নিজস্ব প্রতিবেদক
জুলাই ১, ২০২২, ০১:৫৭ এএম
নিজস্ব প্রতিবেদক
জুলাই ১, ২০২২, ০১:৫৭ এএম
অর্থবছরের শেষ সময়ে এসে টাকা খরচের মহড়ায় নেমেছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। জুন ক্লোজিংয়ের আগে টাকা খরচ দেখাতে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে সচিবালয়ে চলছে বিভিন্ন রুমের দরজা, জানালায় থাই গ্লাস লাগানো, টাইলস বসানো, রঙ করাসহ নানান কাজ। আর এসব কেনাকাটায় গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের চালিয়ে যাচ্ছেন ‘কমিশন বাণিজ্য’।
সচিবালয়কে শব্দদূষণ মুক্ত রাখতে নানান উদ্যোগ নেয়া হলেও এখন সচিবালয়ে শব্দদূষণ সর্বোচ্চ মাত্রায়। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ-১) শাকিলা জেরিন আহমেদ বলেন, আসলে সচিবালয় হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ একটি সরকারি ভবন। এখনে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং সিনিয়র সচিব ও সচিবরা অফিস করেন। তাদের রুমের দরজা, জানালায় থাই গ্লাস লাগানো, টাইলস বসানো, রঙ করাসহ সব কাজ গণপূর্ত অধিদপ্তর করছে।
প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং সিনিয়র সচিব ও সচিবদের অফিস রুমের দরজা, জানালায় থাই গ্লাস লাগানো, টাইলস বসানো, রঙ করা এবং কেন্দ্রীয় রেকর্ড ভবনের পয়ঃনিষ্কাশন লাইন মেরামত করার নামে চলছে গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কমিশন বাণিজ্য। সচিবালয়ের প্রতিটি ভবনে কাজ চলছে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। আবার অনেক ভবনে কোনো কক্ষে মেরামত ও রঙ না করেও সরকারি অর্থ তুলে নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে সচিবালয়ের এক নম্বর ভবন মন্ত্রিপরিষদ ভবনটি ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। তারপরও সংস্কারের নামে সরকারি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে।
গতকাল ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ হচ্ছে জুন ক্লোজিং (অর্থবছর)। কিন্তু সময়ের অভাবে অনুমোদন পাওয়া প্রাক্কলিত অর্থ কাজে লাগাতে গোপনে কাগজ-কলমে দরপত্র আহ্বান দেখিয়ে কাজ সম্পন্ন হয়েছে। মূলত শেষ হতে যাওয়া অর্থবছরের টাকা খরচের মচ্ছপ চলছে। তা না হলে বরাদ্দ অর্থ সরকারের কোষাগারে ফেরত যাবে।
তাই গোঁজামিল দিয়ে, কখনো কাজ না করেই কাগজ-কলমে কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে ঠিকাদারকে বিল দিয়ে দিচ্ছেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা। অথচ সচিবালয়ের সামনে বড় অক্ষরে বলা হয়েছে শব্দদূষণ এলাকা। সেই বিধিমালা মানছেন না গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা।
গণপূর্ত সার্কেল-২-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সতীনাথ বসাক এবং গণপূর্ত বিভাগ-৩-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কায়সার ইবনে সাঈখ যোগসাজশ করে কাজ শেষ না করেই ঠিকাদারদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে বিল পরিশোধ করছেন। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর অফিসকে বিলের মোট পাঁচ পার্সেন্ট দিতে হয়। সমপ্রতি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর অফিস কক্ষটি ২১ লাখ টাকা ব্যয়ে সংস্কার করার বিষয়টি মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত করার নির্দেশনা দিয়েছে বলে জানা গেছে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে ২০২১-২২ অর্থবছরে স্থাপনা মেরামত বা বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা (এপিপি) খাতে গণপূর্ত অধিদপ্তরকে মোট ৮১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে স্থাপনা মেরামতের জন্য আবাসিক ভবনে পাঁচ হাজার ৯১২টি কাজের জন্য ৪০৫ কোটি এবং অনাবাসিক ভবনে ছয় হাজার ১৭৪টি কাজের জন্য ৪০৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়।
যেসব ভবনে কাজ চলছে সেগুলো হচ্ছে, ৬ নম্বর ভবন, ৭ নম্বর ভবন, ৩ নম্বর ভবন, চার নম্বর ভবনসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে দেখভালের দায়িত্বে গণপূর্ত সার্কেল-২-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সতীনাথ বসাক এবং গণপূর্ত বিভাগ-৩-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কায়সার ইবনে সাঈখ যোগসাজশ করে কাজ শেষ না করেই ঠিকাদারদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে বিল পরিশোধ করছেন। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর অফিসকে বিলের মোট পাঁচ পার্সেন্ট দিতে হয়। সমপ্রতি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর অফিস কক্ষটি ২১ লাখ টাকা ব্যয়ে সংস্কার করার বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ তুলেছে কর্মকর্তারা, তা আবার সমালোচনা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই কর্মকর্তা দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রায় ১০ মাস আগে কক্ষটির ওয়াশরুমের কমোডসহ ফিটিংস পরিবর্তন করা হয়েছিল এবং দামি ফার্নিচার কেনা হয়েছিল। প্রথমে দামি টাইলস বসানোর পর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর তা পছন্দ না হওয়ায় আবার তা তুলে দামি পাথর বসানো হয়েছে। এভাবে প্রশাসনের অনেক ভবন সংস্কারে নামে সরকারি টাকা অপচয় করেছেন এসব কর্মকর্তারা।
ঢাকার তেজগাঁও ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের বাংলো-১-এর দরজা, জানালায় থাই গ্লাস লাগানো, টাইলস বসানো, রঙ করা এবং কেন্দ্রীয় রেকর্ড ভবনের পয়ঃনিষ্কাশন লাইন মেরামত ও গ্যারেজ কাম-ড্রাইভার কোয়ার্টারের নিচতলায় গ্যারেজগুলোর সিলিং মেরামত, বিভিন্ন দরজা মেরামত, স্যুয়ারেজ লাইন মেরামত কাজের জন্য গত ৫ জুন ১৯ লাখ ৮৭ হাজার টাকার একটি প্রাক্কলন অনুমোদন করেন ঢাকা গণপূর্ত সার্কেল-২-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সতীনাথ বসাক।
কিন্তু অর্থবছরের শেষ মুহূর্তে অনুমোদন পাওয়া এ কাজ শেষ না করেই বিল পরিশোধের সব প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছেন ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-৩-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কায়সার ইবনে সাঈখ। শুধু এটা নয়, বিভাগ-৩-এর জন্য এভাবে গত মে ও চলতি জুন মাসে অনুমোদন দেয়া হয়েছে চার কোটি টাকারও বেশি মেরামতের কাজের প্রাক্কলন, যার অধিকাংশই নামমাত্র কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে বিল পরিশোধ করা হচ্ছে। এভাবে মে ও জুন মাসে তড়িঘড়ি করে গণপূর্ত অধিদপ্তরের ঢাকা জোন ও ঢাকা মেট্রোপলিটন জোনের অধীনে ২০০ কোটি টাকারও বেশি খরচ দেখানো হচ্ছে ভবন মেরামত, রঙ করাসহ আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, গত মে মাসের শেষদিকে বা জুন মাসে কোনো প্রাক্কলন অনুমোদন হওয়ার পর দরপত্র আহ্বান করে সঠিকভাবে কাজ সম্পন্ন করা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়। তারপরও অর্থবছর শেষ হওয়ায় কাজ শেষ দেখাতে হবে জুনের মধ্যে। তা না করলে বরাদ্দ অর্থ সরকারের কোষাগারে ফেরত যাবে। এ কারণে বেশিরভাগ নির্বাহী প্রকৌশলীই গোঁজামিল দিয়ে বা কাজ না করেই কাগজ-কলমে কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে ঠিকাদারকে বিল দিয়ে দিচ্ছেন।
অভিযোগ রয়েছে, গণপূর্ত অধিদপ্তরের ই/এম ঢাকা-৮-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুল হালিম ঠিকাদারদের কাছ থেকে ৫ শতাংশ হারে টাকা নিয়ে প্রাক্কলিত দর অনুযায়ী কাজ দিয়েছেন। পিপিআর অনুযায়ী এলটিএম (লিমিটেড টেন্ডারিং মেথড) পদ্ধতিতে দরপত্র হওয়ার কথা থাকলেও তা না করে ওটিএমের মাধ্যমে টেন্ডার আহ্বান করে কাজ দেয়া হয়েছে। টেন্ডার আইডি হাইড করে রেখে যাদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হতো তাদের আইডি ও রেট জানিয়ে দিত বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা।
তাদের দাবি, পিপিআর অনুযায়ী ইজিপিতে এলটিএমের বাইরে দরপত্র আহ্বানের সুযোগ নেই। এলটিএমের ক্ষেত্রে প্রতি টেন্ডারে ১০ শতাংশ কমে দর জমা পড়ে। এর মধ্যে লটারির মাধ্যমে কাজ দেয়া হয়। এতে সরকারের শিডিউল বেশি বিক্রি হওয়ায় সরকারি কোষাগারে টাকা জমা হওয়ার পাশাপাশি ১০ শতাংশ কমের কারণে সরকারের অর্থ সাশ্রয় হয়। কিন্তু নির্বাহী প্রকৌশলী তার মনোনীত ব্যক্তিদের প্রাক্কলিত মূল্যে কাজ দেয়ায় সরকারের ১০ শতাংশ হ্রাসের অর্থ লোকসান হচ্ছে।
তবে এই ১০ শতাংশ টাকা প্রকৌশলী এবং ঠিকাদার ভাগ করে নেন তাদের নির্ধারিত কমিশনের বাইরে। ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-৩-এর নির্বাহী প্রকৌশলীর সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৬ মে ঢাকার সেগুনবাগিচায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভবনের ১নং ব্লকের দ্বিতীয় তলায় প্রয়োজনীয় মেরামত ও রঙ করার একটি প্রাক্কলন এবং সেগুনবাগিচায় অডিট কমপ্লেক্স ভবনের তৃতীয় তলায় পূর্ত অডিট অধিদপ্তরের বিভিন্ন কক্ষে মেরামত ও রঙ করার কাজের আরেকটি প্রাক্কলন অনুমোদন দিয়েছেন ঢাকা গণপূর্ত সার্কেল-১-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী।
গত সোমবার রাজস্ব ভবনের দ্বিতীয় তলায় রঙ করার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।
এনবিআরের প্রশাসন বিভাগের কর্মচারীরা জানান, দ্বিতীয় বা তৃতীয় তলায় কোনো মেরামত বা রঙ করা হয়নি, বরং এই ভবনের দেয়ালগুলোর অবস্থা খুবই জরাজীর্ণ। একইভাবে অডিট কমপ্লেক্স ভবনের তৃতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, শুধু লিফটের সামনের ছোট্ট খোলা জায়গার দেয়ালের নিচের অংশ মেরামত করা হয়েছে।
গণপূর্ত ঢাকা সার্কেল-১-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. জামিলুর রহমানের কার্যালয় থেকেও অর্থবছরের শেষ মুহূর্তে মে ও জুন মাসে প্রায় ২০ কোটি টাকার কাজের প্রাক্কলন অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে একজন নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকার অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত কাজের প্রাক্কলন পাঠানোর ঘটনাও ধরা পড়ে। আরবরিকালচার বিভাগের দায়িত্বে থাকা প্রধান বৃক্ষপালনবিদ শেখ মো. কুদরত-ই-খুদাও কাগজ-কলমে গাছ লাগানোর নামে অর্থবছরের শেষ মুহূর্তে প্রায় চার কোটি টাকার বিল পরিশোধের উদ্যোগ নিয়েছেন।
তিনি ২২৪টি কাজের চাহিদা দিয়ে চলতি অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ পেয়েছেন ১০ কোটি টাকা। অর্থবছরের শেষ মুহূর্তে এসে কয়েকদিন আগে ই/এম গণপূর্ত বিভাগ-৮-এর জন্য জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বৈদ্যুতিক কাজ ও তিনটি এয়ারকুলার লাগানোর জন্য এক কোটি ৩৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
এর মধ্যে দ্বিতীয় তলায় প্রশাসনিক ভবনে বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং ও সুইচ পরিবর্তনের জন্য ৩৩ লাখ ৫৪ হাজার, গার্ডেন লাইট ও সিকিউরিটি লাইটের জন্য ২৮ লাখ ৭০ হাজার, ইমার্জেন্সি ব্লকে এসির জন্য ১৫ লাখ ৯৬ হাজার, রেটিনা ব্লকের এসির জন্য ২৯ লাখ ৫৫ হাজার ও প্রশাসনিক ব্লকে ভিআরএফ এসির জন্য ২৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা গণপূর্ত সার্কেল-২-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সতীনাথ বসাক বলেন, যারা ভালো কাজ করে তার বিরুদ্ধে সব সময় এগুলো অভিযোগ হয়। তবে কাজ না করে বিল পরিশোধের কোনো সুযোগ নেই। অনেক সময় প্রশাসনিক অনুমোদন পেতে দেরি হয় তাই এমনটি হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাহী প্রকৌশলীদের কাছ থেকেও প্রাক্কলন পেতে দেরি হয়।
তিনি এসব বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-৩-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কায়সার ইবনে সাঈখের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।