জুন ২৮, ২০২২, ০২:২৪ এএম
‘অসম্ভবের অভিযানে এরা চলে, না চলেই ভীরু ভয়ে লুকায় অঞ্চলে! এরা অকারণ দুর্নিবার প্রাণের ঢেউ, তবু ছুটে চলে যদিও দেখেনি সাগর কেউ।’ লাইনগুলো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের। করোনার দুঃসময়ে মানুষ যখন ঘর থেকে মৃত্যুভয়ে বের হয়নি তখন তরুণরা ঘরে ঘরে সেবা পৌঁছে দিয়েছে। সেই তারুণ্যকে আবার দেখল বাংলাদেশ। সিলেট যখন চলে গেল পানির নিচে। মানুষের চলে বাঁচার লড়াই।
সড়ক বিচ্ছিন্ন, বিদ্যুৎ নেই, খাবার সঙ্কট, উদ্ধার কাজের জন্য নৌকা নেই। ভয়াবহ এক পরিস্থিতি সেই পরিস্থিতে তরুণ্য রূপ দেখল সারা দেশ। সিলেটে প্রশাসনের সাথে উদ্ধার কাজে নেমে পড়ে যুবকরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আহ্বান করে অর্থ সংগ্রহ করে বানবাসী মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। এখন সেই সিলেটে কিছুটা পানি কমছে, আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মানুষ ঘরে ফিরছে। সাথে বলে যাচ্ছে তারুণ্যের সাহসী প্রেরণার কথা।
স্বেচ্ছাসেবক ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এখনো সিলেট নগরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অর্ধশতাধিক লোক এবং রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পর্যায়ের একাধিক সংগঠন বানিয়ে তারা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক উদ্যোগে বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছেন। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন গ্রাম ও শহরের বানভাসি মানুষের কাছে রান্না করা শুকনো খাবার থেকে শুরু করে চাল, ডাল, তেল, লবণসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে যাচ্ছেন।
শিল্পী তাশরীফ : বন্যায় প্রথম থেকেই মানুষের পাশে দাঁড়ান গায়ক তাশরীফ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লাইভের মাধ্যমে তিনি বন্যার্ত মানুষের জন্য কোটি টাকা উত্তোলন করেন। সেই অর্থ থেকে সহায়তা পৌঁছে দিচ্ছেন সাধারণ মানুষের মধ্যে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যার্তদের ব্যক্তিগতভাবে সহায়তার উদ্দেশে সিলেটে আসেন তিনি। এখানে এসে বন্যার ভয়াবহতা থেকে চিন্তায় করেন তাশরীফ। তার একার সহায়তা দিয়ে কিছুই হবে না। লড়তে হবে সম্মিলিতভাবে।
এরপরই গত ১৬ জুন প্রথমবার নিজের অফিসিয়াল ফেসবুক থেকে লাইভ করে দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে অর্থ সহায়তার আহ্বান জানান তাশরীফ। প্রথম পর্যায়েই খুব কম সময়ের মধ্যে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ১৬ লাখ টাকা অর্থ সহায়তা পান। সবার এই অভাবনীয় সাড়ায় ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান তাশরীফ। সিলেটের স্থানীয় তরুণদের সঙ্গে নিয়ে ওই টাকা দিয়ে কেনা খাবার বানভাসি মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। মানুষের কাছ থেকে যে ১৬ লাখ টাকা তিনি পেয়েছিলেন, ফেসবুক লাইভে এসে স্বচ্ছতার সঙ্গে তার সমস্ত বিবরণও দিতে দেখা যায় এই তরুণকে।
দ্বিতীয় ধাপে, গত ১৯ জুন আরও একটি লাইভে এসে বানভাসি মানুষের সহায়তায় সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তাশরীফ। এবার ঘটে আরও অভাবনীয় ঘটনা। তরুণ গায়কের আহ্বানে সাড়া দেন আরও বেশি সংখ্যক মানুষ। লাইভের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এবার তাশরীফের তহবিলে জমা পড়ে কোটি টাকার বেশি।
তাশরীফ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘২০-২৫ দিন আগে সিলেটে প্রথম বন্যার সময় আমরা কথা দিয়েছিলাম, সিলেটের মানুষের পাশে থাকব। সেই সময় আমাদের সিঙ্গাপুরে একটি শো ছিল। আমরা চেয়েছিলাম, শো থেকে পাওয়া আয় নিয়ে সিলেট যাব। শো শেষে ১৩ জুন দেশে ফিরে ১৪ তারিখে সিলেট আসি কথা রক্ষার জন্য। আমরা এক লাখ টাকা নিয়ে আসি। কিন্তু সেদিন থেকেই কাকতালীয়ভাবে সিলেটে পানি ও বৃষ্টি বাড়তে শুরু করে। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিই, পরিস্থিতি ভালো না, এক লাখ টাকায় হবে না। তখন ভাবছিলাম এক লাখ টাকায় কী করতে পারব? তখন একটি ছবি পোস্ট করে বলি, ‘এক-দুই লাখ টাকা পর্যাপ্ত মনে হচ্ছে না। আমি সিলেট থেকে কোনোভাবেই পালিয়ে যেতে চাই না। আপনারা পাশে দাঁড়ান। এর ঠিক ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টায় ১৪ লাখ টাকা দিয়ে মানুষ পাশে দাঁড়ায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘পরে আমাদের নম্বরগুলো লেনদেনের সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করে। এটাও পর্যাপ্ত ছিল না। পরবর্তীতে আমরা আবার তৃতীয়বারের মতো ফান্ড রাইজিং করি। সেখানে অবিশ্বাস্যভাবে প্রায় দেড় কোটিরও বেশি টাকা মানুষ পাঠিয়েছে। মানুষের এই ভালোবাসা আমাকে ইমোশনাল করে দিয়েছে। ইচ্ছা করছে, অর্থসহায়তা দেয়া প্রতিটি মানুষের পা ছুঁয়ে সালাম করি। তারা আমাদের মতো তরুণদের অনেক বড় একটা স্বপ্ন দেখাল।’
শায়খ আহমাদুল্লাহ : শুকনো খাবারসহ জরুরি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে বানবাসী মানুষদের সহায়তা করছেন শায়খ আহমাদুল্লাহ। এ বিষয়ে তিনি জানিয়েছেন, ৭০০ টন ত্রাণসামগ্রী ইতোমধ্যে পৌঁছানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরো প্রস্তুত করা হচ্ছে। যা চলমান থাকবে। এর মধ্যে ছিল শিশুখাদ্য (গুঁড়ো দুধ), খেজুর, চিড়া, চিনি ও মোমবাতি। সেই সাথে ছিল মিনারেল ওয়াটার। চাল, ডাল, আলু, তেল ইত্যাদির প্যাকেজও দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় দুর্গম এলাকায় এসব খাদ্য দেয়া হয়।
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন : বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন তাদের মানবিক কার্যক্রমের মাধ্যমে ইতোমধ্যে সারা দেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সিলেটের বন্যায়ও তারা এগিয়ে এসেছে। জলমগ্ন সিলেট অঞ্চলের মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দিতে তারা চলমান নৌকার ওপরই সারছে রান্নার কাজ। তারা তাদের ফেসবুক পেজে নিয়মিত তথ্য ও ছবি প্রকাশ আসছে।
এ সব ছবিতে দেখা যায়, কখনো রান্না করা খাবার, কখনো খাদ্যসামগ্রী, কখনো আবার মেডিকেল সাপোর্ট, কখনো বস্ত্র বিতরণের মাধ্যমে তারা বন্যার্ত মানুষকে সাহায্য করে আসছেন। চারদিকে পানি থাকায় নৌকাকেই রান্না ঘর আবার কখনো হাসপাতাল বানিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবক মাকসুদুর রহমান বলেন, ‘সিলেট ও সুনামগঞ্জে আমাদের দুটি দলে ৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। শুকনো খাবারগুলো আমরা ঢাকা থেকে পাঠাই।
ব্যারিস্টার সুমন : সিলেট অঞ্চলের বানভাসি মানুষের সহায়তার জন্য ফেসবুকে অর্থ সংগ্রহের ঘোষণা দিয়ে ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। দুই দিনে তার তহবিলে জমা পড়েছে প্রায় ৯৭ লাখ টাকা। এরপর তিনি সিলেট, সুনামগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ান। এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, যারা অর্থ দিয়েছেন আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
রেড ভলেন্টিয়ার : সিলেটের বন্যা শুরুর পর থেকেই সিলেটে বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে রেড ভলেন্টিয়ার নামে একটি সংগঠন। সিলেটের বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ও পেশাজীবী মানুষের যৌথ উদ্যোগে এ সংগঠন গড়ে উঠে। রেড ভলেন্টিয়ারের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বন্যা শুরু পর টানা আটদিন ধরে তারা বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। প্রথম দিকে খাবার পানি, মোমবাতি ও শুকনো খাবার দিয়ে তারা নগরের পানিবন্দি মানুষের পাশে দাঁড়ান। পরে তারা সিলেটের কোম্পানিজ, সদর উপজেলা, বালাগঞ্জ, দক্ষিণ সুরমাসহ বিভিন্ন উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে রান্না করা খাবার ও খাদ্যসামগ্রী নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন তারা। রোববার পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষের পাশে তারা দাঁড়াতে পেরেছেন।
সংগঠনটির সমন্বয়ক মতিউর রহমান বলেন, বন্যায় ভয়াবহতা দেখে তাৎক্ষণিকভাবে আমরা এ কার্যক্রম শুরু করি। তারপর আমাদের সাথে সিলেটের বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক ভলেন্টিয়ার যোগ দেন। আমাদের এ কাজে প্রবাসী, বিভিন্ন সংগঠন,মানুষ আমাদের সহায়তা করেছেন।
তওহিদ আফ্রিদি : সিলেটে বন্যার্ত মানুষের জন্য প্রায় ৫০ লাখ টাকার ত্রাণ নিয়ে ঢাকা থেকে ছুটে আসেন জনপ্রিয় ইউটিউবার তওহিদ আফ্রিদি। এরপর তিনি সিলেটে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র এ সব ত্রাণসামগ্রী তুলে দেন। এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, ‘সিলেটবাসীর সহায়তায় যারা আমাকে সাহায্য করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানাই। আমি সিলেটবাসীর কাছে আপনাদের সাহায্য পৌঁছে দেবো। দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।’
ফারাজ করিম : সিলেট ও সুনামগঞ্জের দুর্গম এলাকায় বন্যাদুর্গত মানুষের মাঝে ৩০ লাখ টাকার ত্রাণ বিতরণ করেছেন চট্টগ্রামের রাউজানের এমপিপুত্র ফারাজ করিম চৌধুরী। গত সপ্তাহে সেন্ট্রাল বয়েজ অব রাউজানের প্রায় অর্ধশত স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে তিনি সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে গিয়ে ত্রাণ কার্যক্রম চালান। ফারাজের ত্রাণ কার্যক্রমের সমন্বয়কারী সুমন দে জানান, ফারাজের নেতৃত্বে তারা সেখানে দুর্গম পাড়া গ্রামে নৌকা ও ট্রলার নিয়ে পানিতে ভাসমান দুর্গত মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছি।
একজন আমের মক্কি : যেকোনো দুর্যোগ দুঃসময়ে ছুটে যান। মানবিক কর্মকাণ্ডের জন্য সবার মুখে মুখে এ তরুণ। গত ১৯ জুন মানুষকে সাহায্যে করতে ফেনী থেকে সিলেটে ছুটে যান। অংশ নেন বানবাসি মানুষদের উদ্ধারে। মানুষের মাধ্যেমে পাওয়া প্রায় হাজারখানেক বানবাসীকে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হয়। আমের মক্কি বলেন, গত আটদিনে আমি দিন-রাত ছুটে গিয়েছি যখন যেখানে যাওয়ার অনুরোধ পেয়েছি। সকাল থেকে সন্ধ্যা না খেয়ে থেকে টানা কাজ করেছি। ভিজা কাপড় গায়ের মধ্যে শুকিয়ে গেছে এমন ঘটনা নিয়মিত। কখনো নৌকা, কখনো ডিঙি নৌকা, কখনো ট্রলার, কখনো স্পিডবোট যখন যেটা প্রয়োজন যেটা পেয়েছি সেটা নিয়ে ছুটেছি।
তারুণ্য উদ্যোগে ৬০ লাখ টাকার তহবিল : তারুণ্য উদ্যেগে ফেনী থেকে প্রায় ৬০ লাখ টাকার ত্রাণ তহবিল বিভিন্নভাবে সিলেটে গিয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে সাংবাদিক ডালিম হাজারী নেতৃত্বে ফেনীবাসীরপক্ষ থেকে প্রথম দফায় আড়াই লাখ টাকায় ২২৫ পরিবারের মাঝে সাহায্যে যায়। দ্বিতীয় দফায় রক্ত কণিকা, পরিবর্তন, উম্মাহ ব্লাড ডোনেশন ক্লাব, তারুণ্যের বন্ধন, গ্রিন ফোকাস স্পোর্টিং ক্লাব, ফেনী ব্লাড ডোনেট অ্যাসোসিয়েশনের সংগ্রহ করা তহবিলে ছয় লাখ টাকা যা এক হাজার পরিবারের মধ্যে দেয়া হয়। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মাটির প্রতিষ্ঠাতা আমের মক্কির পক্ষ থেকে তিন লাখ টাকায় ৬০০ পরিবারকে দেয়া হয়। ফেনী জেলা বেসরকারি হিফজ মাদ্রাসা পাঁচ লাখ টাকায় এক হাজার পরিবারকে ত্রাণ পৌঁছে দেন।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, ‘বন্যা দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে সরকারি ত্রাণ সহযোগিতার পাশাপাশি বিভিন্ন তরুণ, সংগঠন এগিয়ে এসেছে। তারা বিভিন্ন স্থানে ত্রাণসামগ্রী ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করছে। অনেকে আমাদের কাছে তাদের সহায়তা পৌঁছে দিচ্ছেন। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর আমরা স্থানীয় ইউএনওর সাথে যোগাযোগ করে যে সব গ্যাপ রয়েছে সেখানে তাদের পাঠাচ্ছি।’
অনন্ত জলিল : সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যার্তদের জন্য ৩০ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন ঢাকাই সিনেমার জনপ্রিয় চিত্রনায়ক ও প্রযোজক অনন্ত জলিল। সম্প্রতি নিজের ফেসবুক পেজে ৩০ লাখ টাকা অনুদানের ঘোষণা দেন। পাশাপাশি তার এজেআই ও এবি গ্রুপের অফিস কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারের জন্য রেসকিউ টিম গঠন করতে।