আগস্ট ৩০, ২০২২, ০২:৪২ এএম
দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতিতে দিশাহারা দেশের মানুষ। নিম্নবিত্ত শ্রেণি আগে থেকেই খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছে। তবে সাম্প্রতিক চাপ বড় ধাক্কা দিয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে। জীবন ধারণের লড়াইয়ে একের পর এক চলছে কাটছাঁট। আগে বিনোদন ও শখ বাদ দিলেও এখন সরাসরি প্রভাব খাদ্য তালিকায়। মাছ-মাংস ও ফলমূল কেনা বাদ দিয়েছেন অনেকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির চাপে দ্রুতই কমছে ক্রয়ক্ষমতা। কিন্তু সরকার প্রকাশিত অর্থনৈতিক সূচকগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় দেশের অধিকাংশ আর্থিক সূচক এখন ঊর্ধ্বমুখী।
অভূতপূর্ব অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি একেরপর এক চোখ ধাঁধানো মেগা প্রকল্প দেখে বুঝাই যাচ্ছে না দেশের বড় জনগোষ্ঠীের দৈনন্দিন খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান মাথাপিছু আয়ের বিপরীতে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়াকে চরম আর্থিক বৈষম্য বললেন অর্থনীতিবিদরা।
সরকারি হিসাবে, মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার। দেশীয় মুদ্রায় (বর্তমান বিনিময়মূল্য ৯৫ টাকা হিসাবে) এর পরিমাণ দাঁড়ায় দুই লাখ ৬৮ হাজার ২৮০ টাকা।
অর্থাৎ একজন মানুষের দৈনিক আয় ৭৩৫ টাকা। বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারের দৈনিক খাবার খরচ সাত শতাধিক টাকা। কিন্তু মাথাপিছু হিসাবে পাঁচজনের দৈনিক আয় তিন হাজার ৬৭৫ টাকা।
অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরের সামগ্রিক হিসাবে মাথাপিছু আয় এক বছরের ব্যবধানে ২৩৩ ডলার বেড়েছে। আগের অর্থবছর শেষে মাথাপিছু আয় ছিল দুই হাজার ৫৯১ ডলার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৮২৪ ডলারে উঠলেও বাস্তবে দেশের প্রতিটি মানুষের আয় তা নয়। কারণ, মাথাপিছু আয় কোনো ব্যক্তির একক আয় নয়। দেশের অভ্যন্তরের আয়ের পাশাপাশি রেমিট্যান্সসহ যত আয় হয়, তা দেশের মোট জাতীয় আয়। সেই জাতীয় আয়কে দেশের জনসংখ্যা দিয়ে মাথাপিছু ভাগ করে এ আয়ের হিসাব করা হয়।
এরফলে দেশে মাথাপিছু আয় বাড়লেও তাতে ব্যক্তির আয়ে কোনো তারতম্য হয় না। বাস্তবতা হলো দেশে এক শ্রেণির মানুষের আয় বাড়লেও সামগ্রিকভাবে সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। তাই একদিকে যেমন মাথাপিছু আয় বাড়ছে অপরদিকে ব্যক্তি পর্যায়ে আয় না বাড়ার পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ক্রমেই কমছে ক্রয়ক্ষমতা।
এর অন্যতম কারণ উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষ একই বাজারে কেটাকাটা করেন। সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতির চাপে দৈনন্দিন খরচের ক্ষেত্রে অন্যসব বাদ দিলেও শুধু খাবার খরচই বেড়েছে ৭৮ শতাংশ। সে অনুপাতে আয় বাড়েনি কারোই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের ২০২১ সালের একটি জরিপ অনুযায়ী, উচ্চমাত্রায় সক্রিয় একজন মানুষের খাদ্যতালিকায় দৈনিক ৩৩৩ গ্রাম চাল, ৩৯ গ্রাম আটা, ৫০ গ্রাম আলু, ৬০ গ্রাম ডাল, ৪৫ গ্রাম ভোজ্যতেল ও ২৫ গ্রাম চিনি দরকার।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারির বাজারদরের তালিকা অনুযায়ী, তখন একজন শ্রমিকের এক দিনের খাদ্যের জন্য এসব পণ্য পরিমাণ মতো কিনতে ব্যয় হতো ২৩ টাকার কিছু কম। টিসিবির ২৮ আগস্ট ২০২২-এর বাজারদর অনুযায়ী খরচ হয় প্রায় ৪১ টাকা।
অর্থাৎ খরচ বেড়েছে ৭৮ শতাংশেরও বেশি। এই জরিপে শ্রমিকের খাদ্য তালিকায় এসব পণ্য ছাড়াও বীজজাতীয় খাদ্য, শাক, কলা, মাছ, দুধ ও কাঁঠালের বীচি রয়েছে। সব মিলিয়ে তালিকায় ১৪টি পণ্য রয়েছে, যা দুই হাজার ৩০০ ক্যালরি খাদ্যশক্তির সমান।
জরিপ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২১ সালে জরিপকালে একজন শ্রমজীবীর এক দিনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম ছিল ১২৪ টাকা। মাঝারি মাত্রায় সক্রিয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যয় ছিল ৬৮ টাকা আর কম সক্রিয় মানুষের ক্ষেত্রে ব্যয় দেখানো হয়েছিল ৫৬ টাকার কিছু বেশি। শিশুদের বয়সভেদে ৩৩ থেকে ১২১ টাকার খাদ্যের দরকার ছিল ২০২১ সালে।
সব মিলিয়ে দেখা যায়, পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারে ২০২১ সালে খাদ্যের ব্যয় ছিল দিনে প্রায় ৪০০ টাকা। খাদ্য পণ্যের মধ্যে রয়েছে চাল, আটা, ডাল, ভোজ্যতেল, শাকসবজি, মাছ, কম দামি ফল, ডিম, দুধ ইত্যাদি। বাংলাদেশে সহজে পাওয়া যায় এবং দাম কম, এমন খাদ্য ওই তালিকায় রাখা হয়েছে। বর্তমানে সমপরিমাণ খাদ্যের জন্য ব্যয় হচ্ছে ৭০০ টাকার বেশি।
এমন প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা দ্রুতই কমে যাচ্ছে বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। আমার সংবাদকে তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ছে সে অনুপাতে সবার আয় বাড়ছে না।
কারণ বেশির ভাগ মানুষ নির্ধারিত বেতনে কাজ করে। ফলে তাদের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মান কমে যাচ্ছে। আর যারা কিছু সঞ্চয় ব্যাংকে রেখেছে তারা যে ৬ শতাংশ সুদ পাচ্ছে তাতে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলা করা যাচ্ছে না। তাই সঞ্চয় ভেঙে জীবন চালিয়ে নিচ্ছে।
অন্যদিকে আয় বৈষম্যের মাত্রা অসহনীয় হয়ে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির অসহনীয় চাপের মধ্যেও দেশে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে। তাই মাথাপিছু আয় বাড়লেও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।’
গত ২২ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে কমপক্ষে এক কোটি টাকা আছে এমন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বেড়েছে ৯ হাজার ৩২৫টি। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত অন্তত এক কোটি টাকা রয়েছে— এমন ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ তিন হাজার ৫৯৭টি, যা ২০২১ সালের মার্চ শেষে ছিল ৯৪ হাজার ২৭২টি। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের শেষে কোটি টাকা রয়েছে, এমন ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল এক লাখ এক হাজার ৯৭৬টি।
অর্থাৎ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মুদ্রাস্ফীতির হুমকি সত্ত্বেও চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দেশে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়েছে এক হাজার ৬২১টি। অথচ ২০২০ সালের মার্চ মাসে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এক কোটি টাকার বেশি আছে— এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫টি।