আগস্ট ১১, ২০২২, ১২:৩৫ এএম
গত ছয় বছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন-বিপিসি ৪৬ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। সরকার নিয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৩৬ হাজার কোটি টাকা কোথায়? বলা হয়েছে, ওই টাকার মধ্যে ৩৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু হিসাব খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা কোনটা লাভ, কোনটা লোকসান বলছে সেটি জানা প্রয়োজন।
গতকাল বুধবার ধানমন্ডিতে সিপিডির কার্যালয়ে আয়োজিত সংলাপে সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এসব কথা বলেন।
একই সাথে বিপিসির পুরোনো হিসাবের খতিয়ান জনগণের সামনে প্রকাশের দাবি জানান তিনি। সিপিডি মনে করে, ত্রুটিপূর্ণ তথ্য-উপাত্তের ওপর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির আয়-ব্যয়ের হিসাব জনগণের সামনে আসা উচিত। ভোক্তার ওপর দায় না চাপিয়েও জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা যেত। ‘জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এখন এড়ানো যেত কি?’ শীর্ষক সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।
সংলাপে উপস্থিত ছিলেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন, বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক, যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ত্রুটিপূর্ণ তথ্য-উপাত্তের ওপর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আমি বিপিসির পুরাতন হিসাবের খতিয়ান জানতে চাই। গত ছয় বছরে বিপিসি ৪৬ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। যেখান থেকে সরকার নিয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৩৬ হাজার কোটি টাকা কোথায়? বলা হয়েছে, ওই টাকার মধ্যে ৩৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু সেই হিসাব খুঁজে পাই না। কোথায় তারা বিনিয়োগ করে এ অর্থ?
তিনি বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন সূত্রে যে খতিয়ান দেখতে পাই, তাতে নিজস্ব অর্থায়নে ১১টি প্রকল্পের তথ্য পেয়েছি। সেখানে ব্যয় হবে আট হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। এর মধ্যে মাত্র পাঁচটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। বাকিগুলো বন্ধ আছে। তাহলে বিপিসির টাকা কোথায়? আমরা জানতে পেরেছি বিভিন্ন ব্যাংকে বিপিসির ২৫ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা জমা রয়েছে। তাহলে ওই টাকা কোন টাকা?
এছাড়া বাকি টাকা কোথায়? আমার ধারণা বাকি টাকাও বিপিসির হিসাবেই রয়েছে। তাহলে কেন লোকসান দেখিয়ে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করা হলো? চলতি অর্থবছরেও পাঁচ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে বিপিসি। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, এ বছরেও বিপিসি বিনিয়োগ করবে! জনগণের মাথায় বোঝা চাপিয়ে বিপিসি কোথায় বিনিয়োগ করবে?
মোয়াজ্জেম বলেন, অবশ্যই জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি এড়ানো যেত। সংকট এড়ানো যেত, মূল্য বৃদ্ধির প্রয়োজন পড়ত না। বিপিসি যদি তার হিসাবে স্বচ্ছতা রাখত, তাহলে বাড়তি ব্যয়ের হিসাব সমন্বয় করা যেত। বিপিসি কীভাবে তার অর্থের হিসাব রাখছে, আমাদের জানা দরকার। তারা কোনটা লাভ, কোনটা লোকসান বলছে, সে হিসাব জনগণের সামনে আসা দরকার।
তিনি বলেন, সাবসিডি ম্যানেজমেন্টের নামে মূল্য বৃদ্ধি না করে অব্যবহূত অর্থ দিয়ে সাবসিডি অ্যাডজাস্ট করা যায়। আইএমএফের পরামর্শ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভর্তুকি ব্যবস্থাপনায় ওই কৌশল নেয়া যেত। ভোক্তার ওপর দায় চাপানো ঠিক হয়নি।
মূল প্রবন্ধে ফাহমিদা খাতুন বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুসারে, ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিপিসি ৪৬ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা লাভ করেছে। বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম বাংলাদেশের চেয়ে নেপাল ও পাকিস্তানে বেশি। এখানে মনে রাখতে হবে, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনাম। নীতি নির্ধারকদের এ বিষয়টি মাথায় রাখতেই হবে। দাম কাদের চেয়ে বেশি, সিঙ্গাপুর, হংকং ও জার্মানির চেয়ে বেশি আছে। যাদের মাথাপিছু আয় ৫০ হাজার ডলারের কাছাকাছি তাদের সাথে তুলনা করা হয়। যখন তুলনা করব তখন সে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থান ও প্রেক্ষাপট মাথায় রাখা জরুরি।
তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে প্রথমেই পরিবহন সেক্টরের ভাড়া বৃদ্ধি পায়, ডিজেলে দাম বৃদ্ধিতে কৃষি পণ্য উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাবে। অনেক কৃষক কৃষিকাজ ছেড়ে দেবে, ফলে আমদানি আবার বেড়ে যাবে। শিল্পের উৎপাদনেও খরচ বেড়ে যাবে।
তাহলে ব্যবসার লভ্যাংশ কমে যাবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। অর্থাৎ ধাপে ধাপে খরচ বৃদ্ধি দেশের মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি করবে। যার প্রভাব পড়বে জীবনযাত্রায়। এর বড় ধাক্কা আসবে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গরিবদের ওপর। সঞ্চয় ভেঙে খাবে সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে সুদের হার কম হওয়ায় সাধারণ মানুষ এখান থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।
জ্বালানি তেলের মূল্য পুনর্বিবেচনা করার দাবি জানিয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা বলেন, মূল্য পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। আমরা নিম্নমুখী সামঞ্জস্যের কথা বলছি। এর পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি ও রেশনিং কার্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।