আগস্ট ২৫, ২০২২, ০২:০৯ এএম
দেশে সারের চাহিদা পূরণ করতে নিজস্ব উৎপাদনের পাশাপাশি আমদানিও করতে হয় সরকারকে। এ ক্ষেত্রে দেশের অধিকাংশ সারই আমদানিনির্ভর। জলপথে আমদানি করা বিভিন্ন ধরনের সারবাহী জাহাজ ভেড়ানো হয় চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে। ওই দুই বন্দর থেকেই বিএডিসির টেন্ডারের মাধ্যমে পরিবহন ঠিকাদাররা দেশের বিভিন্ন জেলায় সরকারি গুদামে সেসব সার পৌঁছে দেন।
সারাদেশের সরকারি গুদামে সার ডিস্ট্রিবিউশনের এ প্রক্রিয়া এ পর্যন্ত ঠিক থাকলেও পরবর্তীতে আর ঠিক রাখা যাচ্ছে না। বন্দর থেকে আমদানি করা সার পরিবহনের ক্ষেত্রে দেশে দীর্ঘদিন ধরেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে ত্রিমুখী একটি চক্র।
ওই চক্রে রয়েছে পরিবহন ঠিকাদার, বিএডিসির কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও মাঠ পর্যায়ের অসাধু ডিলাররাও। ওই চক্রটিই অতি মুনাফার লোভে দেশে সারের কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে বলে চাউর রয়েছে।
হালের সংকটেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেখানে সরকার বলছে দেশে চাহিদার তুলনায় সারের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে, সেখানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকরা কেন সারের জন্য হাহাকার করছেন। কোথাও কোথাও আবার সড়ক অবরোধ-বিক্ষোভও করছেন কৃষকরা। চাউর হচ্ছে, এ সংকটের নেপথ্যেও রয়েছে ত্রিমুখী সেই চক্র। যাদের অন্যতম পরিবহন ঠিকাদাররা। সংকট সৃষ্টির লক্ষ্যে পরিবহন ঠিকাদাররা সঠিক সময়ে সার পরিবহন করছেন না।
অভিযোগ উঠছে, বিদেশ থেকে জাহাজে আমদানির পর এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) সার খালাস করে রাখা হয়েছে মংলা বন্দরের বিভিন্ন স্থানে। অথচ দিনের পর দিন সেখানে সার পড়ে থাকলেও যথাসময়ে পৌঁছাচ্ছে না গুদামে। যে কারণে সার পাচ্ছেন না কৃষকরা। পরিবহনে অনিয়মের এমনই অভিযোগ উঠেছে বেসরকারি সার আমদানিকারক ও পরিবহন কোম্পানি পোটন ট্রেডার্সের বিরুদ্ধে।
এই প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণেই রাজশাহীসহ দেশের উত্তরাঞ্চলজুড়ে পটাশ সারের বর্তমান সংকট সৃষ্টি হয়েছে। যদিও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে চিঠি ইস্যু ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের মানসিকতাই পোষণ করছে না বিএডিসি।
জানা গেছে, গত দুদিন আগ পর্যন্তও আগস্ট মাসের বরাদ্দের দুই-তৃতীয়াংশ পটাশ সারই এখনো পাননি রাজশাহীর ডিলাররা। যে কারণে সংকট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কৃষি মন্ত্রণালয়কে চিঠিও দেয় রাজশাহীর প্রশাসন। বিএডিসির কর্মকর্তারা বলছেন, তারা একদিন পরপরই পোটন ট্রেডার্সকে চিঠি দিচ্ছেন, কিন্তু কোনো ফল হচ্ছে না।
রাজশাহী অঞ্চলের ডিলাররা অভিযোগ করেছেন, তারা সার পাচ্ছেন না; কিন্তু খুচরা কারবারিরা ঠিকই কালোবাজার থেকে সার সংগ্রহ করে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করছেন। আর এভাবেই সারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অতিরিক্ত মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে পরিবহন ঠিকাদার, বিএডিসির অসাধু কর্মকর্তা ও অসাধু ডিলারদের ত্রিমুখী সেই চক্র।
জানা গেছে, সাতটি জাহাজের এক কোটি ২৫ লাখ ৩৪৪ টন এমওপি সার মংলা বন্দর থেকে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগসহ বিভিন্ন জেলার সরকারি গুদামে পৌঁছানোর টেন্ডার পায় পোটন ট্রেডার্স। আর ১২ হাজার টন সার পরিবহনের দায়িত্ব পায় কুষ্টিয়া ট্রেডিং। এর মধ্যে পোটন ট্রেডার্সের বরাদ্দ পাওয়া এমওপি সার বিগত ২০২১ সালের ২৯ এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর পরিবহন তারিখ ছিল।
গত ১ আগস্ট পর্যন্ত এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি ৩৩ হাজার টন সার পরিবহন করেছে। বাকি ৯২ হাজার ২৯৩ টন সারই পড়েছিল মংলা বন্দরে। এ নিয়ে গত ১ আগস্ট খুলনার বিএডিসি দপ্তর থেকে জাহাজের সার দ্রুত পরিবহন প্রসঙ্গে পোটন ট্রেডার্সকে চিঠি দেয়া হয়।
চিঠিতে বলা হয়, ‘বিএডিসির আমদানিকৃত এমওপি সার পরিবহন ঠিকাদার হিসেবে আপনার প্রতিষ্ঠান নিয়োজিত আছে।
পরিবহন তথ্যানুযায়ী দেখা যায়, আপনার প্রতিষ্ঠান ৩১ জুলাই পর্যন্ত এক কোটি ২৫ লাখ ৩৪৪ টনের বিপরীতে ৩৩ হাজার টন পরিবহন করেছে। আপনার প্রতিষ্ঠানের হেফাজতে পশ্চিমাঞ্চলের বিপরীতে
এখনো ৯২ হাজার ২৯৩ টন এমওপি সার পরিবহনাধীন আছে। এ ছাড়া চারটি জাহাজের পরিবহন কর্মসূচির কোনো এমওপি সারই পরিবহন করেননি, যা মোটেও কাম্য নয়।
এদিকে, মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন অঞ্চলে এমওপি সারের সরবরাহ না পেয়ে ডিলার তথা কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সময়মতো এমওপি সার না পাওয়ায় সংস্থার ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এসব বিষয় বিবেচনা করে দ্রুততার সাথে অবশিষ্ট এমওপি সার পরিবহন সম্পন্ন করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।
তবে আপাতত পোটন ট্রেডার্স গুদামে সার দেয়া শুরু করেছে বলে জানা গেলেও একই অভিযোগ রয়েছে কৃষ্টিয়া ট্রেডিং নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, পোটন ট্রেডার্স ৯২ হাজার টনের বিপরীতে এখন প্রায় ৭৩ হাজার টন পরিবহন বাকি আছে। আর কুষ্টিয়া ট্রেডিংও সঠিক সময়ে সার সরকারি গুদামে পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ১২ হাজার টন সার পরিবহনের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত ছয় হাজার টন গুদামে পৌঁছে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
শুধু এই দুই প্রতিষ্ঠান নয়, পরিবহন ঠিকাদারি আরো একাধিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। এদিকে পোটন ট্রেডার্সের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ নতুন নয়। বিগত বছরগুলোতেও এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সার গায়েব নিয়ে মিডিয়ায় ফলাও করে খবর প্রকাশিত হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির মালিক প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে জানা গেছে।
সামপ্রতিক সময়ে এমনিতেই ইউরিয়া সারের দাম বাড়িয়েছে সরকার। বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দামও। অন্যান্য সেক্টরের মতো এর প্রভাব পড়েছে কৃষি সেক্টরেও। শুধু ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ছয় টাকা বাড়ানো হলেও অন্যান্য সারের দামও বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আমদানি সার দেশে পৌঁছলেও সঠিক সময়ে সরকারি গুদামে না পৌঁছানোর সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন ব্যবসায়ীরাও।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম দেশে পর্যাপ্ত সারের মজুত রয়েছে জানিয়ে কেউ যাতে সারের কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে ও দাম বেশি নিতে না পারে সে বিষয়ে তদারকি জোরদার ও নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ডিলাররা যেন বরাদ্দকৃত সার যথাসময়ে উত্তোলন করে তা নিশ্চিত করার জন্য ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত মনিটরিং জোরদার করা। কোনো কোনো ডিলার বরাদ্দকৃত সার যথাসময়ে উত্তোলন না করার কারণে সার বিক্রির সময় রেশনিং করে থাকেন যা সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত।
এর ফলে মাঠপর্যায়ে কৃষকের মাঝে এক ধরনের কৃত্রিম আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। কোনো ডিলার যেন নিয়মবহির্ভূতভাবে সার বিক্রিতে রেশনিং না করতে পারেন সে জন্য ডিলারদের সতর্ক করাসহ তদারকি বৃদ্ধি করা। এছাড়াও রশিদ ছাড়া যেন সার বিক্রি না হয় তাও নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন তিনি। ডিলার ও খুচরা বিক্রেতার দোকানে লালসালুতে বা ডিজিটালি সারের মূল্য তালিকা টানিয়ে রাখতে হবে। ডিলারে গুদাম ভিজিট করে সারের অ্যারাইভাল নিশ্চিত করতে হবে।
জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের সাথে কৃষি বিভাগ নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করবে এবং নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হবে। অধিক মূল্যে সার বিক্রির কোনো তথ্য বা সংবাদ পাওয়া গেলে সাথে সাথেই তা রিপোর্ট করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট ডিলারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলে নির্দেশ দেন তিনি।
এদিকে সারের সংকট রোধে সচিবের নির্দেশনা অনুযায়ী ইতোমধ্যে সারা দেশে সক্রিয় হয়ে উঠেছে মাঠ প্রশাসন। গতকাল বুধবার নওগাঁর সাপাহারে সার বিক্রিতে অনিয়মের দায়ে এক ডিলার ও খুচরা বিক্রেতাকে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করে উপজেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
উপজেলার আইহাই ইউনিয়ন ও পাতাড়ী ইউনিয়নে সারের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে মোবাইল কোর্টের অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসময় একজন বিসিআইসি ডিলার ও এক খুচরা বিক্রেতাকে জরিমানা করা হয়। অভিযানে উপজেলার আইহাই ইউনিয়নের মেসার্স দেলোয়ার ট্রেডার্সকে নিবন্ধন গ্রহণ ছাড়াই বিভিন্ন প্রকার সার ও কীটনাশক আমদানি, সংরক্ষণ ও বিক্রয়ের দায়ে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
এছাড়া পাতাড়ী ইউনিয়নের মেসার্স ওশান ট্রেডার্সকে সার মজুত রাখা ও নির্ধারিত ইউনিয়নে কৃষকের কাছে বিক্রি না করে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রির দায়ে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। একই দিন মূল্য তালিকা না থাকায় শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী সদর বাজারের শিমুল মিয়ার সারের দোকানে আড়াই হাজার টাকা ও কুচনীপাড়া বাজারের সোহান মিয়ার সারের দোকানে আড়াই হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
পাশাপাশি তাদের সতর্ক করা হয় যেন ভবিষ্যতে এমন অপরাধ আর না করে। একই সাথে ব্যবসায়ীদের নিয়মিত পণ্যের মূল্য তালিকা হালনাগাদ করা এবং পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ে পাকা রশিদ সংরক্ষণ করার আহ্বান জানান অভিযানে অংশ নেয়া কর্মকর্তারা। উপজেলা কৃষি অফিসার জানান, সার ক্রয়ের আগে ক্রেতা অবশ্যই ক্রয় রসিদ সংগ্রহ করবেন।
সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকও বলেন, ‘দেশে সারের কোনো ঘাটতি নেই। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত চাহিদার অতিরিক্ত সারের মজুদ রয়েছে। আমরা এখন আগামী বোরো মৌসুমের জন্য সার সংগ্রহ করছি। তারপরও কিছু ডিলার ও অসাধু ব্যবসায়ী স্থানীয়ভাবে দাম বাড়িয়ে অস্থিরতা তৈরি করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় মাঠ প্রশাসনের পাশাপাশি সংকটের কারণ উদ্ঘাটনে মাঠে নেমেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাও। সার ডিলার ও বিএডিসি এবং কৃষি সমপ্রসারণ কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করেছেন তারা।
গোয়ান্দা সংস্থার একটি সূত্র জানায়, সার সংকটের কারণ চিহ্নিত করতে তারা মাঠে কাজ করছে। সংশ্লিষ্ট সবার সাথে কথা বলছে। এর পেছনে কারা রয়েছে, তা বের করার চেষ্টা চলছে।