জুলাই ৩০, ২০২২, ০১:০৫ এএম
দেশের দুই হাজার ৮৩৫ কিলোমিটার রেলপথে লেভেল ক্রসিং বা রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা তিন হাজার ৩৯৮টি। এর মধ্যে এক হাজার ৩৬১টিই অনুমোদনহীন। অনুমোদিত ও অনুমোদনহীন এসব রেলক্রসিংয়ের মধ্যে আবার দুই হাজার ১৭০টিই অরক্ষিত। অর্থাৎ এগুলোতে কোনো গেট নেই, নেই কোনো গেটম্যান।
আবার যেগুলোতে গেট ও গেটম্যান রয়েছে সেগুলোতেও ঘটছে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। রেলক্রসিংগুলোতে অজস্র প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে গেটম্যানদের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতায়। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানি রোধে ভ্রুক্ষেপই নেই রেল কর্তৃপক্ষের। যে কারণে গেটের দায়িত্বে থেকেও নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থ হচ্ছেন গ্যাটম্যানরা।
গত রোববারও গাজীপুরের শ্রীপুর ক্রসিংয়ে যাত্রীভর্তি বাসে চলন্ত ট্রেনের ধাক্কায় চারজনের মৃত্যু হয়। আহত হয় কমপক্ষে ২০ জন। অথচ ডিউটি থাকলেও সেসময় গেটম্যান ছিল না। দায়িত্বের অবহেলা ওই ঘটনায়ও প্রমাণিত।
এরপরও গেটম্যানদের দায়িত্ব অবহেলায় শাস্তি কিংবা দায়িত্ব পালনে অনিয়মের বিরুদ্ধে কড়াকড়ি কোনো বার্তা না দেয়ায় ফের গেটম্যানের অবহেলায় গতকাল চট্টগ্রামের মিরসরাই থানাধীন বড় তাকিয়া স্টেশন এলাকায় ঘটে গেছে বড় ধরনের রেল দুর্ঘটনা।
অথচ এ ঘটনায়ও রেল কর্তৃপক্ষ দুষছে দুর্ঘটনাকবলিত সেই মাইক্রোবাস চালককেই। গাজীপুরের দুর্ঘটনার পাঁচদিন পর গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজের সময় খৈয়াছড়া ঝরনা ঘুরে বাড়ি ফেরার পথে মহানগর প্রভাতী ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসে থাকা ১৪ জনের মধ্যে ১২ জনেরই মৃত্যু হয়।
সাম্প্রতিকালে এটি সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর রেল দুর্ঘটনা। নিহতদের বাড়ি হাটহাজারী উপজেলার যুগিরহাটি এলাকায় বলে জানিয়েছে হাটহাজারী থানা পুলিশ।দুর্ঘটনার কারণে জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হলে দুর্ঘটনাস্থলে থাকা মিরসরাই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মিনহাজুর
রহমান আমার সংবাদকে বলেন, দুর্ঘটনাটি ঘটে দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে। এ সময় ক্রসিংয়ের নিরাপত্তা দায়িত্বে থাকা গেটম্যান জুমার নামাজে ছিলেন। যে কারণে ক্রসিং উন্মুক্ত ছিল। বার ছিল না। গেটম্যান এবং বার না থাকায় মাইক্রোবাসটি রেল সড়ক অতিক্রম করতে গিয়েই এ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই সড়কটি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ-এলজিইডির। তিনি বলেন, এলজিইডি বা যেকোনো সংস্থাই রেলপথ সংশ্লিষ্ট সড়ক নির্মাণ করলে, নির্মাণ শেষে রেল কর্তৃপক্ষকে জানাবে।
রেল কর্তৃপক্ষ সেখানে নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করবে। এ গেটেও নিরাপত্তা (গেটম্যান-বার) ব্যবস্থা ছিল। তবে দুপুর ১টা ৪০ মিনিটের দিকে দুর্ঘটনার সময় গেটম্যান জুমার নামাজে ছিলেন।
তবে এ ক্ষেত্রেও প্রশ্ন থেকেই যায়, রেলের শিডিউল সম্পর্কে জেনেও গেটম্যান কেন তার অনুপস্থিতিতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে যাননি?
ইউএনও আমার সংবাদকে জানিয়েছেন, নিহতদের সবাই হাটহাজারী উপজেলার বাসিন্দা। এ ঘটনায় দুজনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে এবং কেবল একজন আরোহী অক্ষত রয়েছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এ ঘটনায় আমার সংবাদকে নিহতদের পরিচয় জানিয়েছেন হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহিদুল আলম।
তিনি জানান, দুর্ঘটনায় মাইক্রোবাস চালকের নাম গোলাম মোস্তফা নিরু (২৬), শিক্ষক ওয়াহিদুল আলম জিসান (২৩), শিক্ষক জিয়াউল হক সজীব (২২), শিক্ষক মোস্তফা মাসুদ রাকিব (১৯), শিক্ষক রিদুয়ান চৌ (২২) নিহত হয়েছেন।
এছাড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে মোহাম্মদ হাসান (এসএসসি পরীক্ষার্থী), মোসহাব আহমেদ হিসাম (১৬), মাহিম, সাগর, ইকবাল হোসেন মারুফ, আয়াতুল ইসলাম নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন গাড়ির হেলপার তৌহিদ ইবনে শাওন (২০),
তাসমির হাসান (এসএসসি পরীক্ষার্থী), সৈকত, ইমন (১৯), তানভীর হাসান হূদয় ও সাজ্জাদ। তারা সবাই হাটহাজারী যুগিরহাটি কলেজ রোডের শেখ মার্কেটের আরঅ্যান্ডজে প্রাইভেট কেয়ার কোচিং সেন্টারের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ছিলেন। তাদের মধ্যে গাড়ির হেলপার অন্য উপজেলার ছিল। বাকি সবাই হাটহাজারী উপজেলার বাসিন্দা বলে জানিয়েছেন ইউএনও শাহিদুল আলম।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, দুর্ঘটনার সময় গেটম্যান ছিলেন না। তিনি সে সময় জুমার নামাজে ছিলেন। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের বিপরীতে বক্তব্য দিচ্ছে রেল কর্তৃপক্ষ। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, মাইক্রোবাসটি যখন রেললাইনের কাছে পৌঁছায় তখন গেট ফেলা ছিল। গেটম্যানের বরাত দিয়ে এ তথ্য দেন তিনি।
তিনি বলেন, খৈয়াছড়া এলাকায় রেলওয়ের ওপর দিয়ে একটি সড়কপথ গেছে। সেখানে রেলওয়ের নিযুক্ত গেটম্যানও আছে। দুর্ঘটনার পরপর গেটকিপারের সাথে কথা বলেছি।
গেটকিপার আমাকে জানিয়েছেন, ট্রেন আসার আগেই গেট ফেলা ছিল। কিন্তু মাইক্রোবাসের চালক গেটবারটি জোর করে তুলে রেললাইনে প্রবেশ করেন। এরপর মহানগর প্রভাতী ট্রেন মাইক্রোবাসটিকে ধাক্কা দেয়। আমরা ঘটনাটি তদন্ত করে দেখছি।
পূর্ব রেলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা আনসার আলী বলেন, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী ওই লেভেল ক্রসিং পার হওয়ার মুখে খৈয়াছড়াগামী একটি পর্যটকবাহী মাইক্রোবাস লাইনে উঠে পড়ে। সংঘর্ষের পর মাইক্রোবাসটি ট্রেনের ইঞ্জিনের সাথে আটকে যায়। ওই অবস্থায় মাইক্রোবাসটিকে বেশ খানিকটা পথ ছেঁচড়ে নিয়ে থামে ট্রেন।
আনসার আলী আরও বলেন, ট্রেন আসায় গেটম্যান সাদ্দাম বাঁশ ফেলেছিলেন। কিন্তু মাইক্রোবাসটি বাঁশ ঠেলে ক্রসিংয়ে উঠে পড়ে। তবে এ ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যায় সেই রেল ক্রসিং এলাকা থেকে গেটম্যান সাদ্দাম হোসেনকে আটক করেছে রেলওয়ে পুলিশ।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশের ওসি নাজিম উদ্দিন এ তথ্য নিশ্চিত করেন। চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশ সুপার হাসান চৌধুরী বলেন, গেটম্যান সাদ্দাম পুলিশ হেফাজতে রয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
গতকালের এই দুর্ঘটনার পর চট্টগ্রামমুখী লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মহানগর প্রভাতীর যাত্রীরাও ঘটনাস্থলে আটকা পড়েন। এ ছাড়া চট্টগ্রামমুখী বেশ কয়েকটি ট্রেন বিভিন্ন স্টেশনে আটকা পড়ে।
তবে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী লাইন খোলা ছিল বলে রেল কর্মকর্তারা জানান। ঘটনা তদন্তে পূর্ব রেলের কর্মকর্তা আনসার আলীকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
কমিটিকে দ্রুততম সময়ে কারণ অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তবে এসব ঘটনায় তদন্ত হলেও কার্যকর কোনো সমাধান হচ্ছে না। রেল দুর্ঘটনায় নিহতের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জিআরপি থানায় অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়।
রেলওয়ে আইন অনুযায়ী, দুর্ঘটনার পুরো দায় সাধারণ মানুষের ওপর পড়ায় ক্ষতিপূরণও পাওয়া যায় না।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হকের মতে, ‘যেহেতু নিরাপত্তার বিষয়টি অবজ্ঞা করা হয়েছে, সেহেতু সমাজ সেই সুফল পাবে না। টেকসই উন্নয়নের দর্শন না মানায় দুর্ঘটনা কমবে না। রেলের তিন হাজার কিলোমিটার রাস্তায় বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে প্রায় প্রতি কিলোমিটারে একটি করে লেভেল ক্রসিং আছে। যার ৮৫ শতাংশই অরক্ষিত ও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।’
রেলের কর্তৃপক্ষের অনেকেই বিভিন্ন সময়ে বলেন, এসব দুর্ঘটনায় রেলকে দায়ী করা ঠিক হবে না। কারণ রেল তার নিজস্ব পথে চলে। কখনো সড়কে ওঠে গাড়ি বা মানুষকে চাপা দিয়েছে এমন নয়। বরং সড়কের গাড়ি রেললাইনে ওঠে আসাতেই দুর্ঘটনা ঘটছে। এ প্রেক্ষাপটে সারা দেশে রেললাইনকে তো আর কাঁটাতারের বেড়ার আওতায় আনা সম্ভব নয়। আর অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের দায়িত্বও রেল কর্তৃপক্ষ নেবে না।