আগস্ট ২০, ২০২২, ০৯:৪৮ এএম
দেশে শুধু জ্বালানি তেলের মূল্যই নয়, বেড়েছে সারের দামও। যদিও বাড়তি দামেও ভরা মৌসুমে সার পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ কৃষকের। সার ও ডিজেলের বাড়তি ব্যয়ের কারণে উৎপাদন খরচ তোলাটাই যেখানে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে সার না পাওয়ায় কৃষকের কপালে এখন দুশ্চিন্তার ভাঁজ। বাধ্য হয়ে কোথাও কোথাও সড়কও অবরোধ করছেন কৃষকরা; তবুও মিলছে না সার। বেশ কিছুদিন ধরেই চলমান সার সংকটের মধ্যেই বৃহস্পতিবার কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চাহিদার বিপরীতে দেশে সব রকমের সারের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের তথ্যে বর্তমানে দেশে ইউরিয়া সারের মজুত রয়েছে ছয় লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন, টিএসপি তিন লাখ ৯৪ হাজার টন, ডিএপি সাত লাখ ৩৬ হাজার টন, এমওপি দুই লাখ ৭৩ হাজার টন। তবুও কেন সার পাচ্ছে না কৃষক— এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) চেয়ারম্যান, সচিব, সার ব্যবস্থাপনা বিভাগের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ও সার সংরক্ষণ ব্যবস্থাপকের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি।
তবে কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কৃত্রিমভাবে যাতে কেউ সারের সংকট তৈরি করতে না পারে এবং দাম বেশি নিতে না পারে, সে বিষয়ে মন্ত্রণালয় ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা নিবিড় তদারকি করছেন। কৃত্রিম সংকটকারীদের শাস্তির আওতায় আনার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। কার্যত মাঠ পর্যায়ে মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের এমন কার্যক্রম এখনো দৃশ্যমান না হওয়ায় সার সংকট থেকে রেহাই মিলছে না কৃষকের।
মধ্য জুলাই থেকে আগস্টের শেষ পর্যন্ত আমন ধানের চারা রোপণের সময়কাল। অথচ ভরা মৌসুমেই এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) সারের জন্য কৃষকের মাঝে দেখা দিয়েছে হাহাকার। এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে চাষাবাদ করবেন তারা— এমন প্রশ্ন যশোরের কৃষকদের।
জেলার গুদামগুলোতে সার পৌঁছানোর দায়িত্ব ঠিকাদারদের। এক্ষেত্রে ঠিকাদারদের অনিয়মও নতুন নয়। তাদের অনিয়মেরই শিকার হচ্ছেন কৃষক। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থা ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, চাহিদার বেশি এমওপি সার খুলনায় মজুত থাকলেও ওই সার পরিবহন করে যশোর গুদামে না আনায় কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। পরিবহন ঠিকাদাররা টিএসপি ও ডিএপি সার পৌঁছে দিলেও এমওপি পৌঁছানো হচ্ছে অল্প অল্প করে। যে কারণে সৃষ্ট সংকটের প্রভাবে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন অনেকেই।
সার পরিবহন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীরা বলছেন, সার সংকটের কারণেই এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অথচ দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন সারের সংকট নেই। সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, মূলত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোই এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তারা ঠিকঠাকমতো সার পৌঁছে দিচ্ছে না গুদামে। অবৈধভাবে খোলাবাজারে বা মাছের খামারে সার বিক্রি করে দিতেই এমন কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে তারা। বিশেষ করে মাছের ঘেরে সার বিক্রি করে বেশি দাম পাওয়া যায়। কারণ, মাছের ঘেরে সরকারের সার বরাদ্দ না থাকায় এমন সুযোগ নিয়ে থাকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এর কারণে বঞ্চিত হন কৃষক। বগুড়ার ধুনট উপজেলায়ও চাহিদা অনুযায়ী সার না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কৃষকরা। গত বুধবার সড়কও অবরোধ করেন তারা।
সার পরিবহনে অনিয়মের সঙ্গে ঠিকাদারদের সংগঠন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) প্রভাবশালী নেতারাও জড়িত বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সংগঠনটির কাছে সরকারি কর্মকর্তারাও অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়েন, কেউ কেউ নেন বাড়তি সুবিধাও। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে খাদ্যনিরাপত্তার অনিশ্চয়তার মধ্যে কৃষি খাতই সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল। এ খাতে অনিয়ম কিংবা সারের হালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির নেপথ্যে যারা রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির দাবিও উঠছে কৃষকসহ বিভিন্ন মহল থেকে।
জানা গেছে, নওগাঁর রানীনগরে চলতি আমনের ভরা মৌসুমে সারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। স্থানীয় বাজারের খুচরা দোকানে ও ডিলারের কাছে কৃষকদের চাহিদামতো মিলছে না ইউরিয়া, পটাশ ও ডিএপি সার। কৃষকদের অভিযোগ, সিন্ডিকেটকারীরা সারের সংকট তৈরি করার কারণে ডিলারদের কাছে চাহিদামতো সার না পেয়ে বাড়তি দামে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে। এতে উপজেলায় সার সংকটের অজুহাতে ব্যবসায়ীরা বাড়তি দামে সার বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অঙ্কের টাকা।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, বছরে ইউরিয়া সারের চাহিদা ১১ হাজার টন হলেও সরকারিভাবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সাত হাজার টন। পটাশ সারের চাহিদা ছয় হাজার টন হলেও দেয়া হয়েছে দুই হাজার ২০০ টন এবং ডিএপি সারের ছয় হাজার ৩০০ টনের চাহিদা থাকলেও বরাদ্দ দেয়া হয় পাঁচ হাজার টন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বলেন, চাহিদার তুলনায় সার বরাদ্দ কম পাওয়া গেছে। আবার বরাদ্দের জন্য চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি কৃষক যেন সঠিক সময়ে তাদের চাহিদামতো সার পান। উপজেলায় সারের কোনো সংকট নেই বলেও দাবি এ কর্মকর্তার।
এদিকে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীতে ডিলারদের বিরুদ্ধে উঠেছে অনিয়মের অভিযোগ। জানা গেছে, বিএডিসির ডিলারদের গুদামঘর নেই। অনুমতিপত্র ভাড়া দিয়ে খাচ্ছেন তারা। এর ফলে নিয়ম অনুযায়ী সার উত্তোলন করে কৃষকের কাছে বিক্রি না করায় গত এক মাস ধরে সংকট শুরু হয়েছে সেখানে। উপজেলার কৃষক লীগ নেতাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি সভা ডেকে চলমান সংকট দূর করতে ৩৩ ডিলারকে তিনদিনের মধ্যে সংকট নিরসনে আলটিমেটাম দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। এছাড়া জেলার অন্যান্য উপজেলায়ও একই অবস্থা বিরাজ করছে।
বিএডিসি ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, এমওপি সারের কোনো সংকট নেই। পরিবহন কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে ঠাকুরগাঁওয়ের গুদামে নিয়মিত সার আসছে না। ফলে তারা পরিবেশকদেরও চাহিদামতো সার বরাদ্দ দিতে পারছেন না।
গতকাল শুক্রবার লাইনে দাঁড়িয়েও সার না পেয়ে সড়ক অবরোধ করেছেন দিনাজপুরের কৃষকরা।
তারা জানান, গত কদিন ধরেই তারা সার পাচ্ছেন না। পাওয়া গেলেও দাম বস্তাপ্রতি ১০০ থেকে ২০০ টাকা বেশি। দাম বেশি নেয়ার অভিযোগে বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে স্থানীয় প্রশাসন উপজেলায় সার বিক্রি বন্ধ করে দেয়। নাটোরে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ডিলাররা অতিরিক্ত দাম নিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন কৃষকরা। তবে ডিলাররা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দাম ও নিয়মেই সার বিক্রি করছেন তারা।
কুষ্টিয়ায় ডিলার, সাব-ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কেউই নিয়ম মানছেন না। সরকার শুধু ইউরিয়ার দাম বাড়ালেও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অন্য সারের দামও কেজিতে ১০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে বিক্রি করছেন তারা। গাইবান্ধায়ও সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রির অভিযোগ কৃষকের। ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও পটাশসহ সব ধরনের সারে বস্তাপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে।
অথচ কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আমন মৌসুম (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত দেশে ইউরিয়া সারের চাহিদা ছয় লাখ ১৯ হাজার টন। এর বিপরীতে মজুত রয়েছে সাত লাখ ২৭ হাজার টন। সে হিসেবে মজুতের পরিমাণ চাহিদার চেয়ে প্রায় এক লাখ টন বেশি। তবুও ভরা মৌসুমে কৃষকদের সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে সিন্ডিকেট।