খাতে নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচিত হবে। রোগীরা এখন বিনা বাধায় পদ্মা পার হয়ে রাজধানীতে চিকিৎসাসেবা নিয়ে জীবন রক্ষা করতে পারবে। নদী পার হতে যাওয়া নৌযানের যাত্রীরাও রক্ষা পাবে সর্বনাশা পদ্মা থেকে। এই পদ্মা নদীতে আর কারো সলিল সমাধি হবে না।’
তিনি বলেন, একজন স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে আমি এ স্বপ্ন জয়ের পদ্মা সেতুকে অর্থনৈতিক বড় প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের স্বাস্থ্য খাতের জন্য আরেকটি মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করতে চাই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও আগে যেখানে মুমূর্ষু রোগীকে পদ্মা নদী পারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। অনেক রোগী কাওড়াকান্দি, কাঁঠালবাড়ি ও মাঝিকান্দি নৌ-ঘাটে ফেরি পারাপার না হতে পেরেই বিনা চিকিৎসায় মারা যেত।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে এই পদ্মা সেতু কতখানি অবদান রাখবে সেটি এসব ভুক্তভোগী পরিবার ছাড়াও ২১ জেলার মানুষ ভালো করেই জানে। মানোন্নয়ন হবে এ ২১ জেলার স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর। এই ২১ জেলায় জন্ম নেয়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আগে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও চাইলেই পদ্মা নদী পার হয়ে এলাকার রোগীদের গ্রামে বসে সেবা দিতে পারতেন না। এখন পদ্মা সেতুর কারণে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় সহজে নিজ নিজ গ্রামে যেতে পারবেন। মানুষকে সেবা দিতে পারবেন। প্রয়োজনে গ্রামের রোগীদের ঢাকায় রেফার্ড করতে পারবেন।