Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

হেফাজতে মৃত্যুর বিচার হয় না

শরিফ রুবেল

আগস্ট ২২, ২০২২, ০২:৫৮ এএম


হেফাজতে মৃত্যুর বিচার হয় না

কাউকে আটকের সময় ও আটকের পর নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া যায়। হেফাজতে নির্যাতন এখন স্বাভাবিক ঘটনা। গ্রেপ্তারের পর শারীরিক নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয় এমন অভিযোগও নতুন নয়। তবে আইন বলছে, ‘হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু’ গুরুতর অপরাধ। বেআইনি কাজ।

সংবিধানেরও লঙ্ঘন। হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ পৃথক আইন আছে। রয়েছে কঠোর শাস্তির বিধান। তবে আইনের প্রয়োগ না থাকায় থামছে না নির্যাতন। ফলে প্রায়ই ঘটছে এমন ঘটনা। নিরাশার কথা হলো— এমন ঘটনায় বিচার হয় না। অধিকাংশ পরিবারই অভিযোগ করার সাহস পায় না।

বিচার প্রক্রিয়া তো দূরের কথা। পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা নেয়ার উদাহরণও বিরল। নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে এখন পর্যন্ত পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২৮টি। মাত্র একটিতে নিন্ম আদালতে রায় হয়েছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা চেপে যান বা আপস করে ফেলেন।

এছাড়া অভিযোগ না করেও পরিবারের নানা বিরূপ অভিজ্ঞতা রয়েছে। তা জানলেই বোঝা যায়, কেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন না।

পুলিশ হেফাজতে মারা যাওয়া একাধিক পরিবারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নির্যাতনে মৃত্যুর পর অনেকেই লাশের ময়নাতদন্ত করতে পারেননি।

তারা জানান, লাশ নিতে গিয়েও সারাক্ষণ ভীতির মধ্যে থাকতে হয়েছে। কারণ তাদের আগে পেছনে সব সময় ডিবি ও পুলিশের লোক ছিল। ভয়ে কিছুই বলার সাহস পায়নি। কোনোরকম লাশ বুঝে পেয়েছে। তারা শুধু কাগজে সই করেছে ও লাশ বুঝে নিয়েছে।

এরপর যখন জানাজা হয়েছে, সেখানে অনেক পুলিশ ও সাদা পোশাকে ডিবির লোক ছিল। ভয়ে অনেকেই জানাজায়ও আসেনি। মামলা করে বাদীর পালিয়ে বেড়ানোর অভিযোগও রয়েছে। আইনে বিচার বিভাগীয় তদন্তের সুযোগ রয়েছে।

তবে তদন্তভার সবসময় পুলিশের কোনো সংস্থাকেই দেয়া হয়েছে। কখনো বিচারবিভাগীয় তদন্ত হয়েছে— এমন নজির নেই। এত সুযোগ থাকার পরও পুলিশ আইনটি চায় না। বাতিলের চেষ্টা চালাচ্ছে।

পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলে তদন্তের দায়িত্ব ভিন্ন কোনো সংস্থাকে দেয়া উচিত বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান।

তিনি বলেন, ‘পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। হেফাজতে নিযাতনের অভিযোগটা নতুন নয়।

তবে এ বিষয়ে মামলা হয় এমন খবর শোনা যায় না। মামলা হলে এ ধরনের ঘটনার তদন্তভার যদি পুলিশকেই দেয়া হয়। তাহলে আইনের কিছুটা বিচ্যুতি ঘটার বা পক্ষপাতিত্বের সুযোগ থেকে যায়।

কারণ বাহিনীর ইমেজ রক্ষার প্রশ্নে সুষ্ঠু তদন্ত নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে হেফাজতে মৃত্যু বা নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটলে, তার তদন্তভার নিরপেক্ষ কোনো সংস্থাকে দেয়া উচিত।

অথবা বিচারবিভাগীয় তদন্ত হলে সবচেয়ে ভালো হবে। তাছাড়া ন্যায়বিচার লঙ্ঘিত হওয়ার সুযোগ থেকে যায়। আরেকটি বিষয় হলো— এখন পর্যন্ত এই আইনের ব্যবহারও অপ্রতুল। এ আইন ব্যবহার বাড়াতে প্রচারণার দরকার।

আর পুলিশি নির্যাতনে কেউ মারা গেলে, পুলিশের বিরুদ্ধেও যে আইনি পদক্ষেপ নেয়া যায় সে বিষয়ে সাধারণ জনগণকে সচেতন করতে হবে। সামগ্রিকভাবে এ বিষয়টি দেখভালের জন্য একজন ন্যায়পাল নিয়োগ দেয়া সময়ের দাবি। আরেকটি বিষয়— এ নিয়ে মানবাধিকার কমিশনের যেভাবে কাজ করা উচিত তারা সেটি করতে পারছে না।’

আসামি ধরে থানায় নেয়ার পরে পুলিশ নির্যাতন করবেই এটি ধরে নেন ভুক্তভোগীরা। আইন অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে তদন্ত করার এখতিয়ার মানবাধিকার কমিশনকে দেয়া হয়নি। তাই জাতীয় মানবাধিকার কমিশন থাকলেও তাদের ক্ষমতা নেই। লম্বা প্রক্রিয়া শেষে কমিশন হাইকোর্টে রিট আবেদন করতে পারে।

তবে সেই মামলা চালানোর সক্ষমতা কমিশনের নেই। পুলিশি নির্যাতন বন্ধে আইন থাকা সত্ত্বেও প্রচারের অভাব ও ভয়ের কারণে এই আইনে মামলার সংখ্যা খুবই কম। আবার অনেকেই এই আইনটির বিষয়ে জানেন না। তাই যারা মামলা করেন তারা দণ্ডবিধির অন্য ধারায় মামলা করেন, যাতে বিচার পাওয়া খুবই জটিল।

আইনজীবীরা বলছেন, মামলা করার পরপরই আদালত নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও তাকে সুরক্ষার আদেশ দেবেন আইনে এমনটি বলা হয়েছে। আর এই আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি ক্ষতিপূরণেরও বিধান আছে। বিচার কাজ শেষ করতে হবে ১৮০ দিনের মধ্যে।

বিচার হবে দায়রা জজ আদালতে। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে পুলিশ নিজেরাই তদন্ত করে, ফল যা হওয়ার তা-ই হয়, যে পুলিশ মামলাই নিতে চায় না, তার হাতে তদন্তের ভার দিলে সঠিক তদন্ত হওয়ার কারণ নেই।

এদিকে আইনানুযায়ী নিরাপত্তা হেফাজতে এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে’ (সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ)। আইন হওয়ার পরেও গত ৯ বছরে কমপক্ষে ৩২০ জন মারা গেছেন। বিচার হয়েছে মাত্র একটি। তারও সময় লেগেছে সাড়ে ছয় বছর। বিচারের জন্য পরিবারকে লড়তে হয়েছে। পুলিশ মামলা নেয়নি। পরিবারকে দেখানো হয়েছে ভয়ভীতি-প্রলোভন।

এদিকে কাগজ-কলমে নির্যাতনের প্রতিকারের সুযোগ থাকলেও ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন, আইনের আশ্রয় নেয়ার পরিণতি যে আরো ভয়াবহ হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল বলেন, হেফাজতে নির্যাতন বা মৃত্যু ঘটনায় ভুক্তভোগীরা মামলা করার সাহস পায় না। কারণ নির্যাতনের শিকার হলেও তাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করে, যে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে আমরা টিকে থাকতে পারব কি-না? মূলত ভীতি থেকেই নিবারণ আইনের প্রয়োগ সেভাবে হচ্ছে না। প্রথমে যারা অভিযুক্ত (আইনশৃঙ্খলাবাহিনী) তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে অভিযোগকারীরা নিরাপদ কি-না এ বিষয়টি আইন নিশ্চিত করতে পারেনি। আর তদন্তের বিষয়টি নিরপেক্ষ করতে হলে আদালতের উচিত হবে বিচারবিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা করা। কারণ অভিযুক্তকে দিয়ে অভিযোগের তদন্ত করলে সঠিক ফলাফল আসবে না।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র হিসাব দিয়েছে, ২০২০ সালে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে, অর্থাৎ গ্রেপ্তারের পর নিহত হয়েছেন ১১ জন। এ ছাড়া গ্রেপ্তারের আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনে মারা গেছেন পাঁচজন এবং গুলিতে নিহত হয়েছেন আটজন।

২০১৯ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মোট ১৮ জন মারা যান। ২০১৮ সালে ১৭ জন। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার বছরে ২৬০ জন হেফাজতে মারা যান, ২০১৬ সালে এক বছরেই মারা যান ৭৮ জন। ২০০৩ সালে হাইকোর্ট হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশনা দিয়ে এ রায় দিয়েছিলেন। গ

ত বছর মে মাসে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে আরো কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে উচ্চ আদালতের সে রায় মানছে না পুলিশ। সারা দেশে জিজ্ঞাসাবাদের নামে হেফাজতে নিয়ে হরহামেশা আসামিদের নির্যাতনের অভিযোগ উঠছে পুলিশের বিরুদ্ধে। এমনকি নির্যাতনের ফলে অনেক সময় আটক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, আসলে পুলিশের বিরুদ্ধে কেউ মামলা করার সাহস পান না। কারন এখানে একটা নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে। তবে নিবারন আইনটির অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, যিনি ভুক্তভোগী বা অভিযোগকারী তাকে মামলা প্রমাণ করতে হবে না। তিনি অভিযোগ করার পর অভিযুক্তদেরই প্রমাণ করতে হবে তারা অপরাধী নন। প্রমাণে ব্যর্থ হলে তারা দোষী সাব্যস্ত হবেন।

ঘটনা-১ : সুনামগঞ্জে গরু চুরির মামলায় সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে গত ৯ ফেব্রুয়ারি উজির মিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। উজির মিয়ার সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন একই এলাকার শহীদ ইসলাম, আক্তার মিয়া ও শামীম মিয়া। তাদের মধ্যে উজির, শহীদ ও আক্তার ১১ ফেব্রুয়ারি জামিনে ছাড়া পান। বাড়ি ফেরার পর দেখা যায় মধ্যবয়সি উজিরের হাঁটুর নিচে মাংসপেশি, উরু, পিঠে অসংখ্য কালসিটে দাগ। মাথাতেও বেশ কিছু দাগ দেখা যায়, যেগুলো মারধরের কারণে হয়েছে বলে জানান পরিবার। তবে জামিনে মুক্তির ১১ দিনের মাথায় মৃত্যু হয় উজিরের। মৃত্যুর পর স্বজনরা অভিযোগ করেন, থানায় নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন তিনি। তবে পুলিশ এই অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করে, জামিনের ১১ দিন পর কারও মৃত্যু হলে পুলিশের ওপর কোনো অভিযোগ আসতে পারে না। স্বজনরা জানিয়েছেন, বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়ার সময়ই উজিরকে বেধড়ক পেটানো হয়েছিল। তার সাথে গ্রেপ্তার হওয়া দুজন জানিয়েছেন, থানায় গামছা দিয়ে বেঁধে, পরে ঝুলিয়ে ব্যাপক মারধর করা হয়। একপর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে উজিরসহ তিনজনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়।

ঘটনা-২ : রাজধানীতে রাজীব কর নামের এক ব্যক্তিকে থানায় নিয়ে নির্যাতন করার অভিযোগে কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমানসহ তিন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা নেয়ার আবেদন করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে গত ১০ জুলাই আবেদন করেছেন রাজীব কর। আদালত রাজীবের জবানবন্দি রেকর্ড করে মামলাটি তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আদেশ দেন। আবেদনে ভুক্তভোগী রাজীব দাবি করেন, ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বাসায় ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি। রাত আড়াইটার দিকে এসআই মিজান ও এএসআই ফরিদ তার বাসায় সাদা পোশাকে আসেন। পুলিশ পরিচয় দিয়ে তাকে হাতকড়া পরানো হয়। বাসায় তল্লাশি চালিয়ে ২৮ ভরি সোনা, ৪১ হাজার টাকাসহ তাকে থানায় ধরে নিয়ে যান তারা। রাত ৩টার সময় তাকে থানার একটি কক্ষে ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে মিজান ও ফরিদ পিটিয়ে অজ্ঞান করেন। নির্যাতনের কারণে ভিকটিম অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়।

Link copied!