আগস্ট ১৬, ২০২২, ০১:৩৭ এএম
লিখিত পরীক্ষা ছাড়াই মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিয়োগ করছে রাষ্ট্রায়ত্ব ন্যাশনাল টি কোম্পানি (এনটিসি)। মূলত পছন্দের প্রার্থীকে উত্তীর্ণ করতেই এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
তাছাড়া চাকরিবিধি অনুসারে নির্বাচিত প্রার্থীর বয়স নিয়েও রয়েছে জটিলতা। ফলে দেশের একমাত্র সরকারি চা কোম্পানির বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তুলেছে অন্যান্য চাকরিপ্রত্যাশীরা। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির একজন প্রভাবশালী পরিচালকও এই অনিয়মে জড়িত বলে জানা গেছে।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ৮ জুন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) পদে নিয়োগ দিতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ন্যাশনাল টি কোম্পানি। এক্ষেত্রে প্রার্থীদের চা বাগান ও কারখানা পর্যায়ে কমপক্ষে ২০ বছর এবং মহাব্যবস্থাপক (জিএম) পদে তিন বছরের কর্ম অভিজ্ঞতা যোগ্যতার শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এছাড়া প্রার্থীকে ন্যূনতম স্নাতক বা ডিগ্রি পাশ এবং বয়স অনুর্ধ্ব ৫২ বছর হতে হবে বলে জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে আরো উল্লেখ করা হয়, ৭ জুলাইয়ের মধ্যে প্রার্থীদের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসসহ আবেদন পত্র জমা দিতে হবে। যাচাই-বাছাই শেষে যোগ্য প্রার্থীদের লিখিত ও ভাইভা (মৌখিক) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষা নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন কয়েকজন নিয়োগপ্রার্থী। এদের একজন মৌলভীবাজার উপজেলাধীন রাজনগর চা বাগানের এজিএম মো. মহসিন জানান, বর্তমানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যেখানে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থী নির্বাচিত করা হয়, সেখানে ন্যাশনাল টির মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানে শুধু মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থী বাছাই করায় সবাই হতবাক।
তাছাড়া যাকে নির্বাচিত করা হয়েছে বলে শুনেছি, তিনি কখনো বাগানে কাজ করেননি। কারখানার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ছিলেন। ফলে বাগানের নিত্যকার কার্যাবলি সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল নয়, এটাই প্রতীয়মান হয়।
ন্যাশনাল টি কোম্পানিতে বর্তমানে চাকরিরত এবং ডিএমডি পদের আরেক নিয়োগ প্রার্থী নাম প্রকাশ না করে বলেন, মৌখিক (ভাইভা) সাক্ষাৎকার সাধারণত কোনো কার্যকরী নিয়োগ পরীক্ষা নয়।
কারণ, এখানে একজন প্রার্থীকে ইচ্ছে করলেই সহজ প্রশ্ন বা কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন করা যায়। সে ক্ষেত্রে প্রার্থী যদি আগেই নির্দিষ্ট করা থাকে তাহলে তাকে সহজ প্রশ্নের মাধ্যমেই উত্তীর্ণ করানো হবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত প্রার্থী মোহাম্মাদ মুসা জানান ভিন্ন কথা। অন্যান্য প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষা না হলেও এই প্রার্থীর জন্য আলাদাভাবে লিখিত পরীক্ষার ব্যবস্থা করাহয়েছে বলে তিনি নিজেই জানিয়েছেন।
তবে লিখিত পরীক্ষায় তিনি কত নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং তার পরের প্রার্থীদেরও কে কত নম্বর পেয়ে তার পেছনে রয়েছেন সে বিষয়েও কিছুই জানাতে পারেননি। এদিকে চূড়ান্ত নির্বাচিত প্রার্থীকে শুধু আলাদাভাবে লিখিত পরীক্ষাই নয়, তার বয়সের ক্ষেত্রেও বিশাল ছাড় দিয়েছে ন্যাশনাল টি কর্তৃপক্ষ, এমন অভিযোগ রয়েছে। সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ অনুসারে একজন সরকারি কর্মচারী ৫৯ বছরে অবসর গ্রহণ করবেন।
এ ক্ষেত্রে মোহাম্মদ মুসা নামে ওই প্রার্থীর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, তিনি ১৯৬৪ সালের ১৮ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। সে অনুসারে বর্তমানে (এই প্রতিবেদন লেখার সময়) তার বয়স চলছে প্রায় ৫৭ বছর ৯ মাস। আইন অনুসারে তিনি আর এক বছর তিন মাস চাকরি করার উপযুক্ত। সাধারণত এ পদে একজন কর্মকর্তার নিয়োগ কমপক্ষে দুই বছরের চুক্তিতে হয়ে থাকে। সে হিসেবেও তাকে নিয়োগ করা হলে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে চুক্তি অনুযায়ী অতিরিক্ত আরও সাত মাস তাকে চাকরি করতে হবে।’
এতেও বড় ধরনের কোনো সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়, তবে সমস্যা কিংবা সন্দেহ কোম্পানির উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে। যেখানে কখনোই মোহাম্মদ মুসা বাগানে কাজ করেননি এবং মাঠ পর্যায়ে, অফিস ও প্রধান কার্যালয়ে কাজ করা অভিজ্ঞতাও নেই। ফলে কারখানার গ্রুপ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে কাজ করে বাগানের নিত্যকার কার্যাবলীিসম্পর্কে ধারনা থাকার কথা নয়। এতে বাগানের উন্নয়ন বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ প্রতীয়মান হয়।
অথচ প্রাথমিক বাছাইয়ের পর নির্বাচিত ৬ নিয়োগপ্রার্থীর মধ্যে এমন প্রার্থীও ছিলেন যাদের চাকরি থেকে অবসর নেয়ার এখনো ৬-১০ বছর বাকি। শুধু তাই নয়- রয়েছে বাগানের উন্নয়ন বিষয়ক ধারণা ও পূর্ব অভিজ্ঞতা। এরপরও জেনেশুনে কারখানার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে কর্মরত মোহাম্মদ মূসার মতো এমন প্রার্থীকেই ডিএমডি পদে নিয়োগ দেয়ায় ন্যাশনাল টি কর্তৃপক্ষের অসদুদ্দেশ্য রয়েছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাছাড়া অবসরের মাত্র এক বছর পূর্বেই চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে ন্যাশনাল টি কোম্পানিতে যোগদানের বিষয়টিকে সন্দেহের চোখে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। সাধারণত দীর্ঘদিন কাজ করার পর অবসরের মাত্র বছর খানেক আগে কেউ চাকরি ছাড়েন না, যদি না প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে ছাঁটাই করা হয়। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিএমডি পদের জন্য নির্বাচিত মোহাম্মদ মুসা ফিনলে চা কোম্পানিতে অদক্ষতার কারণে প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) পদে পদোন্নতি পাননি।
এর পরিবর্তে তারই এক সময়কার অধস্তন তাহসিন আহমেদ চৌধুরী ওই পদে পদোন্নতি লাভ করেন। এদিকে প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য ন্যাশনাল টি কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক প্রতিষ্ঠান ডানকান টি কোম্পানির একজন পরিচালক শাহ আলমকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। একে অগ্রহনযোগ্য বলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
কারণ হিসেবে তারা বলছেন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান নিজের স্বার্থেই অপর প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ভালো অবস্থানে থাকতে চায়। এক্ষেত্রে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের মধ্যে অযোগ্য কাউকে যদি চা বিশেষজ্ঞ হিসেবে ওই পরিচালক নিয়োগ প্রদানের জন্য পরামর্শ প্রদান করে তবে তা ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ চা বোর্ড অথবা বাংলাদেশ টিরিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) থেকে বিশেষজ্ঞ আনা হলে তা অনেক বেশি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হতো বলে মনে করছেন তারা।
এদিকে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ব চা কোম্পানি হিসেবে ন্যাশনাল টি’র সম্পদের প্রাচুর্য্য থাকলেও কর্তৃপক্ষের উদাসিনতায় ক্রমাগত লোকসানের মুখে পড়ছে প্রতিষ্ঠানটি। সর্বশেষ ২০২১ সালেও প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ২৫ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে। এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠানটির লোকসানের পরিমাণ ছিল ৪০ কোটি টাকা।
সবচেয়ে বেশি চা বাগানের অধিকারী হয়েও ন্যাশনাল টির উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণে চা খাতে একেবারে তলানীর কোম্পানি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে খাত সংশ্লিষ্টদের মাঝে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির পলিসি মেকারদের ভূমিকাকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। এরই মাঝে চা খাতের শ্রমিকদের মাঝে বেতন নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
বর্তমান অর্থনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দৈনিক হাজিরা ১২০ টাকার পরিবর্তে ন্যূনতম তিনশ টাকা করা দাবি জানিয়ে আন্দোলনের ডাক দিয়েছে তারা। যদি সরকার তাদের দাবি মেনে ন্যূনতম দেড়শ টাকাও দৈনিক হাজিরা নির্ধারণ করা হয়, তবে এই কোম্পানির চা শ্রমিকদের বেতন বাবদ অতিরিক্ত ১০ কোটি টাকা বার্ষিক খরচ বৃদ্ধি পাবে। আবার শ্রমিকদের আগের বকেয়া বা এরিয়ার হিসেবে প্রায় পাঁচ-ছয় কোটি টাকা রয়েছে। এছাড়া যাদের সাম্প্রতিক সময়ে নিয়োগ করা প্রায় ২০-২৫ জন কর্মকর্তাকে বেতন-ভাতা বাবদ প্রতিমাসে অতিরিক্ত এক কোটি টাকা প্রদান করতে হবে বলে জানা গেছে।
কোম্পানির লোকসান ও নিয়োগ-পদোন্নতি বিষয়ে কোম্পানির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেনের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তিনি দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘কোন কারণে এমডি অসুস্থ বা অনুপস্থিত থাকলে প্রতিষ্ঠান যেন থমকে না যায়, তাই লোক নিয়োগ করা হয়েছে।
এছাড়া দীর্ঘদিন যাবত একই পদে কাজ করা কর্মকর্তাদের মাঝে কর্মস্পৃহা ফিরিয়ে আনতে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।’ এ ক্ষেত্রে কোনো কারণে ন্যাশনাল টির চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকলে ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে কেউ আছে কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বিরক্তিভাব প্রকাশ করেন।
এছাড়া ডিএমডি পদে লোক নিয়োগে লিখিত পরীক্ষা কেন নেয়া হয়নি এমন প্রশ্নে বলেন, ‘এখন আমার মেজাজ খারাপ হবে। একটা চা কোম্পানি নিয়ে এগুলো কি শুরু করেছেন। এতো কিছু ধরলে হবে না। আপনারা আল্লাহর ওয়াস্তে মাফ করেন। একটু ভালো লেখেন। যারা এটাকে গিলে খেতে চাইছে তারাই এগুলো করাচ্ছে।’
কোম্পানির ক্রমাগত এমন লোকসানের পরও সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক হারে নিয়োগ ও পদোন্নতি দেয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। এতে প্রতিষ্ঠানটির লাভের অংক না বাড়লেও লসের ভাগ বাড়বে বলেই মনে করছেন প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগকারীরা।
তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটির একজন প্রভাবশালী পরিচালক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সাথে জড়িত। তার নেতৃত্বে এসব অনিয়ম সংঘটিত হচ্ছে। তার নিয়ন্ত্রণাধীন প্রায় সবগুলো প্রতিষ্ঠানেই অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ অবস্থায় ন্যাশনাল টির মতো একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাঁচিয়ে সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষায় অবিলম্বে নেতৃত্বের পরিবর্তন আনাই এখন সময়ের দাবি।