জুলাই ১৯, ২০২২, ০১:৩৩ এএম
বিশাল বাজেট ঘাটতি মেটাতে আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রে পুঁজিবাজারে কারসাজিতে জড়িতদের শাস্তির শর্ত জুড়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি-না এমন প্রশ্নে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
কারসাজি চক্র বাজার অস্থির করে তুলতে পারে এমন শঙ্কায় শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নেয়ার হিড়িক পড়ে যায়। এক পর্যায়ে ক্রেতার তুলনায় বিক্রেতার সংখ্যা বেড়ে যায়।
ক্রেতা সংকটের মধ্যেই বড় দরপতনে পড়ে পুঁজিবাজার। একই সাথে দেশে জ্বালানি সংকটের কারণে লোডশেডিংসহ সরকারের নানামুখী উদ্যোগের কারণে উৎপাদন ও বিপণন খাতে প্রভাব পড়ার ভীতি ছড়িয়ে পড়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে।
এরফলে দেশের উভয় পুঁজিবাজারে সবগুলো সূচকের পতনের পাশাপাশি কমে যায় অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম। লেনদেনের পরিমাণ কম হওয়ার সাথে কমে বাজার মূলধন। এর মধ্য দিয়ে ঈদের পর লেনদেন হওয়া পাঁচ কর্মদিবসই পতনের বৃত্তে থাকল দেশের পুঁজিবাজার।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজার এখন নিয়ন্ত্রণ করছে কারসাজি চক্র। এ কারসাজি চক্রের হাত থেকে বাজার রক্ষা করতে আইএমএফ সরকারকে সুপারিশ করেছে। আর তাতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বড় ধরনের আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। আরও দরপতন হবে এমন ভয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই তারা শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিচ্ছেন।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘আইএমএফের শর্ত ছাড়াও বেশ কিছু বিষয় রয়েছে। এর মধ্যে জ্বালানি সংকটে বিদ্যুৎ প্লান্ট বন্ধ রাখায় উৎপাদনে প্রভাব পড়ার শঙ্কা কাজ করছে। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান ও ডলারের বাজারের অস্থিরতাসহ দেশের সার্বিক অর্থনীতি নিয়ে বিনিয়োগকারিদের মধ্যে হতাশা কাজ করছে। ফলস্বরূপ পতনের বৃত্ত থেকে বেড় হতে পারছে না দেশের পুঁজিবাজার।’
গত রোববার আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলিম উল্লাহর নেতৃত্বে মন্ত্রণালয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট সহায়তা দিতে দেশের পুঁজিবাজার কারসাজিতে জড়িতদের শাস্তি চেয়েছে আইএমএফ। এছাড়াও খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে আইএমএফ পরামর্শ দিয়েছে। ব্যাংক খাতের তদারকি শক্তিশালী করার পাশাপাশি কর্পোরেট সুশাসন উন্নত করার তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি।
ব্যাংক খাতে বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরতে আইনি সংস্কারের পরামর্শও দিয়েছে আইএমএফ। বৈঠকে খেলাপি ঋণের হিসাব পদ্ধতি সংশোধন ও খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করার বিষয়টি নিয়ে কথা তুলেছে আইএমএফ। এসব কিছুই পুঁজিবাজারে প্রভাব বিস্তার করতে পারে বলে মত বিশ্লেষকদের।
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সোমবার সপ্তাহের দ্বিতীয় কার্যদিবসে পুঁজিবাজারে ভয়াবহ দরপতন হয়েছে। দেশের প্রধান শেয়ারবাজারে ২৭৫টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দিনের সর্বনিম্ন দামে চলে গেছে। লেনদেনের প্রায় সময়জুড়ে এসব প্রতিষ্ঠানের ক্রয় আদেশের ঘর শূন্য পড়ে থাকে। পৌনে তিনশ প্রতিষ্ঠান ক্রেতা সংকটে পড়ে বড় পতন হয়েছে সবকটি মূল্য সূচকের।
ফলস্বরূপ ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক প্রায় একশ পয়েন্ট পড়ে গেছে। ডিএসইর মতো মূল্যসূচকের বড় পতন হয়েছে দেশের অন্য শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই)। বাজারটিতে লেনদেনে অংশ নেয়া বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমেছে।
এর মাধ্যমে ঈদের পর লেনদেন হওয়া পাঁচ কার্যদিবসেই শেয়ারবাজারে দরপতন হলো। ঈদের আগেও পতনের মধ্যে ছিল শেয়ারবাজার। ঈদের আগে শেষ পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তিন কার্যদিবসই পতন দিয়ে পার হয়। ফলে শেষ ১০ কার্যদিবসের মধ্যে আট কার্যদিবসই পতনের মধ্যে থাকলো শেয়ারবাজার।
ডিএসইর সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া ?যুদ্ধের প্রভাব, মুদ্রাবাজারে অস্থিরতায় বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিচ্ছেন। পাশাপাশি আইএমএফ পুঁজিবাজারে কারসাজি সাথে জড়িতদের বিচার চেয়েছে। এসবের কারণে আজ বড় দরপতন হয়েছে।
বাজার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গতকাল শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমে যায়। লেনদেনের সময় গড়ানোর সাথে সাথে বাড়তে থাকে পতনের মাত্রা। প্রথম ঘণ্টার লেনদেন শেষ হওয়ার আগেই প্রায় একশ প্রতিষ্ঠানের ক্রয়াদেশের ঘর শূন্য হয়ে পড়ে। এ পর্যায়ে দিনের সর্বনিম্ন দামে একের পর এক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রির আদেশ দিতে থাকেন বিনিয়োগকারীরা।
কিন্তু এরপরও বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী তাদের কাছে থাকা শেয়ার বিক্রি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ক্রেতা সংকট দেখা দেয়ায় দিনের লেনদেন শেষে মাত্র ১২টি প্রতিষ্ঠান দাম বাড়ার তালিকায় নাম লেখাতে পেরেছে। বিপরীতে দাম কমেছে ৩৫৮টির এবং ১২টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
দাম কমার তালিকায় স্থান হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ২৭৫টির শেয়ার ও ইউনিট দিনের সর্বনিম্ন দামে লেনদেন হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ শেয়ার দিনের সর্বনিম্ন দামে বিক্রির আদেশ আশায় লেনদেনের বেশির ভাগ সময় ক্রয় আদেশের ঘর শূন্য পড়ে থাকে।
এতে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৮৭ পয়েন্ট কমে ছয় হাজার ২১৬ পয়েন্টে নেমে গেছে। অন্য দুই সূচকের মধ্যে বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক ৩১ পয়েন্ট কমে দুই হাজার ২৩৫ পয়েন্টে অবস্থান করছে।
আর ডিএসই শরিয়াহ আগের দিনের তুলনায় ১৬ পয়েন্ট কমে এক হাজার ৩৫৯ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। মূল্য সূচক কমার পাশাপাশি বাজারটিতে লেনদেনের পরিমাণও কমেছে। দিনভর ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৫১৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয় ৫৯৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। সে হিসেবে লেনদেন কমেছে ৭৮ কোটি ২০ লাখ টাকা। ডিএসইতে টাকার অঙ্কে বেশি লেনদেন হয়েছে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার।
কোম্পানিটির ৩৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছ। দ্বিতীয় স্থানে থাকা বেক্সিমকোর ২৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। ১৯ কোটি ৩৪ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ফরচুন সুজ। এ ছাড়া ডিএসইতে লেনদেনের দিক থেকে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে— গ্রামীণফোন, ওরিয়ন ইনফিউশন, কেডিএস, তিতাস গ্যাস, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো, ওরিয়ন ফার্মা এবং এইচ আর টেক্সটাইল।
অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক মূল্য সূচক সিএএসপিআই কমেছে ২৪২ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ১৩ কোটি ৬১ টাকা। লেনদেন অংশ নেয়া ২৯৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৭টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ২৬০টির এবং ২০টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।