Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪,

বিদ্যুতে আলোকিত ৮৪ হাজার গ্রাম

মহিউদ্দিন রাব্বানি

জুলাই ৩, ২০২২, ০১:৩৯ এএম


বিদ্যুতে আলোকিত ৮৪ হাজার গ্রাম

শতভাগ বিদ্যুতায়নের ফলে দেশে ৮৪ হাজার গ্রাম এখন আলোকিত। রাতের অন্ধকার ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ছে বিদ্যুতের আলো। গ্রাম, শহর, নগর, বন্দর সর্বত্রই বিদ্যুতের সুফল পাচ্ছে নাগরিকরা। অধুনা বিশ্বে বিদ্যুতহীনতা কল্পনা করা যায় না। 

শিল্প, ব্যবসা, কৃষি থেকে শুরু করে শিক্ষা-চিকিৎসা সব ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ এখন অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুতায়নের ফলে শিল্পের চাকা এগিয়ে চলছে। তীব্র হচ্ছে অর্থনীতির গতিও। বর্তমানে পল্লী, শহর, দ্বীপ ও পাহাড়ি জনপদের মোট ৮৪ হাজার ২৪৮টি গ্রাম শতভাগ বিদ্যুতায়িত। 

গত এক যুগে সরকারের বিদ্যুৎবিভাগ নানা সফলতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড-আরইবির তথ্যমতে, সরকার শতভাগ মানুষের কাছে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দিয়েছে। এসময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর স্বাধীনতার ৫০ বছরে উৎপাদন বেড়েছে ৫০ গুণ। 

বর্তমান সরকারের মেয়াদে ১৯ হাজার ৬২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। পাঁচ হাজার ২১৩ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। তিন লাখ ৬১ হাজার কিলোমিটার বিতরণ লাইন নির্মাণ করা হয়। নতুন করে তিন কোটি ১৩ লাখ গ্রহক সংযোগ করা হয়েছে। মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ২২০ কিলোওয়াট থেকে ৫৬০ কিলোওয়াটে উন্নীত হয়েছে। বিদ্যুতের বিতরণ সিস্টেম লস ৫.৮৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। 

পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে ৭৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। ৬০ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে ১৩ হাজার ২১৯ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। ভারতে থেকে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। শীত মৌসুমে এবং অফ-পিক আওয়ারে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ রপ্তানির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। 

বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৪ হাজার মেগাওয়াট। তবে এখন ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট। দেশে ৭৭৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। 

সর্বমোট ৪৬ লাখ ৭৭ হাজার প্রি-পেইড ও স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করা হয়েছে। সেচ কাজে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। ই-টেন্ডারিং, ই-নথি, ইআরপি, স্ক্যাডা, জিআইএসসহ অনলাইন ভিত্তিক সফটওয়ার চালু করার মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতে পেপারলেস অফিস স্থাপন করা হচ্ছে। 

দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে দেশটির বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাবলিক সেক্টর প্রতিষ্ঠান হিসেবে পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড গঠন করেন। সংস্থাটি দেশের বিদ্যুৎ অবকাঠামো নির্মাণ এবং দেশের অধিকাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিচালনা করে থাকে। প্রধানত দেশের নগরাঞ্চলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের এবং বণ্টনের জন্য পিডিবি দায়বদ্ধ। বোর্ডটি সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের অধীনে রয়েছে।

১৯৭৫ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশ পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড প্রকৌশলী সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিকনির্দেশনামূলক এক ভাষণে বলেন, ‘বিদ্যুৎ ছাড়া কোনো কাজ হয় না, কিন্তু দেশের জনসংখ্যা শতকরা ১৫ ভাগ লোক যে শহরের অধিবাসী, সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহের অবস্থা থাকিলেও শতকরা ৮৫ জনের বাসস্থান গ্রামে বিদ্যুৎ নাই। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করিতে হইবে। ইহার ফলে গ্রামবাংলার সর্বক্ষেত্রে উন্নতি হইবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ চালু করিতে পারিলে কয়েক বছরের মধ্যে আর বিদেশ হইতে খাদ্য আমদানি করিতে হইবে না।’

জাতির জনকের মতো বিদ্যুতের গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রধানমন্ত্রী জাতিকে দেয়া তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেছেন। শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ ‘সবার জন্য বিদ্যুৎ’ বাস্তবায়নের ফলে শতভাগ জনগোষ্ঠীকে বিদ্যুতের ছোঁয়া পেয়েছে। দেশে বিভিন্ন ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। বিদ্যুতের চাহিদা সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকে বেজ লোড, ইন্টারমিডিয়েট লোড এবং পিক লোড। আর এর ওপর নির্ভর করে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তৈরি করা হয়ে থাকে। বেজ লোড সেই পরিমাণ বিদ্যুতের চাহিদা যার নিচে বিদ্যুতের চাহিদা কখনই নামে না এবং সব সময়ই এটি সরবারহ করতে হয়। 

পিক লোড হলো সর্বোচ্চ পরিমাণ বিদ্যুতের চাহিদা, সাধারণত সারা দিনের মোট চাহিদার ১৫ শতাংশ হয়ে থাকে পিক লোড। বেজ লোড এবং পিক লোডের অন্তর্বর্তীকালীন  লোডকে বলা হয়ে থাকে ইন্টারমিডিয়েট লোড। বিদ্যুতের চাহিদার ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তৈরি করা হয়েছে। 

পিকিং প্ল্যান্টগুলো মূলত ওপেন সাইকেল গ্যাস টারবাইনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। অন্যদিকে আর বেজ লোড প্ল্যান্টগুলো পরিচালিত হয় কম্বাইন্ড সাইকেল গ্যাস টারবাইনের মাধ্যমে। সাধারণত বেজ লোডের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো হয়ে থাকে কয়লা ও গ্যাস চালিত কিংবা জলবিদ্যুৎ চালিত অপরদিকে পিক লোড বা পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো হতে পারে ফার্নেস অয়েল বা ডিজেলচালিত। দেশের অধিকাংশ বেজ লোড পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো সরকারি মালিকানাধীন। 

আর পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো হল রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট যা বেসরকারি মালিকানায় পরিচালিত। ২০১০ সাল নাগাদ তরল জ্বালানি দ্বারা পরিচালিত কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট দ্বারা দেশের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৫ শতাংশ উৎপাদিত হতো, ২০১১ সাল নাগাদ যা দাঁড়ায় ১৩ শতাংশ এবং ২০১২ সাল নাগাদ যা ছিল ১৭ শতাংশ। ২০১৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ১১টি রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট ছিল গ্যাস চালিত এবং ১৭টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট ছিল। 

আর এভাবে উত্তরোত্তর উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে শতভাগ বিদ্যুতের যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। একই সাথে বিশ্বের ১৩তম আলট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহারকারী দেশে পরিণত হল ৫০ বছর বয়সি বাংলাদেশ। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রা এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি উদ্বোধনের সময় বলেন, এটি এখন পর্যন্ত স্থাপিত দেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ১৩তম আলট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহারকারী দেশ। এই কেন্দ্রে জ্বালানিসাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব ক্লিন কোল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। সালফার নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ফ্লু-গ্যাস ডিসালফারাইজেশন (এফজিডি) ইউনিট এবং ফ্লাই অ্যাশ নির্গমণ রোধে ৯৯ শতাংশ দক্ষতাসম্পন্ন ইলেকট্রো-স্ট্যাটিক প্রেসিপিটেটর (ইএসপি) যুক্ত করা হয়েছে।

তিনি আরও জানান, ১৯৯৬ সালে আমরা সরকার গঠন করার পর বিদ্যুৎ পেয়েছিলাম এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট, ২০০০-০১ অর্থবছরে তা চার হাজার ৩০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করেছিলাম। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি এবং সরকারি-বেসরকারি মিশ্রখাত সৃষ্টির জন্য আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছিলাম। ২০২০ সালের মধ্যে ‘সবার জন্য বিদ্যুৎ’ সরবরাহের লক্ষ্য নিয়ে ‘ভিশন স্টেটমেন্ট ও পলিসি স্টেটমেন্ট অন পাওয়ার সেক্টর রিফর্মস’ প্রণয়ন ও অনুমোদন দেয় সরকার। 

পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে ‘বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার পাওয়ার অ্যাকশন প্লান-২০০০’ প্রণয়ন করা হয়। বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের মাধ্যমে ৫৪ হাজার ৪৮৯ কিলোমিটার বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন নির্মাণ করে। ১৩ হাজার ৭১৩টি গ্রামকে বিদ্যুতায়িত করা হয়।   বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বোর্ডের লক্ষ্য হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সব জনগণের জন্য সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য, টেকসই এবং আধুনিক বিদ্যুৎসেবা নিশ্চিত করা। 

এছাড়া উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের সব জনগণের জন্য গুণগত মানের বিদ্যুৎসেবা প্রদান নিশ্চিত করা। জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ভুক্ত পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন আমার সংবাদকে জানান, দেশে যত গ্রাম আছে তত গ্রামেই সরকার বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দিয়েছে। বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে শতভাগ বিদ্যুতের দেশে রূপান্তরিত হওয়া আমাদের সবচেয়ে বড় সফলতা। 

গত বছরের ডিসেম্বরে শতভাগ বিদ্যুতায়নের কথা থাকলেও আমরা নভেম্বরেই এর সফলতা অর্জন করেছি। সবার জন্য বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করতে ‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ এ স্লোগানকে সামনে রেখে ২৪ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট ও ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। 

২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ১৮ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে যুক্ত হয়েছে। ফলে বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ক্যাপটিভসহ ২৪ হাজার ৯৮২ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে এবং বিদ্যুতের সুবিধাভোগী জনসংখ্যা ৪৭ থেকে ৯৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তাছাড়া ৬৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের দরপত্র প্রক্রিয়াধীন। 

অদূর ভবিষ্যতে আরও ১৫ হাজার ১৯ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৩ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সংরক্ষণ ও মেরামত বৃদ্ধির মাধ্যমে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশে শতভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সহজ ব্যাপার ছিল না। অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে সরকারকে।

Link copied!