Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪,

ফেরি যুগের অবসান

বরিশাল প্রতিনিধি

বরিশাল প্রতিনিধি

জুন ২৫, ২০২২, ১২:৫৫ পিএম


ফেরি যুগের অবসান

ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে বরিশালের দূরত্ব ১৫৬ কিলোমিটার আর সাগরকন্যা কুয়াকাটা বা দক্ষিণাঞ্চলের শেষ স্থলভাগের দূরত্ব মাত্র ২৭৬ কিলোমিটার। এতদিন এই ২৭৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে ১৪টি ফেরি পার হয়ে অনেক কষ্টে, দীর্ঘ সময় ব্যয় করে ঢাকায় পৌঁছাতে হতো। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ধীরে ধীরে নদীগুলোর ওপর সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে এ ফেরির সংখ্যা কমতে থাকে। কিন্তু প্রমত্তা পদ্মায় সেতু নির্মাণের কথা স্বপ্নেও ভাবেনি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। 

যদিও আগামীকাল ২৫ জুন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে সেই প্রমত্তা পদ্মার ওপর স্বপ্নের সেতু। যে সেতুতে যান চলাচলের মধ্য দিয়ে ঢাকা-বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা, ঢাকা-বরিশাল-ঝালকাঠি-পিরোজপুর-বাগেরহাট, ঢাকা-বরিশাল-বরগুনা রুটে ফেরি যুগের অবসান ঘটবে। লাঘব হবে ফেরিতে পারাপার হয়ে রাজধানীতে আসা-যাওয়ার সীমাহীন দুর্ভোগ।

সেই সঙ্গে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় এ অঞ্চল দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাবে, রচিত হবে নতুন অধ্যায়। তাই স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে বেশ উচ্ছ্বসিত বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। পরিবহন চালক-শ্রমিকদের দেয়া তথ্য মতে, ১৯৮৯ সালে বুড়িগঙ্গা সেতু উদ্বোধন হয়। 

এরপর থেকে সায়েদাবাদ থেকে বরিশাল-পটুয়াখালী রুটে যাত্রীবাহী বাস চলাচল বাড়তে থাকে। তবে নব্বইয়ের দশকে কুয়াকাটা থেকে ঢাকার সায়েদাবাদে পৌঁছাতে ১৪টি নদীর ওপর থাকা ফেরি পার হতে হতো। সনাতনী ফেরি ব্যবস্থায় এসব নদী পাড়াপাড়ে দুর্ভোগের কমতি ছিল না। যার মধ্যে অনেক ফেরি তো কাঠেরও ছিল। 

সড়ক ও জনপথ দপ্তরের হিসাব বলছে, নব্বইয়ের দশকে চারটিসহ গত দুই দশকে ১০টি সেতু নির্মিত হয়েছে এই পথে। যদিও ১৯৯৮ সালে বরিশালের দোয়ারিকা-শিকারপুরে নদীর ওপর ব্রিজের নির্মাণকাজ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক ব্যবস্থায় হঠাৎ আমূল পরিবর্তনের ধারা আনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। 

আর এই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকারের টানা মেয়াদকালে পটুয়াখালীতে বৃহৎ চারটি, বরিশালে বৃহৎ দুটি, মাদারীপুরে বৃহৎ একটি এবং সর্বশেষ পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে ঢাকা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত মহাসড়কে ফেরি যুগের অবসান ঘটানো হয়েছে। 

৩০ বছর ধরে দক্ষিণাঞ্চলের পরিবহন সেক্টরের সাথে জড়িত ও বিএমএফ বাসের চালক মো. সিদ্দিক খান বলেন, এই তো সেদিনের কথা কুয়াকাটা থেকে ঢাকার সায়েদাবাদে যেতে ভয়ঙ্কর পদ্মাসহ ১৪টি নদীর ফেরি পার হতে হতো। আর সময়ও লাত এক থেকে দেড় দিন। আর পদ্মা সেতু চালু হলে সেই সড়কেই একটাও ফেরি পার হওয়ার প্রয়োজন হবে না, সেই সাথে ঢাকায় যেতেও লাগবে মাত্র কয়েক ঘণ্টা। তিনি বলেন, পদ্মার ওপর কোনোদিন সেতু হবে তাও তো কেউ কল্পনা করেনি। আর এখন সেতু তো হয়েছেই তার ওপর দিয়ে গাড়ি নিয়ে ঢাকায় যাবো, এটা কেমনে সম্ভব হইল তাই তো ভাবতে পারছি না। 

৩৬ বছর ধরে দক্ষিণাঞ্চলের পরিবহন সেক্টরের সাথে জড়িত বাসচালক মিলন চন্দ্র দাস বলেন, ১৪ ফেরির আমলের দুর্ভোগের কথা মানুষ বহু আগেই ভুইলা গ্যাছে। তয়, পদ্মা পাড়ি দিতে গিয়া কষ্ট আর ভয়ের কথা এহনও মানষের মোনে আছে। কারণ এইডা একটা চ্যালেঞ্জ আর আতঙ্ক ছিল মানষের মনের মধ্যে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে সেই সীমাহীন ভোগান্তি আর ঢাকা থেকে বরিশাল হইয়া দক্ষিণাঞ্চলের শেষ সীমানা সাগরকন্যা কুয়াকাটা পর্যন্ত ফেরি যুগের অবসান ঘটল।’

তিনি বলেন, ঢাকার সাথে সরাসরি সড়কপথে শুধু বরিশাল হয়ে কুয়াকাটার নয়, ফেরিবিহীন যোগাযোগ স্থাপন হচ্ছে এ বিভাগের পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠিসহ পাঁচ জেলার সাথে। সেই সাথে পিরোজপুর হয়ে বাগেরহাটও যাওয়া যাবে ভোগান্তিহীন ফেরিবিহীন পথে। 

আল আমিন নামে এক অ্যাম্বুলেন্সচলক বলেন, এই তো গত ডিসেম্বরে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে যে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সেখান থেকে আগুনে পুড়ে যাওয়া মা ও তার দুই সন্তানকে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতাল থেকে ঢাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ফেরিঘাটে অপেক্ষায় থাকতে থাকতে তিন জনের মধ্যে মেয়ে মাহিনুরের মৃত্যু হয়। আর কোনোভাবে তার মা জেসমিন ও ভাই তামিমকে ঢাকায় হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। 

তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে এখন আর কাউকে ফেরির জন্য দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকতে হবে না। হয়তো সময়ের জন্য সু-চিকিৎসার অভাবে কারও জীবনও যাবে না।  বলতে পারেন— পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলবাসীর জন্য আশীর্বাদ। ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে ঢাকা-বরিশাল-কুয়াকাটা সড়ক পথে সেই ফেরি যুগের পরিসমাপ্তি ঘটতে চলেছে এইডা আমাদের সবার কাছে আনন্দের।’ 

এদিকে সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পবিপ্লব ঘটার পাশাপাশি এখানকার মেগা প্রকল্পগুলো জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন দ্য বরিশাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাবে। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখনই সরকার প্রধান থাকেন, তখনই পিছিয়ে যাওয়া মানুষের কথা ভাবেন। আর গত এক যুগে এই অঞ্চলের মানুষকে চাওয়ার থেকে অনেক বেশি দিয়েছেন। তার প্রতি আমরা চিরকৃতজ্ঞ।
 

Link copied!