Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২৪,

এবার ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই সিলেটবাসীর

মুহাজিরুল ইসলাম রাহাত,  সিলেট

মুহাজিরুল ইসলাম রাহাত, সিলেট

জুন ২৮, ২০২২, ০১:৪৯ এএম


এবার ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই সিলেটবাসীর
ভয়াবহ বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে কিন্তু রেখে গেছে ক্ষতচিহ্ন। নতুন করে বাঁচার লড়াইয়ে শামিল হচ্ছে দুর্গত মানুষ। বন্যার চেয়ে এখন বেঁচে থাকার সংগ্রামই যেন কঠিন হয়ে উঠছে সিলেটবাসীর কাছে-আমার সংবাদ

‘উগার ভরা ধান আছিল। পনচাশটা (পঞ্চাশ) আস-মুরগি (হাঁস-মোরগ) আছিল। কুন্তা রইছে না, পানিয়ে সব লইয়া গেছে গি। এমন বাচার (বেঁচে) থাকি পানিত ডুবিয়া মরাউ (মারা যাওয়া) ভালা আছিল (ছিল)।’ 

নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে এভাবেই কথাগুলো বলেন সিলেট সদর উপজেলার বড়কাপন এলাকার কৃষক মুজিব মিয়া (৫০)। বন্যায় ঘরবাড়ি, ফসল ও হাঁস-মোরগ হারিয়ে এখন তিনি নিঃস্ব। গত রোববার বিকেলে আমার সংবাদের এই প্রতিবেদকের সাথে তার কথা হয়। 

তিনি প্রতিবেদককে জানান, সব কিছু আবার নতুন করে শুরু করতে অনেক টাকার প্রয়োজন। তার হাতে সেই টাকা নেই।’ তিনি জানান, বউ দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার ছোট সংসার। কৃষিকাজ করে ভালোই চলছিল তাদের সংসার। ভয়াল বন্যায় নিমিষেই সব কিছু চুরমার করে দিলো। এখন বেঁচে থাকাটাও তার কছে অভিশাপ।

সরেজমিন দেখা যায়, পুরো গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে আছে। পানি আগের চেয়ে কমলেও এখনো রাস্তাঘাট ডুবে আছে। এলাকায় এখনো হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি। গ্রামের বেশ কয়েকজন বাসিন্দার সাথে কথা বলে জানা গেছে, বানের পানি নামতে শুরু করায় দু’এক দিন আগে তারা ঘরে ফিরেছেন। এখন ঘরে জমে থাকা কাদাপানি ও আসবাবপত্র ধোয়ামুছা করছেন। পানির তোড়ে ভেঙে পড়া ঘরে খুঁটি, টিনের চালা ও বাঁশে বেড়া ঠিকঠাক করছেন। 

গ্রামের বাসিন্দা খেজুরুন বেগম (৪৫) জানান, তার ঘরে বুক সমান পানি ছিল। ঘর থেকে পানি নামলে এখনো উঠান ও আশপাশে উরু সমান পানি আছে। শনিবার তিনি আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে ঘরে ফিরেছেন। ঘরে ফিরে দেখেন বাঁশ-সনের ঘর পুরোটাই মাটিতে মিশে আছে। এখন ভিটেমাটি ছাড়া আর কিছুই নেই। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘এখন আমি কোথায় থাকব? কী খাব, কেমনে বাঁচব।’

মুজিব-খেজুরুনের মতো এখন সিলেটের হাজার হাজার মানুষের এই দুরবস্থা। পরপর দু’দফা বন্যায় বেশির ভাগ মানুষ এখন নিঃস্ব। এদের অনেকে আশ্রয় নেয়ার মতো জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না। অনেকের কাছে ঘরবাড়ি মেরামতের টাকাও নেই। যেসব ঘরগুলো এখনো দাঁড়িয়ে আছে সেগুলোর বেহাল দশা। ঝড় তুফানে যেকোনো সময় ভেঙে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। ফলে ভীতি ছড়ানো বানের জল থেকে বেঁচে ফেরা মানুষকে এখন নতুন আরেক লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বানভাসি মানুষদের এখন ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু করতে হচ্ছে।

সরকারি হিসাবে, সিলেট জেলায় বন্যায় ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৪ হাজার ৯৫৪টি। গতকাল দুপুর পর্যন্ত সিটি কর্পোরেশন ও জেলার ১৩টি উপজেলার ৫৭৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৪৯ হাজার ৭৭২ জন আশ্রিত মানুষ ছিলেন। আশ্রিত লোকদের অধিকাংশেরই বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। 

বিশেজ্ঞরা বলছেন, স্থানীয় প্রশাসনের কাছে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো দক্ষতার সঙ্গে দ্রুত, কার্যকর ও সমন্বিত ত্রাণ তৎপরতা চালিয়ে যাওয়া। আবার যেসব বেসরকারি সংস্থা, সংগঠন কিংবা ব্যক্তি সরাসরি ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছেন, এ ক্ষেত্রেও সমন্বয় প্রয়োজন। ত্রাণ তৎপরতার পাশাপাশি পুনর্বাসনের বিষয়টিও সরকারকে ভাবতে হবে। 

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী আমার সংবাদকে বলেন, সিলেটে ত্রাণ অপ্রতুল। বরাদ্দ বাড়ারো দরকার। পাশপাশি সঠিক বণ্টনও জরুরি। একই সাথে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও চিকিৎসাসেবার বিষয়ে সংশ্লিদের এখনই উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলেও জানান তিনি।

সিলেট জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, যে পরিমাণ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, সে সবই সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিরা শতভাগ বিতরণ করতে পারেননি। ত্রাণ যেন দ্রুততার সঙ্গে মানুষের হাতে পৌঁছায়, সেটা নিশ্চিত করতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বন্যার পানি পুরোপুরি নেমে যাওয়ার পর পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে। সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হবে।

সবশেষ বন্য পরিস্থিতি : সিলেটে বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। তবে মানুষের সংকট কাটছে না। গতকালও সিলেটের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি কমেছে। বানের পানি নেমে যাওয়ায় অনেকে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন। সিলেট পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ জানিয়েছেন, পানি কমছে ধীরগতিতে। সুনামগঞ্জে পানি বেশি থাকায় সিলেট থেকে পানি নামতে সময় লাগছে। তবে আশা করা যাচ্ছে সপ্তাহখানেকের মধ্যে পানি নেমে যাবে। 

সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি ধীরগতিতে কমছে। সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে আগের চেয়ে তুলনায় পানি কমেছে। এছাড়া কুশিয়ারা নদীর পানি দুটি পয়েন্টে এখনো বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। তবে পানি আগের চেয়ে দুই থেকে চার ইঞ্চি করে কমেছে। 

এদিকে জেলার বিয়ানীবাজার, জকিগঞ্জ, বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এসব উপজেলার বানভাসি মানুষ জানান, পানি আগের চেয়ে কমেছে। তবে দুর্ভোগ কাটেনি। 

গতকাল নগরের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন দেখা গেছে, নগরের মূল সড়কগুলো থেকে পানি নেমে গেলেও পাড়া-মহল্লার ভেতরে পানি জমে আছে। এসব পানি থেকে উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বাসিন্দারা এসব পানি মাড়িয়েই চলাফেরা করছে। এছাড়া নগরের ছড়া, খালগুলো ময়লা-আবর্জনা পড়ে পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতার তৈরি হয়েছে। 

জেলার বিভিন্ন উপজেলায় খুঁজ নিয়ে জানা যায়, এখনো নিচু এলাকায় বাড়িঘর, রাস্তাঘাটে বন্যার পানি আছে। জেলা-উপজেলার মূল সড়কগুলো থেকে পানি নামলেও গ্রামীণ সড়কগুলো এখনো প্লাবিত। এদিকে পানি নামার পর বিভিন্ন এলাকায় রোগ-বালাই দেখা দিচ্ছে। এর মধ্যে ডায়রিয়া, পেটের পীড়া ও চর্মরোগে আক্রান্ত বেশি।   

Link copied!