জুলাই ২৪, ২০২২, ১২:৩৫ এএম
ধর্ষণ-হত্যা-ছিনতাই-রাহাজানিসহ বহুমাত্রিক অপরাধের মূলেই মাদক। বিভিন্ন সময় পরিচালিত মাদকবিরোধী অভিযানে ভয়াবহ মাদকের চালান কিংবা বাহকরা গ্রেপ্তার হলেও মূলহোতা ও মাদক কারবারির পৃষ্ঠপোষকরা নাগালের বাইরে থাকায় থামছে না মাদকের বিস্তার।
এরই মধ্যে মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন-বিস্তার রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চলমান অভিযানেও থেমে নেই মাদক বাণিজ্য।
২০১৮ সালের ৪ মে থেকে দেশব্যাপী র্যাবের মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানেও দমেনি মাদক চালান। ইয়াবার পাশাপাশি বর্তমানে মাদকাসক্তদের কাছে জনপ্রিয় মাদক ক্রিস্টাল মেথ বা আইস দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে
ছড়িয়ে পড়েছে। প্রায়ই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে জব্দ হচ্ছে আইস।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তুলনামূলক নতুন এ মাদক ঠেকানোকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ মনে করছেন। দেশে ২০১৯ সালে শুরুর দিকে বারিধারা ও মোহাম্মদপুরে জব্দ হয় আইসের বড় চালান। ইয়াবার পর আইসের প্রধান রুটে পরিণত হয়েছে কক্সবাজার। কক্সবাজার জেলায় আইসের প্রথম চালান ধরা পড়ে ২০২১ সালের ৩ মার্চ।
২০২১ সালে সারা দেশে বিভিন্ন সংস্থা-বাহিনী জব্দ করে সাড়ে ৩৬ কেজি ৭৯৪ গ্রাম আইস। এর মধ্যে শুধু কক্সবাজারে ধরা পড়ে ২৩ কেজি ৮০২ গ্রাম এবং চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসেই মিয়ানমার থেকে পাচারের সময় উদ্ধার হয়েছে ৫০ কেজির বেশি আইস।
এরই মধ্যে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানী ও নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় অভিযান চালিয়ে গতকাল শনিবার ইয়াবা ও আইস সিন্ডিকেটের সাত সদস্যকে গ্রেপ্তারের খবর জানিয়েছে ডিএনসি। এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রায় ৫৪ লাখ টাকা মূল্যের ১১ হাজার ২০০ পিস ইয়াবা ও ২০০ গ্রাম আইস জব্দ করা হয়। বিএনসি জানায়, গ্রেপ্তারদের কেউ মুদি দোকানদার, ব্যবসায়ী, কেউ ইলেকট্রিশিয়ান, কেউবা বাসের সুপারভাইজার।
তবে এসব পেশার আড়ালে তাদের প্রত্যেকে মাদকদ্রব্য ইয়াবা নয়তো আইস কারবারে জড়িত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো কার্যালয়ের (উত্তর) উপ-পরিচালক (ডিডি) মো. রাশেদুজ্জামান জানান, বিভিন্ন পেশার আড়ালে টেকনাফ থেকে ইয়াবা ও আইস এনে ঢাকা ও ফতুল্লায় গড়ে ওঠা একটি মাদক সিন্ডিকেটের তথ্য পায় গোয়েন্দা দল। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় সিন্ডিকেটটিকে নজরদারিতে আনা হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক মো. জাফরুল্লাহ কাজলের নির্দেশনায়, ঢাকা মেট্রো. কার্যালয়ের (উত্তর) সহকারী পরিচালক মো. মেহেদী হাসানের নেতৃত্বে উত্তরা, ধানমন্ডি, গুলশান, তেজগাঁও ও রমনা সার্কেলের সমন্বয়ে গঠিত টিম শুক্রবার ও শনিবার ঢাকা ও ফতুল্লায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে।
অভিযানকালে হাতিরঝিল থানার নয়াটোলা পাগলা মাজার এলাকা থেকে এক হাজার পিস ইয়াবা ও ২০০ গ্রাম মিথাইল অ্যামফিটামিনযুক্ত ক্রিস্টালম্যাথসহ (আইস) রফিক উল্লাহ (২২) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি পেশায় মুদি দোকানদার। তার বাড়ি কক্সবাজারের টেকনাফে।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার বেগুনবাড়ি থেকে দুই হাজার পিস ইয়াবাসহ সরওয়ার কামালকে (২৩) গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি পেশায় শ্রমিক। তার বাড়িও কক্সবাজারের টেকনাফে। একই এলাকা থেকে এক হাজার পিস ইয়াবাসহ ইমরান হোসেনকে (৩০) গ্রেপ্তার করা হয়। পেশায় ব্যবসায়ী ইমরানের বাড়ি বরিশালে।
মহসিন (৩২) নামক এক ব্যক্তিকে চার হাজার পিস ইয়াবা ও ইয়াবা বিক্রয়ের তিন লাখ টাকাসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। টি-শার্ট বিক্রির আড়ালে ইয়াবা কারবারে জড়িত নারায়ণগঞ্জের এ বাসিন্দা। মো. মিরাজ শেখকে (৩৩) দুই হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি অটো রিকশায় যাত্রী পরিবহনের আড়ালে ইয়াবা কারবারে জড়িত। তার বাড়ি রাজবাড়ীতে।
প্রথম গ্রেপ্তার রফিক উল্লাহকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে রমনা সার্কেলের বিশেষ টিম গতকাল শনিবার সকালে অভিযান চালিয়ে ঢাকার হাতিরঝিল থানা এলাকা থেকে প্রান্ত ভট্টাচার্য (২৫) ও মামুনুর রশীদ মিম (২১) নামে দুজনকে এক হাজার ২০০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। প্রান্ত একটি পরিবহন কোম্পানির সুপারভাইজার। তার বাড়ি নাটোরে। মামুনুর রশীদের বাড়িও নাটোরে। তিনি পেশায় ইলেকট্রিশিয়ান। ইতোমধ্যে রফিক উল্লাহ (২২) ও ইমরান হোসেনকে (৩০) আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। গ্রেপ্তার অন্যদের বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হবে বলে জানিয়েছে ডিএনসি।
চলতি বছরের ২৬ জুন ‘মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস’ উপলক্ষে আলোচনা সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, দেশের যুবসমাজ ও তাদের মেধা টিকিয়ে রাখতে গুরুত্বসহকারে ব্যাপকভাবে ডোপ টেস্ট চালু করার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে অধিক কার্যকর এই ডোপ টেস্টের ব্যবস্থা করা হবে।
ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে ডোপ টেস্ট করে অনেক মাদকাসক্ত কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুতের ঘটনা ঘটেছে। তিনি আরও বলেন, ‘দেশকে মাদকমুক্ত করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতিকে সামনে রেখে আমরা কাজ করছি। পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, কোস্টগার্ড, আনসার ও ভিডিপির পাশাপাশি নোডাল এজেন্সি হিসেবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অধিদপ্তরের সাংগঠনিক কাঠামো পরিবর্তন ও জনবল বৃদ্ধি করা হয়েছে।
মাদক অপরাধীদের কঠোর আইনের শাস্তির আওতায় আনার জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ এবং অন্যান্য বিধিমালা যুগোপযোগী করে সংশোধনসহ অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০২২ প্রণয়ন করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের অফিসগুলোতে লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়ানো হয়েছে। চারটি বিভাগীয় শহরে টেস্টিং ল্যাব নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।’
দেশের সচেতন-বিজ্ঞজনের দাবি, মাদকপাচার ও সেবন বন্ধ করতে মাদকের চাহিদা কমানোর পাশাপাশি জোগানও হ্রাস করতে হবে। নিতে হবে হতাশা-বিষাদ-অবসাদ-বিশৃঙ্খলমুক্ত জীবনযাপনের মাধ্যমে মাদকের বিস্তার রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
এছাড়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের (১৯৯০) ধারাগুলো সময়োপযোগী করে এর প্রয়োগ ও অনমনীয় বাস্তবায়ন, মাদক ব্যবহারের ধ্বংসাত্মক প্রভাব সম্পর্কে গণসচেতনতা তৈরি, সীমান্ত এলাকা সুরক্ষিত করে মাদক চোরাচালান কমানো এবং মাদকাসক্তদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ক্রীড়ায় সম্পৃক্তকরণসহ যথাযথ পুনর্বাসন করা গেলে মাদকের বেপরোয়া আগ্রাসন অনেকটা রোধ করা সম্ভব।