জুলাই ৩০, ২০২২, ০১:১৮ এএম
ক্রমশ বাড়ছে নারীর প্রতি ভার্চুয়াল যৌন নিপীড়ন। প্রযুক্তির অপব্যবহারে নারীর প্রতি এ সহিংসতা রীতিমতো বিষফোঁড়ায় রূপ নিচ্ছে। প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয়; এরপর ধীরে ধীরে সে সম্পর্ক গড়ায় প্রেম কিংবা পরকীয়া অবধি।
সেখান থেকেই কৌশলে আপত্তিকর ছবি, ভিডিও ধারণ, গোপন রেকর্ডিং অথবা প্রযুক্তির কারসাজিতে চাপ প্রয়োগ করা হয় অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে। দাবি করা হয় মোটা অংকের টাকাও। এসব দাবি মানতে নারাজ হলেই শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অশ্লীল ভিডিও বা স্থিরিচিত্র ভাইরাল করার হুমকি।
অনৈতিক যৌন সম্পর্ক স্থাপন, প্রতিশোধ প্রবণতা অথবা অর্থ-সম্পদ দাবির এই প্রক্রিয়া ক্ষেত্রবিশেষে হত্যা অবধি গড়ায়। আপত্তিকর ছবি প্রকাশের এই নতুন ধরনের নাম সেক্সটোরশন।
সমপ্রতি সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়স্ক প্রায় ৫৭ শতাংশ নারী বিভিন্নভাবে অনলাইন সেক্সচুয়াল অ্যাবিউজের শিকার। ভুক্তভোগী এসব নারীদের বেশির ভাগের যৌন হয়রানি, হ্যাকিং, সাইবার পর্নগ্রাফি ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
পারিবারিক পরিবেশ, শিক্ষাক্ষেত্র, কর্মক্ষেত্র কোনো অঙ্গনেই নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা থেমে নেই। ভার্চুয়াল এ সহিংসতায় বিষণ্নতার শিকার হয়ে অনেকেই আবার আত্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্তের পথে হেঁটেছেন।
গবেষণায় উঠে এসেছে, সাইবার স্পেসে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৬২.৩৪ শতাংশ নিপীড়নকারীর বিরুদ্ধে মামলার আশ্রয় নিয়েছেন। ভুক্তভোগীদের ৪.৫৫ শতাংশ সাধারণভাবে সংশ্লিষ্ট থানায় ডায়েরি করেছেন।
নিপীড়ন পরবর্তী ভুক্তভোগীর পদক্ষেপ সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি এমন ঘটনা ৩.২৫ শতাংশ। তবে যৌন নিপীড়ন পরবর্তী সময়ে ভয়, লজ্জা, মানসিক চাপ ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অভিযোগ করেন না— এদের সংখ্যাই বেশি।
এছাড়া ভুক্তভোগী ও অপরাধীর মধ্যকার বিদ্যমান সম্পর্ক বিবেচনায় দেখা গেছে, ৩৫.৭১ শতাংশ ভুক্তভোগীর পূর্বপরিচিত। এছাড়া প্রায় ৩৩.৭৭ শতাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী ও অপরাধীর মধ্যে প্রেমঘটিত সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল।
অপরদিকে অপরিচিত নিপীড়নকারীদের দ্বারা আক্রান্ত ভুক্তভোগীর সংখ্যা ১৪.২৯ শতাংশ। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (২০১৮০ ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন (২০১২) প্রণয়ন করে সরকার।
তবে গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৬৩ শতাংশ ভুক্তভোগী এ আইন সম্পর্কে ধারণা রাখেন না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সামাজিক অবক্ষয়, ধর্মীয় অনুশাসন পালনে অনীহা, পর্নোগ্রাফির ছড়াছড়ি, পশ্চিমা সংস্কৃতির চর্চা, ভিকটিম ব্লেমিং কালচার, মামলার দীর্ঘসূত্রতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও ইন্টারনেটে কাটাতারবিহীন জগতে প্রতিনিয়ত যুক্ত হতে থাকা নতুন সব অবয়বের ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারায় অনলাইনভিত্তিক এমন যৌন সহিংসতা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ২৬ জুলাই ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রথমে প্রেম, তারপর কৌশলে আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ধারণ এবং পরে তা ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে আব্দুল আহাদ নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ।
গত ৬ জুলাই নোয়াখালীর সদরে সৌদি প্রবাসীর স্ত্রীকে ধর্ষণের পর ভিডিও ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে কালাম ওরফে কালা মিয়া (৩০) নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
গত ১২ জুলাই অনলাইনে চাকরির চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে নারী চাকরি প্রার্থীদের শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক আমির হামজাকে রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে গ্রেপ্তার করে র?্যাব-১ এর একটি বিশেষ ইউনিট।
এদিকে গত ২১ জুলাই নাটোরে এক নারীর ছবি এডিট করে অশ্লীলভাবে উপস্থাপন, চাঁদা দাবি ও উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে শ্যাম দাস (৩৮) নামে এক ব্যক্তিকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালত। অনলাইন-ভিত্তিক নারীর প্রতি সহিংসতার এই মহামারি শুধু নোয়াখালী, ঢাকা বা নাটোরেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান ছড়াছড়িতে এমন সহিংসতার বিষফোঁড়া ছড়িয়ে গেছে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের আনাচে-কানাচে।
অনলাইনে এমন সহিসংতা নিয়ে অঞ্চলভেদে ভুক্তভোগীদের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, অনলাইন-ভিত্তিক সবচেয়ে বেশি যৌন সহিসংতা হয় ঢাকা বিভাগে, যার পরিমাণ ৩৩.১২ শতাংশ। সহিংসতায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চট্টগ্রামে এই সংখ্যা ১৬.৮৮ শতাংশ।
একই সাথে ১.৯৫ শতাংশ নিয়ে সর্বনিম্ন যৌন নিপীড়নের মাত্রা সিলেটে। ভার্চুয়াল জগতের এসব যৌন নিপীড়নমূলক অপরাধপ্রবণতার মাঝে সাইবার বুলিং, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, আত্মহত্যা, আত্মহত্যার চেষ্টা ও যৌনপণের মতো ঘটনাগুলোর পরিসংখ্যানমূলক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, হয়রানিমূলক যৌন নিপীড়নের সংখ্যা ৬২.৯৯ শতাংশ, যা সর্বপেক্ষা বেশি। অপরদিকে, ধর্ষণের শিকার এমন ভুক্তভোগীর সংখ্যা ১৫.৫৮ শতাংশ। এ ছাড়া ১৩.৬৪ শতাংশ যৌনপণ, ৩.২৪ শতাংশ আত্মহত্যা ও ১.৯৫ শতাংশ ভুক্তভোগী আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন।
এ প্রসঙ্গে সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী আমার সংবাদকে বলেন, আমাদের প্রত্যেকটি থানাতেই সাইবার সিকিউরিটি ইউনিট করা উচিত এবং প্রতিটি জেলাতেই সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল গঠন করা উচিত। শুধু ঢাকাতেই আমাদের সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল আছে। মানুষ যখন আইনের শাসন পাবে তখন তারা মামলা করবে।
একই সাথে অপরাধীদের মাঝেও মামলার ভোগান্তি ও শাস্তির ভয় থাকবে। কিন্তু দেশে প্রচুর সাইবার অপরাধ হওয়ার পরও তুলনামূলক মামলা এবং সাঁজা কম হচ্ছে। এটি স্বাভাবিকভাবে অপরাধীদের অপরাধ প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য ব্যাপক গণসচেতনতা দরকার।
একই সাথে কি ধরনের কাজ করলে সাইবার ঝুঁকি থেকে মুক্তি মিলবে সে বিষয়গুলো শিক্ষা কার্যক্রমেও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।’
তিনি বলেন, এ ধরনের সমস্যার ক্ষেত্রে কিছুটা বিচারহীনতার সংস্কৃতি কাজ করছে। একজন নারী যদি সাইবার জগতে কোনো হয়রানির শিকার হন তবে তার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরবর্তীতে আবার নতুন করে তার সাথে এ ধরনের অন্যায় হবে না এ আস্থাও রাষ্ট্রকে অর্জন করতে হবে।’
অনলাইনভিত্তিক নারীর প্রতি এমন সহিংসতা বৃদ্ধির কারণ এবং সমস্যা সমাধানে কি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে অপরাধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জিয়া রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমরা খুব দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। সোশ্যাল ট্রান্সফরমেশনের এই প্রক্রিয়া আমাদের পুরাতন সামাজিক মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও পারিবারিক বন্ধন ভেঙে দিয়েছে। গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে প্রযুক্তির সহজলভ্যতা কেড়ে নিয়েছে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক।
অপরদিকে সামাজিক পরিবর্তনের কারণে আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে অতিরিক্ত অর্থ আসায় জীবনযাত্রার পরিবর্তনের পাশাপাশি অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক, পরকীয়া, ফেসবুকে প্রেম-প্রণয় এমনকি ধর্ষণও হচ্ছে।
তিনি বলেন, সমাজে এখানো নারীকে ভোগের সামগ্রী মনে করা হয়। শিক্ষক ও পরিবারের ভূমিকা শিথিল হয়ে গেলে সমাজে এ ধরনের অপরাধ বাড়তে থাকে। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক চর্চা, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা এবং পারিবারিক অনুশাসনের ওপর জোর দিতে হবে।’
এ বিষয়ে সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের দেশে সাইবার ক্রাইম বৃদ্ধির মূল কারণ হচ্ছে— আইনি জটিলতায় অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে।
তারা যে অপরাধ করছে তার আলামত যথাযথভাবে আদালতে প্রমাণ না হওয়ায় এ জটিলতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তদন্তের দুর্বলতা এবং মামলার দীর্ঘসূত্রতাও সাইবার অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আইনি দুর্বলতায় দোষীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করলে না পারলে তারা জেলহাজত থেকে বের হয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে একই অপরাধ করবে।
সুতরাং অপরাধীদের অপরাধ যথাযথভাবে প্রমাণের ক্ষেত্রে পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং একই সাথে ডিজিটাল আলামত সংরক্ষণ করার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ জাতীয় পর্যায়ে নিতে হবে। আমাদের ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব শুধু সিআইডি, পিবিআই ও ডিবিতে আছে। অথচ আমাদের রেঞ্জ, মেট্রো ও জেলা পর্যায় সাইবার ক্রাইমের ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব নেই।’
তিনি বলেন, ‘ভুক্তভোগী যখন আইনের আশ্রয় নেন, তার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ প্রমাণের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার করা ফরেনসিক রিপোর্ট বা তদন্তের ওপর নির্ভর করতে হয়।
তবে আমাদের দেশে সাইবার অপরাধ শনাক্তের প্রক্রিয়া এখনো সোর্স ভিত্তিক। সাইবার জগতের অপরাধ মনিটরিং করার জন্য আমাদের পুলিশের তেমন কোনো যন্ত্রপাতি নেই। পুলিশ সোর্স ভিত্তিক বা সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু সফলতা পেলেও দেখা যায় ট্রায়ালের সময় তাদের সেই অস্তিত্ব আর থাকে না।
সুতরাং ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত থেকেই যায়। আমাদের দেশে ১০ থেকে ১২ হাজার সাইবার মামলার ভেতর হাতে গোনা মাত্র ১০ থেকে ১২টি মামলার শাস্তি নিশ্চিত হয়েছে। বাকিরা তদন্ত দুর্বলতায় নানাভাবে মুক্তি পাচ্ছে।
সমপ্রতি নড়াইলের সামপ্রদায়িক উস্কানির অভিযোগে যে ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল সে নবীকে গালি দিয়ে তার আইডি অকার্যকর করে ফেলেছিল। তাকে থানায় রাখা অবস্থায় পুলিশকে যে পাসওয়ার্ড দেয়া হয়েছিল তা দিয়ে পুলিশের কেউ আইডিতে লগইন করতে পারেনি। সুতরাং সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পর্যাপ্ত ডিভাইসের স্বল্পতা ও আইটি দক্ষতার ঘাটতি স্পষ্ট।
এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ তদন্তে যদি নিরপরাধ কেউ জেলহাজতে যায় তবে সাঁজা পরবর্তী সময়ে সমাজ তাকে আর স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে না। ফলে পরবর্তীতে তারা বড় ধরনের অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এ ধরনের সমস্যা নিরসনে সবার আগে অপরাধ শনাক্তের প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে হবে। তাহলে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করা সহজ হবে।’