জুলাই ২১, ২০২২, ১২:৫৯ এএম
স্বপ্নের পদ্মা সেতু বহুলাংশে স্বস্তি আনলেও টোল আদায় পদ্ধতির কারণে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এনালগ পদ্ধতির টোল আদায়ের ফলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক (ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে) ও পদ্মা সেতুর উত্তর এবং দক্ষিণ পাড়ে দীর্ঘ যানজট লেগেই থাকছে।
এর ফলে কাঙ্ক্ষিত সময়ের চেয়ে অন্তত দেড় ঘণ্টা দেরিতে গন্তব্যে পৌঁছাতে হচ্ছে পদ্মা সেতু ব্যবহারকারীদের। যা নিয়ে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করছেন সাধারণ যাত্রীরা। অতি দ্রুত ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা চালুসহ আপাতত লেন বিভাজন করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ২৫ জুন যান চলাচলের জন্য পদ্মা বহুমুখী সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সক্ষমতা ও সাহসের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সেতুটি দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন।
দুই স্তরবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির ওপরের স্তরে চার লেনের সড়কপথ ও নিচের স্তরটিতে একটি একক রেলপথ রয়েছে। পানি প্রবাহের বিবেচনায় বিশ্বে আমাজন নদীর পরই এর অবস্থান। মাটির ১২০ থেকে ১২৭ মিটার গভীরে গিয়ে পাইল বসানো হয়েছে এই সেতুতে।
পৃথিবীর অন্য কোনো সেতু তৈরিতে এত গভীরে গিয়ে পাইল বসাতে হয়নি। যা পৃথিবীতে একটি অনন্য রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে সারা দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন মাইলফলক সৃষ্টি হয়েছে।
পদ্মা সেতুর কারণে ইতোমধ্যে বদলে যেতে শুরু করেছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নতুন গতি পেয়েছে। কিন্তু টোল আদায়ে ধীরগতির কারণে যাতায়াতকারীদের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। স্বপ্নের সেতু পার হতে এমন যানজট অস্বস্তি আনছে জনমনে।
নিয়মিত পদ্মা সেতু ব্যবহার করেন শরীয়তপুরের শাহজালাল শামীম। তিনি জানান, ধলেশ্বরী ব্রিজের আগে মহাসড়কে টোল দিতে গিয়ে অন্তত আধা ঘণ্টা সময় লাগছে। পদ্মা সেতুর উভয় পাড়েই টোল দিতে একই অবস্থা। টোল হাতে আদায় করা তো আছেই, সাথে চরম বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। টোলপ্লাজার কাছে আসার পর গাড়িগুলোর মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা শুরু হয়। যে যেভাবে পারছে, লেনগুলোতে গাড়ির মাথা ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এতে করে প্রতিনিয়ত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে।
বরিশালগামী একাধিক যাত্রী জানান, ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত তিন জায়গায় টোল নেয়া হচ্ছে। ধলেশ্বরী ব্রিজ আর ভাঙ্গায় মহাসড়কের টোল আর সেতুতে উঠতে টোল। টোলপ্লাজার আগে যানজট লেগেই থাকে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পদ্মা সেতু এবং ঢাকা-ভাঙ্গা মহাসড়ক টোল আদায় পদ্ধতি শুরুর দিন থেকেই ডিজিটাল হওয়ায় উচিত ছিল। যত দ্রুত সম্ভব সিস্টেমে পরিবর্তন আনা দরকার। আপাতত টোলপ্লাজায় লেনভিত্তিক পদ্ধতি চালু করা দরকার। কোন লেনে কোন গাড়ি টোল দেবে তা নির্ধারণ করতে হবে। এতে টোল আদায়ের গতি বাড়বে এবং টোল দিতে গিয়ে গাড়িচালকদের বিশৃঙ্খলা কমে আসবে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েট অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘যত বেশি জায়গায় টোল নিতে যাবে, তত যানজট বাড়বে। ইলেকট্রনিক্স টোল কালেকশন সিস্টেমের বিকল্প কিছু নেই, এটি যত দ্রুত করা যাবে, ততই ভালো।
তবে এটিও হয়তো দ্রুত করা যাবে, বড় সমস্যা হচ্ছে— আমাদের যানবাহন কিন্তু সেভাবে এখনো প্রস্তুত হয়নি। এ ঘাটতি তৈরি হয়েছে সেতু বিভাগ ও সড়ক মহাসড়ক বিভাগের সমন্বয়হীনতার কারণে। তাদের প্রচার-প্রচারণাও ঘাটতি হয়েছিল। কারণ পদ্মা সেতু ও মহাসড়কে যে ইলেট্রনিক্স টোল পদ্ধতি দরকার হবে, সেটি আগেই জানা ছিল। বিশেষ করে এক্সপ্রেসওয়ে তো দুই বছর আগেই চালু হয়েছে।
দুই বছরে তো অন্তত প্রচার-প্রচারণা এবং এক্সপ্রেসওয়ে টোল ইলেকট্রনিক্স সিস্টেমে আনা যেত, সেটি কেন করা হলো না।’
সাময়িক সমাধানের পরামর্শ হিসেবে অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘ভোগান্তি কমাতে আপাতত লেনভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস করতে হবে। যেহেতু এ কয়দিনে ভালো অভিজ্ঞতা টোল আদায়কারী সংস্থার হয়েছে, কী পরিমাণ গাড়ি যাতায়াত করছে, কোন শ্রেণির গাড়ি বেশি যাচ্ছে— এই সার্ভের ওপর ভিত্তি করে চাহিদামাফিক লেন বিভাজন করা উচিত। কোন লেনে কোন গাড়ি যাবে। যে ধরনের যানবাহন বেশি, তাদের বেশি লেন দিতে হবে।’
সেতু বিভাগ সূত্র মতে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক (ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে) এবং পদ্মা সেতুর উত্তর ও দক্ষিণ পাড় টোলপ্লাজা ডিজিটাল পদ্ধতিতে আনতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। নতুন করে যেসব টোলপ্লাজা বসানো হবে, সেগুলো ডিজিটাল সিস্টেমে নেয়া হবে। পদ্মা সেতুর টোল আদায়ের দায়িত্বে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনের দুটি প্রতিষ্ঠান।
এই দুই প্রতিষ্ঠান হচ্ছে— কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে কর্পোরেশন (কেইসি) ও চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (এমবিইসি)। এর মধ্যে কেইসি সার্ভিস এরিয়া ও অ্যাপ্রোচ রোড, টোল কালেকশন ও অপারেশন, ইন্টেলিজেন্স ট্রাফিক সিস্টেম (আইটিএস) স্থাপন এবং ট্রাফিক নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করছে। অন্য দিকে এমবিইসি মেইন ব্রিজ (টোল মনিটরিং সিস্টেম ও অ্যানালাইসিস ছাড়া) ও আরটিডব্লিউ বিষয়টি দেখাশোনা করবে।
গত ১ জুলাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক (ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে) টোল আদায় শুরু হয়েছে। ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার সড়কের ছয়টি জায়গায় টোল আদায়ের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। বর্তমানে কেরানীগঞ্জের ধলেশ্বরী ও ফরিদপুরের ভাঙ্গা অংশে আদায় করা হচ্ছে।
মহাসড়কের টোলও আদায় করছে কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে কর্পোরেশন (কেইসি)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২০ সালের মার্চ মাসে ৫৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন করেন। ১১ হাজার তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই সড়কটির প্রতি কিলোমিটারের ব্যয় বিবেচনায় এটি দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সড়ক।