জুন ২৭, ২০২২, ০১:১৮ এএম
গত শনিবার উদ্বোধনের পর গতকাল রোববার ভোর ৬টা থেকে কার্যত যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয় পদ্মা সেতু। দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রের বিপরীতে নির্মাণ করার কারণে ব্যাপকভাবে আলোচিত এই সেতু জাতির আবেগ, সক্ষমতার প্রতীক ও বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবিও। গোটা দেশেরই নজর এখন এই সেতুতে।
এরই মধ্যে চলাচলের অনুমতি পেয়েই অতিউৎসাহীদের সেতু ব্যবহারে অনিয়ম, মালামাল চুরি, দর্শনার্থীদের সেতু পারাপারের নামে রমরমা বাণিজ্যের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল গোটা সেতুতে নানা অনিয়মের মধ্যে একাধিক অনিয়মের দৃশ্য ভাইরাল হয় ফেসবুকে।
এতে দেখা যায়, কেউ সেতুতে প্রস্রাব করছেন, কেউ খুলে নিচ্ছে রেলিংয়ের স্ক্রু, কেউ করছেন টিকটক, কেউ আবার নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ব্রিজের রেলিংয়ে ওঠে তুলছেন সেলফিও।
অথচ পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলছেন, সেতুর ওপরে যানবাহন থেকে নামাই নিষিদ্ধ। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই অতিউৎসাহীদের এতসব অনিয়ম ঠেকাতে সেতুর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং সাপোর্ট অ্যান্ড সেফটি টিমকে (ইএসএসটি) পাঠানো চিঠিতে সেতু কর্তৃপক্ষ উল্লেখ করেছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগের তথ্য।
চিঠিতে সেনাবাহিনীকে অবহিত করা হয়েছে, সেতুতে নেমে মূল্যবান মালামাল ও যন্ত্রপাতি চুরির ঘটনাও ঘটছে। অনেকে দুই দিকের টোলপ্লাজার আশপাশে যন্ত্রপাতি ও মালামালের ক্ষতি করছে। এ অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে ইএসএসটিকে টহল জোরদার করার অনুরোধ জানায় সেতু কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া দর্শনার্থীদের সেতু পারাপারের কথা বলে যাত্রী প্রতি দুই শতাধিক টাকা নিচ্ছে স্থানীয় যানাবাহন চালকরা। দর্শনার্থীরা বলেন, মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাস ও বাসের চালকরা এ কাজ করছেন।
সেতু বিভাগ সূত্র বলছে, সেতুর আশপাশে এখনো নানা নির্মাণসামগ্রী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। টোল প্লাজার কাছে চারপাশে বেড়া দেয়ার কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। ফলে বাইরে থেকেও অনেকে ঢোকার চেষ্টা করছে।
আর গাড়ি-মোটরসাইকেল থামিয়ে সেলফি তোলা, শুয়ে পড়ে ছবি তোলা, ঝুলে রেলিংয়ে ওঠার চেষ্টা করা— এসব দেখা যাচ্ছে। এতে একদিকে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে।
এছাড়া এসব ঘটনার একটিরও যাতে আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে জন্য আজ থেকে সেতুতে চলাচলরত অবস্থায় যানবাহন থেকে নামলেই জরিমানা বা শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে বলেও জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এদিকে পদ্মা সেতুতে এত সব অনিয়মের দৃশ্য মুহূর্তের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় সমালোচনা। দাবি উঠে অনিয়মকারীদের গ্রেপ্তারের।
এমন দাবি ওঠার কিছু সময়ের মধ্যেই গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর শান্তিনগর থেকে সেতুর রেলিংয়ের স্ক্রু খুলে নিয়ে টিকটক ভিডিও আপলোড করা যুবক বায়েজিদকে আটক করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইড। সিআইডির সাইবার ইন্টিলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, তাকে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকা থেকে আটক করা হয়েছে। এর আগে শনিবার পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা শেষেও বিপুলসংখ্যক মানুষ উঠে পড়ে মূল সেতুতে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পরে তাদের সরিয়ে দেন। গতকালও যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার পর দিনের বিভিন্ন সময়ে অতিউৎসাহীদের বিশৃঙ্খলা করতে দেখা গেছে।
এরই ফাঁকে আলোচিত স্ক্রু খুলে নেয়ার ভিডিওটি করেন বায়েজিদ। ৩৪ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা যায়, ওই যুবক সেতুর রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে দুটি বল্টুর নাট খুলছেন। খুলে ফেলা একটি নাট হাতে নিয়ে তিনি বলেন, ‘এই লুজ দেহি, লুজ নাট, আমি একটা ভিডিও করতেছি, দেহ। এই হলো পদ্মা সেতু আমাদের... পদ্মা সেতু। দেখো আমাদের হাজার হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতু। এই নাট খুইলা এহন আমার হাতে।’
এসময় পাশে থেকে আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘ভাইরাল কইরা ফালায়েন না’। ভিডিওটি বায়েজিদের টিকটক অ্যাকউন্টে আপলোড করার পর ফেসবুকেও সেটি ভাইরাল হয়। এ প্রতিবেদন লেখা সময় গতকাল রাতে আরও একটি ভিডিও ভাইরাল হতে দেখা যায়। ভিডিওতে দেখা যায়, আরেক যুবক রেলিংয়ের স্ক্রু ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন আর বলছেন তিনি রেঞ্চ ব্যবহার না করেই দেখছেন স্ক্রুগুলো কতটা লুজ।
এছাড়া সাধারণের জন্য খুলে দেয়ার পর সেতুতে দিনভর গণপরিবহন ছাড়া অন্য প্রায় সব গাড়িকেও সেতুতে থামাতে দেখা যায়। কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটাহাঁটির পাশাপাশি তুলেছেন ছবি। মাইক্রোবাস ভাড়া করে পরিবার নিয়ে পদ্মা সেতু দেখতে আসেন কেউ কেউ। গাড়ি দাঁড় করিয়ে প্রায় ১৫ মিনিট ধরে পরিবারের ১৪ সদস্যকে নিয়ে তারা ঘুরে দেখছেন সেতু, তুলছেন দলবদ্ধ ছবি।
আবার অনেক বয়স্ক নারীর আসছেন পদ্মা সেতু ঘুরে দেখতে। করছেন টিকটক ভিডিও। টিকটক বানাতে সেতুর রেলিংয়ের ওপর দাঁড়িয়েও ছবি তুলতে দেখা যায় বাইকারদের। সড়ক বিভাজকের ওপর দাঁড়িয়েও ভিডিও করতে দেখা গেছে টিকটকার-ইউটিউবারদের।
পদ্মা সেতুতে যানবাহন দাঁড় করানোয় সেতু কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এ সংক্রান্ত গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে। এতে বলা হয়, পদ্মা সেতুর ওপর কোনো যানবাহন দাঁড় করানো এবং যানবাহন থেকে নেমে ছবি তোলা যাবে না। সেতুর ওপর দিয়ে হাঁটা যাবে না।
সেতুর ওপর অনুমোদিত গতিসীমা ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার। এসবের তোয়াক্কাও করছে না কেউই। যে কারণে দিনের শেষ দিকে ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক জরিমানা শুরু করে নিয়ন্ত্রণে আনতে হয় অতিউৎসাহীদের। এদিকে হেলমেটবিহীন মোটরসাইকেল চালিয়ে সেতুর জাজিরা প্রান্ত থেকে মাওয়া প্রান্তে যাওয়ার সময় প্রথম জরিমানা গুনতে হয় আয়ুব খান নামের একজনকে। তার বাড়ি মাদারীপুর জেলায়।
এছাড়া জাজিরা এলাকার স্থানীয় ২০ জন যাত্রীকে নিয়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে গিয়েও পারেননি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জাজিরা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) উম্মে হাবিবা ফারজানার বাধায়। ছোট পিকআপে করে অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কারণে তাদের আটকে দেন তিনি। এছাড়া সেতুতে ঘুরতে আসা ব্যক্তিদের অনিয়ম ঠেকাতে পুলিশকেও জরিমানা করতে দেখা গেছে।