Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

ব্যাংকের লোভেই ডলার সংকট

রেদওয়ানুল হক

আগস্ট ২৩, ২০২২, ০১:২৫ এএম


ব্যাংকের লোভেই ডলার সংকট

দেশে মার্কিন ডলারের সংকটকে পুঁজি করে রমরমা ব্যবসায় নেমেছে ব্যাংকগুলো। প্রথমদিকে এককভাবে মানি চেঞ্জারগুলোকে ডলার কারসাজির জন্য অভিযুক্ত করা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিযানে বেরিয়ে আসে ব্যাংকগুলোর পুকুর চুরির তথ্য।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈধ-অবৈধ মানিচেঞ্জারগুলো কারসাজি করছে এটা ঠিক কিন্তু বাজারে বড় প্রভাব ফেলতে তারা যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। ডলার সংকট চরমে পৌঁছে যাওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আভিযানিক দল ব্যাংক ও এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোতে ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করে।

এতে দেখা যায়, কোনো কোনো ব্যাংক শুধু ডলার বিক্রি করে ৭৭০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করেছে। কেউ কেউ চাল-তেলের মতো ডলারও মজুত করে সংকট তৈরি করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বারবার অনুরোধ ও নির্দেশনা সত্ত্বেও অনৈতিক কাজ থেকে বিরত থাকেনি ব্যাংকগুলো। এমনকি ব্যাংকের নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সভাপতির পরিচালিত ব্যাংকও জড়িয়ে পড়েছে কারসাজি চক্রে। দেশের দুঃসময়ে এমডিদের কাছে সহযোগিতা চেয়েও হতাশ হয়েছেন নতুন গভর্নর।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, ন্যূনতম নৈতিকতাবোধ না থাকলে এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা কঠিন।

আইন ও বিধি দিয়ে সব ঠিক করা যায় না মন্তব্য করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার সংবাদকে বলেন, একটি খাতের নেতৃস্থানীয় লোকজন যখন অনৈতিক কাজ করে তখন শৃঙ্খলা রক্ষা কঠিন হয়ে পড়ে। ধমক দিয়ে, শাস্তি দিয়ে সব কিছু ঠিক করা যায় না, সদিচ্ছা থাকতে হয়। ব্যাংক খাতে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারাই যখন কারসাজিতে জড়িয়ে পড়েন তখন পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে থাকে। অথচ দেশের ক্রান্তিলগ্নে তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া উচিত ছিল।

এ কর্মকর্তা আক্ষেপ করে বলেন, ‘একটা পরিবারে সবাইকে সহমর্মী হয়ে কাজ করতে হয়। ব্যাংকগুলো অনেক ভুল করে আমাদের কাছে আসে, আমরাও সব সময় কঠোরতা দেখাই না; তাদের সুযোগ দেই। তাদেরও উচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে চলা। বিশেষ করে সংকটকালে একসাথে কাজ করা। উল্টো তারা সুযোগ নিল! এটা হতে পারে না।’

তিনি বলেন, ‘দায়িত্ব নেয়ার পর নতুন গভর্নর ব্যাংকের এমডিদের ডেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। তাদেরও দেশের অর্থনীতির স্বার্থে মিলেমিশে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু তারা কথা রাখেননি। আমরা দেখলাম এমডিদের যিনি নেতা তার ব্যাংকেই অনিয়ম ধরা পড়ল। সতর্ক করার পরও তারা শুনল না। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তাদের নোটিস দেয়া হলো। এটা না হলে ভালো হতো। কেউ যদি সংকটের সুযোগ নেয় তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বসে থাকবে না। দেশের স্বার্থে কঠোরতা দেখাতে আমরা কার্পণ্য করব না।’

জানা গেছে, কারসাজি করে অস্বাভাবিক মুনাফা করেছে এমন ব্যাংকগুলোর তালিকা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে অতিরিক্ত মুনাফার অভিযোগে ছয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে শোকজ করা হয়েছে।

পর্যায়ক্রমে অন্য ব্যাংকগুলোকেও চিঠি দেয়া হবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যেসব ব্যাংকের এমডিদের চিঠি দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো— ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা, প্রাইম ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক ও বিদেশি খাতের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। এর আগে এসব ব্যাংকের ট্রেজারি বিভা?গের প্রধানকে সরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, ‘ডলারে অতিরিক্ত মুনাফার বিষয়ে ছয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্য ব্যাংকগুলোকেও চিঠি দেয়া হবে। এছাড়া প্রতিটি ব্যাংকে ইন্সপেকশন করা হবে। কারণ একই কাজ আরও অনেক ব্যাংক করেছে বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে।’

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ডলার নিয়ে অস্বাভাবিক মুনাফা করেছে এমন ১২টি ব্যাংকের তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে— ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন থেকে সর্বোচ্চ ৭৭০ শতাংশ মুনাফা করেছে বেসরকারি খাতের ব্যাংক এশিয়া। যেখানে ২০২১ সালের একই সময়ে ডলার কেনাবেচায় মুনাফা করেছিল মাত্র ২৩ কোটি টাকা। সেখানে ব্যাংকটি এ বছরের প্রথম ছয় মাসে লাভ করেছে ২০০ কোটি টাকা। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় আটগুণ বেশি। ব্যাংক এশিয়া ছাড়াও ৯টি ব্যাংক এই সময়ের মধ্যে ২০০ শতাংশের বেশি মুনাফা অর্জন করেছে। আর দুটি ব্যাংক ১৪০ শতাংশের বেশি মুনাফা অর্জন করেছে বলে জানা গেছে। ডলার লেনদেনের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো যে মুনাফা করেছে তার তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রাইম ব্যাংক চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাসে ৫০৪ শতাংশ বা ১২৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। একই সময়ে এনসিসি ব্যাংক ৫০০ শতাংশ বা ১০০ কোটি টাকা, ব্র্যাক ব্যাংক ৪১৭ শতাংশ বা ৭৫ কোটি টাকা, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ৪০৩ শতাংশ বা ১১৭ কোটি টাকা, ঢাকা ব্যাংক ৩৫৩ শতাংশ বা ১০৬ কোটি টাকা, সিটি ব্যাংক ৩৪০ শতাংশ বা ১৩৬ কোটি টাকা, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ২৪৫ শতাংশ বা ১২০ কোটি টাকা, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ২৩৪ শতাংশ বা ৯৭ কোটি টাকা, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ২০৫ শতাংশ বা ১৩৫ কোটি টাকা, ইস্টার্ন ব্যাংক ১৫৯ শতাংশ বা ৪৩ কোটি টাকা এবং ইসলামী ব্যাংক ১৪০ শতাংশ বা ১৩৬ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, শুধু কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়ে সমস্যা সমাধান করা যাবে না। আমার সংবাদকে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত হবে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া।’ ব্যাংকগুলো অস্বাভাবিক ব্যবসায় না নামলে পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।

অন্যদিকে সংকট মোকাবিলায় ব্যাংক ও মানি চেঞ্জারগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মানি চেঞ্জারগুলোর সঙ্গে বৈঠকে প্রতি ডলারে সর্বোচ্চ দেড় টাকা মুনাফার সীমা ঠিক করে দেয়া হয়েছে। এর আগে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের সংগঠন এবিবি ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকের সংগঠন বাফেদার সাথে বৈঠক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেখানে বলা হয়, ব্যাংকগুলো ডলার কেনাবেচায় কত টাকা মুনাফা করবে তা তারা নিজেরাই ঠিক করবে, তবে বেচাকেনার মধ্যে পার্থক্য যেন এক টাকার বেশি না হয়।

এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে আমদানিতে রাশ টানার উদ্যোগ শুরু হয় গত মে মাস থেকে। তবে ৪ জুলাই এ ক্ষেত্রে বেশ কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। গাড়ি, স্বর্ণ, টিভি, ফ্রিজসহ ২৭ ধরনের পণ্য আমদানির এলসি মার্জিন নির্ধারণ করা হয়েছে শতভাগ।

আর জ্বালানি, অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, শিল্পে ব্যবহূত কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ কিছু পণ্য বাদে অন্য সব ক্ষেত্রে এলসি মার্জিনের ন্যূনতম হার হবে ৭৫ শতাংশ। উভয় ক্ষেত্রে মার্জিনের জন্য ঋণ দেয়া যাবে না। এর মানে এলসি খোলার সময়ই আমদানিকারকের নিজস্ব উৎস থেকে পুরো অর্থ নগদে দিতে হবে।

এর আগে, গত ১০ মের নির্দেশনায় কিছু পণ্যে এলসি মার্জিনের ন্যূনতম হার ৫০ ও ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। সরবরাহ বাড়াতে ব্যাংক ও রপ্তানিকারকের ডলার ধারণের ক্ষমতা কমানো হয়েছে। রপ্তানি আয় আসার এক দিনের মধ্যে ডলার নগদায়নের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ডলারের দর নিয়ন্ত্রণের জন্য এক ব্যাংকের রপ্তানি আয় অন্য ব্যাংকে ভাঙানোর ওপর বিধিনিষেধ দেয়া হয়েছে। ইডিএফ থেকে নেয়া ঋণ কেবল রপ্তানি আয় বা জমা থাকা বৈদেশিক মুদ্রা থেকে পরিশোধ করতে বলা হয়েছে।

এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে করোনার সময় দেয়া শিথিলতার মেয়াদ আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলে বাজারে ডলার সরবরাহ বৃদ্ধির পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভিযানের পর ডলারের দাম কমতে শুরু করেছে। খোলাবাজারে ১২০ টাকায় উঠে যাওয়া ডলার এখন ১১০ টাকার নিচে নেমেছে।

Link copied!