Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ০৬ নভেম্বর, ২০২৪,

প্রচারেই সীমাবদ্ধ শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ

বেলাল হোসেন

আগস্ট ৩০, ২০২২, ০২:৫৪ এএম


প্রচারেই সীমাবদ্ধ শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ

মানবদেহে ঘাতক ব্যাধি হিসেবে বাসা বাঁধছে শব্দদূষণ। প্রতিনিয়ত মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণের কারণে রাজধানীতে সাধরণ জনগণ অতিষ্ঠ। ঢাকা শহরের অধিকাংশ জায়গায় নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে বাড়তি মানসিক চাপ ও ধৈর্যহীনতা, বাড়াচ্ছে স্ট্রোকের ঝুঁকি।

স্কুলগামী শিশুরা বেশি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ভবিষ্যতে শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলছে অনেকেই। লাখ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ইট-পাথরের বড় বড় অট্টালিকা, মেগা প্রজেক্ট আর জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা।

এতে করে রাজধানীর বায়ু এবং শব্দদূষণ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ ছাড়াও বিয়ের অনুষ্ঠানে ডিজে পার্টিসহ নানা সামাজিক-রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে উচ্চশব্দে মাইকে গান বাজানো সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের প্রত্যেক মাসেই রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন দিবস, জন্মদিন, মৃত্যুবার্ষিকীতে দিন-রাত উচ্চশব্দে মাইক বাজালেও তার প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না কেউ। শীতকাল এলেই এলাকাভিত্তিক ওয়াজ মাহফিল ও কীর্তনে বাজানো হয় উচ্চশব্দে মাইক।

এরফলে ভয়ঙ্কর শব্দদূষণের মধ্যে আমাদের বসবাস। ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে ঢাকা নগরী। বেশ কিছু বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে। সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় বায়ু ও শব্দদূষণের বিষয়টি দেখভাল করে থাকে।

এর সাথে জড়িত সরকারের বেশ কয়েকটি স্টেক হোল্ডার (সরকারি-স্বায়ত্তশাসিত দপ্তর)। এসব সংস্থা থেকে বেশ কিছু নীতিমালা থাকলেও বাস্তবে কোনো প্রয়োগ নেই বলে অভিযোগ করছেন সাধারণ জনগণ।

পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে রাজধানীর বেশ কিছু স্পটকে ‘হর্ন মুক্ত নীরব এলাকা’ ঘোষণা করা হলেও ওই সব এলাকায় যানবাহনের চালকরা বেশি হর্ন বাজান। অথচ বড় অক্ষরে সাইনবোর্ড দেয়া ‘নীরব এলাকা, হর্ন বাজানো নিষেধ এবং দণ্ডনীয় অপরাধ’। প্রশাসনের সর্বোচ্চ এলাকা সচিবালয়ের আশপাশ নীরব এলাকা ঘোষণা করা হলেও নেই কোনো ব্যবস্থা।

সাইনবোর্ড আর কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ ঘোষণা। সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে বলা হচ্ছে— জোর করে, শাস্তি দিয়ে, না হলে এর জন্য বেশি বেশি জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। যানবাহনের চালকদের ট্রেনিং দিয়ে অতিরিক্ত মাত্রায় হর্ন বাজালে কী ক্ষতি হয়— সে বিষয়টি তুলে ধরতে হবে।

অপরদিকে বেসরকারি সংস্থা, সুশিল সমাজ বলছে, সরকারের আইনের প্রয়োগ সঠিকভাবে প্রতিপালন, প্রয়োজনে শাস্তি বাড়িয়ে নীতিমালা পরিবর্তন করতে হবে। তাহলে যত্রতত্র হর্ন বাজানো কমে যাবে। মাঝে মাঝে রাজধানীতে পরিবেশ অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নেতৃত্বে হর্নবিরোধী অভিযান চালানো হয়। যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বলে অভিযোগ করেছেন সাধারণ মানুষ। এই অভিযানে তেমন কোনো ফল আসছে না। অভিযানের কিছুপর থেকে আবারো শুরু হয়ে যায় সেই ভয়ংকর শব্দদূষণ।

চলতি বছরে বিশ্বের দূষিত বায়ুর দেশের তালিকার শীর্ষ স্থানে নাম আসে বাংলাদেশের। সে রেশ কাটতে না কাটতেই শব্দদূষণে ঢাকার শীর্ষস্থান দখল নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

সম্প্রতি জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) বিশ্বের ৬১ শহরের শব্দদূষণের মাত্রা বিশ্লেষণ করে করা ‘ফ্রন্টিয়ার্স-২০২২ : নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে— শব্দদূষণে বিশ্বে ঢাকা এখন শীর্ষস্থান দখলকারী শহর। ঢাকার পরই দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে ভারতের মুরাদাবাদ ও পাকিস্তানের ইসলামাবাদ।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, শীর্ষে অবস্থানকারী পাঁচটি শহরের চারটি-ই দক্ষিণ এশিয়ার। যার মধ্যে আবার দুটিই বাংলাদেশের। ঢাকা ছাড়া অন্যটি চতুর্থ অবস্থানে থাকা রাজশাহী। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫৫ ডেসিবল।

আর বাণিজ্যিক এলাকায় তা ৭০ ডেসিবল। অথচ ঢাকায় এই মাত্রা ১১৯ ডেসিবল ও রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবল। সুতরাং ঢাকা ও রাজশাহীর শব্দের তীব্রতা যে কত ভয়াবহ অবস্থায় আছে তা এ প্রতিবেদন থেকে সহজেই অনুমেয়। রিপোর্টে বাংলাদেশের আরও একটি শহরের কথা উঠে এসেছে— টাঙ্গাইল। যেখানে শব্দের তীব্রতা ৭৫ ডেসিবল। এটি শীর্ষ পাঁচ বা শীর্ষ দশে না থাকলেও একটি দেশেরই তিনটি শহর শব্দদূষণের তালিকায় থাকা কম উদ্বেগের বিষয় নয়।

শব্দের স্বাভাবিক বা সহনীয় মাত্রা ৫৫ থেকে ৬০ ডেসিবল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৬০ ডেসিবলের অধিক শব্দ যদি দীর্ঘসময় ধরে থাকে তাহলে সাময়িক বধিরতা আর ১০০ ডেসিবলের বেশি হলে স্থায়ী বধিরতা হতে পারে। উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস, বধিরতা, হূদরোগ, মেজাজ খিটমিটে হওয়া, আলসার, হাইপার টেনশন, মাথাব্যথা, স্মরণশক্তি হ্রাস, স্নায়ুর সমস্যা ও বিরক্তিভাব তৈরি হতে পারে। শিশু এবং বয়স্কদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, যদি তিন বছরের কম বয়স্ক শিশু কাছাকাছি দূরত্ব থেকে ১০০ ডেসিবল মাত্রার শব্দ শোনে, তাহলে সে তার শ্রবণক্ষমতা হারাতে পারে। শুধু তাই নয়, এ কারণে গর্ভবতী মায়েদের গর্ভের সন্তান বিকলাঙ্গ হওয়াসহ অন্যান্য ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আছে বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।

সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর (ইএনটি) ডা. হুসনে কমর ওসমানী তার এক গবেষণায় জানান, ট্রাফিকে কর্মরত কয়েকজন পুলিশ এবং যারা ট্রাফিকে নেই এদের মধ্যে শব্দ শোনার ক্ষেত্রে কিছুটা তারতম্য লক্ষ করা যায়। এর মূল কারণ হচ্ছে শব্দদূষণ। ট্রাফিক পুলিশের মধ্যে উচ্চরক্ত চাপও লক্ষ করা গেছে।

তিনি বলেন, জার্মান সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রকৃতি থেকে উৎপাদিত শব্দ-পাতা, জল, পাখির গান ইত্যাদি মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রশান্তি দেয়।

অপরদিকে, মনুষ্য সৃষ্ট শব্দ হূৎপিণ্ডের গতি বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও শব্দদূষণ ছোট শিশুদের ভাষা শিক্ষার ওপর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।’ ডা. হুসনে কমর আরো বলেন, ‘রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে যানবাহন ও শহর উন্নয়নের কারণে সৃষ্ট অতিরিক্ত শব্দদূষণে পেশাজীবীরা মানসিক অসুস্থতায় ভোগেন।’

তিনি বলেন, ‘যান্ত্রিক জীবন দিন দিন আমাদেরকে প্রকৃতির কাছ থেকে দূরে সরে দিচ্ছে। এর থেকে বাঁচতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।’ বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ এর ক্ষমতাবলে শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই আইনের প্রয়োগ তেমন একটা দেখা যায় না।

এ বিষয়ে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘আইন যদি প্রয়োগ না করা হয় তাহলে তো আইনের কোনো ফলাফল আসে না। আইনের উদ্দেশ্য ছিল শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আইনটা যারা প্রয়োগ করবে তাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি আইন প্রয়োগ না হয় তাহলে তো লাভ হবে না এটি বইয়ে বা কিতাবেই থেকে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘আইন প্রয়োগ হয় না দেখেই শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।’

অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘শুধু জনসচেতনতা বাড়ালেন এতে করে তো যাদের বোধোদয় হওয়া দরকার তারা যদি সচেতন না হয় এ ক্ষেত্রে তো আইন প্রয়োগের বিকল্প নেই। এ থেকে মানুষের মনে একটা মেসেজ দিতে হবে যে, শব্দদূষণ করলে তাকে লিগ্যাল বিষয় ফেস করতে হবে। বর্তমান আইনে যে বিধানগুলো আছে সেগুলোতে একটু দুর্বলতা থাকার কারণে হয়তো সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না।’ এ আইনটিকে আরো কঠিন করে করা দরকার বলে মনে করেন এ সিনিয়র আইনজীবী।

তিনি বলেন, ‘শব্দদূষণে রাস্তা-ঘাটে সাধারণ পুলিশ যেন এর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে তার ব্যবস্থা থাকা দরকার। যাতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আমার সংবাদকে বলেন, ‘শব্দদূষণের কতগুলো নির্দিষ্ট ক্ষেত্র আছে। যে ক্ষেত্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। এগুলো হলো— কনস্ট্রাকশন কাজ, জেনারেটর চালানো— সঠিক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘সেই সাথে যানবাহনের হর্ন বাজানোর ক্ষেত্রে মানুষের মাঝে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন দরকার। সেটি মাথায় রেখে বিশেষজ্ঞ দিয়ে প্রচারণা চালাতে হবে, হর্ন ছাড়াও যে গাড়ি চালানো যায়— তা চালকদের মাথায় ঢুকাতে হবে।’

আইন প্রয়োগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আইনের প্রয়োগও জনসচেতনতার একটি হাতিয়ার।’ ওরস্যালাইন-ভ্যাকসিনের প্রচার যেভাবে সফল হয়েছে, হর্ন ব্যবহারের ক্ষেত্রে সেভাবে প্রচার ও আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলেও জানান তিনি।

এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘দেশের উন্নয়নে বিভিন্ন জায়গার পাশাপাশি পরিবেশও গুরুত্ব পাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ দূষণের যতগুলো কম্পোনেন্ট আছে বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ প্রত্যেকটা কম্পোনেন্টে আমরা সমভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘শব্দ যে একটা দূষণ— এটাই তো মানুষ জানত না। আমরা শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারিত্বমূলক প্রকল্পের মাধ্যমে কিছু মানুষকে বোঝাতে পেরেছি যে, শব্দদূষণ একটি নীরব ঘাতক, ক্ষতিকারক।’

পরিবেশ সচিব বলেন, ‘বর্তমানে যে পর্যায়ে আছে, শব্দদূষণের উৎস যানবাহনের ড্রাইভার তারা তো নিজেরাই নিজের ক্ষতি করছেন। এখানে তো সচেতনতা ছাড়া, শিক্ষা ছাড়া কোনো উপায় নেই।’ তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে ড্রাইভারদের বাঁচাতে তাদের ওপর আইন ফোর্স করে লাভ হবে, তার শিক্ষা প্রয়োজন— তাকে সচেতন করতে হবে।’

বিদেশের কথা উল্লেখ করে সচিব বলেন, সেখানে রাস্তার এক পাশ থেকে অন্য পাশের লোক ডাকতে রাস্তা পার হয়ে লিমিট রেখে স্বাভাবিক একে অন্যের সাথে কথা বলেন। আমাদের দেশে কি এটি সম্ভব? সবাই তো চিৎকার করে ডাকতে থাকেন। আসলে এগুলো সচেতনতার মাধ্যমে আস্তে আস্তে গড়ে তুলতে হবে।’   

Link copied!