Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪,

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সিসিটিভি অপারেটর নিয়োগে দুর্নীতি

সেই দুই কর্মকর্তা কি বরখাস্ত হচ্ছেন

রেদওয়ানুল হক

জুন ২৬, ২০২২, ০১:২৩ এএম


সেই দুই কর্মকর্তা কি বরখাস্ত হচ্ছেন

বাংলাদেশ ব্যাংকের সিসিটিভি অপারেটর নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া দুই কর্মকর্তার শাস্তি মওকুফের আপিল আবেদন খারিজ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদ সভা। 

গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ৪২২তম পর্ষদ সভায় অভিযুক্ত দুই যুগ্ম পরিচালক মো. আলমাছ আলী ও আবদুল্লাহ আল মাবুদের আপিল আবেদন নাকচ করে দেয়া হয়েছে। এর ফলে তাদের স্থায়ী বহিষ্কার কার্যক্রম এগিয়ে গেল। 

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ প্রমাণিত এবং হাতেনাতে ধরা পরার পরও দোষীদের শাস্তি দিতে দেরি করা হচ্ছে। অন্যদিকে ব্যাংক প্রশাসন বলছে, নিয়ম মেনে ধীরে সুস্থে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। যাতে অভিযুক্তরা পাল্টা অভিযোগ করতে না পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সিসিটিভি অপারেটর পদের ২৬টি ও সিসিটিভি টেকনিশিয়ান পদের তিনটি শূন্যপদের জন্য ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ২০২০ সালের ২৭ মার্চ ওই পদের জন্য লিখিত পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা হয়, তবে করোনার কারণে পরীক্ষা স্থগিত হয়। এরপর গত বছরের ১৬ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংক স্কুল 
অ্যান্ড কলেজে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সিসিটিভি অপারেটর পদে ৭০০ পরীক্ষার্থীর মধ্যে অংশ নেন ১৪২ জন। উত্তীর্ণ হন ৩৪ জন। 

এছাড়াও সিসিটিভি টেকনিশিয়ান পদে ৫৭৭ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে উত্তীর্ণ হন ১৯ জন। উত্তীর্ণদের মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হয় গত বছরের ৬ জানুয়ারি। মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেয়া প্রার্থীদের তথ্য যাচাইকালে আবুবকর সিদ্দিক নামে একজন পরীক্ষার্থীর হাতে লেখার গরমিল ধরা পড়ে। 

অর্থাৎ লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্র ও নিজের হাতের লেখার মধ্যে মিল পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে আবুবকর সিদ্দিক স্বীকার করেন, তার পক্ষে অন্য কেউ পরীক্ষা দিয়েছেন। এরপর ১৩ জানুয়ারি বিশেষ তদন্তের নির্দেশ দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে, আবুবকর সিদ্দিকের পরিবর্তে নেত্তানন্দ পাল নামে একজন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। পরীক্ষায় এমন অনিয়মের পরিকল্পনা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাবুদ। আর আবুবকর সিদ্দিক ও আবদুল্লাহ আল মাবুদের সাথে নেত্তানন্দ পালের যোগাযোগ করিয়ে দেন অপর যুগ্ম পরিচালক মো. আলমাছ আলী। এ জন্য আলমাছ আলীর হিসাবে দুই লাখ টাকা জমা দেন আবুবকর সিদ্দিক। 

আলমাছ আলী তদন্ত কর্মকর্তাদের জানান, সেই দুই লাখ টাকা লিখিত পরীক্ষায় অংশ দেয়া নেত্তানন্দ পালকে দেয়া হয়েছে। আর আবদুল্লাহ আল মাবুদ মৌখিক পরীক্ষার দিন আবুবকর সিদ্দিকের জন্য একাধিক কর্মকর্তার কাছে সুপারিশ করেন। অন্যদিকে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত একটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় তিনটি ব্যাংকের পাঁচ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার এবং একই সঙ্গে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের একজনের সাথে আলমাস আলীর যোগাযোগ থাকার তথ্য পাওয়া যায়। নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের বিষয়ে ঢাকার বাড্ডা থানায় একটি মামলা হয়েছে। মামলার এজাহারে ২২ নম্বর আসামি হিসেবে আলমাছ আলীর নাম রয়েছে।

নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়মের সত্যতা পাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাবুদ ও মো. আলমাছ আলীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১৩ জুন দুই যুগ্ম পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাবুদ ও মো. আলমাছ আলীকে সাময়িক বরখাস্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর গত একবছরেও দুই কর্মকর্তার স্থায়ী বরখাস্তের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি ব্যাংক প্রশাসন। 

তবে দীর্ঘ সময় পর হলেও অভিযুক্তদের করা শাস্তি মওকুফের আপিল নিষ্পত্তি হয়েছে। এখন তাদের স্থায়ী বহিষ্কারের কার্যক্রম দ্রুত নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, মূলত ওই দুই কর্মকর্তার সাথে নিয়োগ সংক্রান্ত প্রভাবশালী মহলের যোগাযোগ আছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। নয়তো শুধু আপিল নিষ্পত্তিতে এক বছর লেগে যাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। 

তিনি বলেন, এসব ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যেমন দুর্নাম হচ্ছে, একই সঙ্গে এখানে কর্মরত সবাইকে বিব্রত হতে হয়। তাই প্রসাশনের উচিত ছিল দুর্নীতিবাজদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে নজির স্থাপন করা। যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এ ধরনের কাজের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মান ক্ষুণ্ন করার দুঃসাহস না করে। 

দোষী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সময়ক্ষেপণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও মানবসম্পদ বিভাগের নির্বাহী পরিচালক  সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘যখন কাউকে সাসপেন্ড করা হয় তখন একটি কমিটি করা হয়, এরপর আবার ফায়ার কমিটি করা হয় এবং তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়; এর একটি প্রসিডিউর আছে। তাড়াহুড়া করলে তারা কোর্টে যেতে পারে।’

এদিকে গত বছরের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক এক বিজ্ঞপ্তিতে (নং- ৫২/২০২১) নিয়োগ প্রক্রিয়াটি বাতিল করে পুনরায় দরখাস্ত আহ্বান করে। এতে আগের সিসিটিভি অপারেটর পদে ৭০০ জন ও সিসিটিভি টেকনিশিয়ান পদে ৫৭৭ জনকে নতুন করে আবেদন ছাড়াই পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়। তবে এ সার্কুলারের ফলে নিয়োগের জন্য অপেক্ষমান কৃতকার্য শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হয়েছেন এবং এতে আইন লঙ্ঘন হয়েছে বলে মনে করেন চাকরিপ্রার্থীরা। 

তাই সংক্ষুব্ধ হয়ে গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর একজন পরীক্ষার্থীর পক্ষে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন আইনজীবী সালাউদ্দিন দোলন। রিটের প্রেক্ষিতে পরদিন ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগ সংক্রান্ত ৫২নং সার্কুলারটি ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে আগে কৃতকার্যদের কেন নিয়োগ দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুলনিশি জারি করেন বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খন্দকার দিলীরুজ্জামানের আদালত। এরপর থেকে বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন আছে।

প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের চাকরির নিয়োগে জালিয়াতির পাশাপাশি এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষাতেও জালিয়াতির ঘটনা বেরিয়ে আসছে। সিসিটিভির অপারেটর নিয়োগে দুর্নীতির ঘটনায় জালিয়াতচক্র হাতেনাতে ধরা পড়লেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্য পদের নিয়োগেও বিভিন্নভাবে জালিয়াতি হয়েছে। এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা আছে। 

তবে কোনো তদন্ত না হওয়ায় জড়িত ব্যক্তিরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছেন। ব্যাংকের সাধারণ অফিসার নিয়োগেও অস্বাভাবিক ফল প্রকাশের অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ফল প্রকাশের পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল ফটকের সামনে মানববন্ধন করেন চাকরিপ্রার্থীরা। এসময় তারা প্রকাশিত ফলাফলকে অস্বাভাবিক দাবি করে তা পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানান। মানববন্ধন শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বরাবর লিখিত আবেদন করেন তারা। 

পরীক্ষার্থী তানজিদ হোসেন, পার্থ সরকার ও খায়রুল আমীন স্বাক্ষরিত ওই আবেদনে তারা বলেন, ‘যারা কৃতকার্য হয়েছে তাদের চেয়ে বেশি নম্বর পেয়েও আমরা উত্তীর্ণ হতে পারিনি। তাই আমরা ফলাফল নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছি।’ এ কারণে ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানানো হয়।

Link copied!