Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ০৬ নভেম্বর, ২০২৪,

দাম কমলেও স্বস্তি নেই জনমনে

মহিউদ্দিন রাব্বানি

আগস্ট ৩১, ২০২২, ০৯:৫৫ এএম


দাম কমলেও স্বস্তি নেই জনমনে

উল্লম্ফন গতিতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেও কমেছে নামমাত্র। এক লাফে ৫২ শতাংশ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষের জীবনে ভয়াবহ দুর্দশা নেমে আসে। এতে প্রভাব পড়েছে কৃষি, পরিবহনসহ নিত্যপণ্যের ওপর। ২৩ দিনের মাথায় দাম সমন্বয়ের নামে লিটারে পাঁচ টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এমন অপ্রতুল দাম কমায় স্বস্তি নেই জনমনে। এ যেন গরু মেরে জুতা দান!

জ্বালানি তেলের দাম এত অল্প কমাতে সাধারণ মানুষ কোনো সুবিধা পাবে কি-না এ ব্যাপারে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরাও। কারণ, এত অল্প কমালে পরিবহন ব্যয় কমবে বলে মনে করছে না তারা। আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করে ১০ শতাংশের মতো কমানো গেলে সবার জন্য ভালো হতো।

তেলের দাম পাঁচ টাকা কমানোর ফলে পণ্যের দাম বা পরিবহন ভাড়া কমবে কি-না মূলত তার ওপর নির্ভর করছে সাধারণ মানুষের সুবিধা। যদি সরকার এই দাম কমানোর পাশাপাশি এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি করতে পারে, তাহলে লাভ হতে পারে। না হলে এই টাকা ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে যাবে। প্রসঙ্গত, গত রোববার ডিজেলের আগাম কর অব্যাহতি ও আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।

এরপর সোমবার দুপুরে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তেলের দাম কমানোর ইঙ্গিত দেন। রাতে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কেরোসিন, ডিজেল, পেট্রল, অকটেনের দাম লিটারে পাঁচ টাকা কমানেরা ঘোষণা দেয় সরকার। এদিকে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের এখতিয়ার রয়েছে শুধু বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি)। অথচ মানা হচ্ছে না প্রটোকল। সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি কিংবা কমানোর ক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) পাশ কাটিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো জ্বালানি তেলের দাম বাড়াচ্ছে এবং কমাচ্ছে। বিপুলহারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর এখন যতটুকু ন্যায্যভাবে দাম কমানোর প্রয়োজন তাও কমানো হলো না। এদিকে দাম কমলেও ভোক্তাপর্যায়ে সব ক্ষেত্রে সুবিধা পাবে না মন্তব্য করেন এক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। সেই আস্থা নেই ভোক্তাদেরও। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও দেশে ডলার রিজার্ভ সংকট ও টাকার সর্বোচ্চ দরপতনে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সরকার। পাঁচ আগস্ট পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই মধ্যরাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয় ৫২ শতাংশ।  

ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটার প্রতি ৮০ টাকা থেকে ১১৪ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ এই দাম বৃদ্ধির হার প্রায় ৪২ শতাংশ। লিটার প্রতি পেট্রলের দাম ৮৬ টাকা থেকে ১৩০ টাকা করা হয়েছে। অকটেনের দাম বেড়েছে ৮৯ টাকা থেকে ১৩৫ টাকা। অর্থাৎ পেট্রল ও অকটেনের ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির হার ৫০ শতাংশেরও বেশি।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী তখন বলেছেন, অনেকটা নিরুপায় হয়েই কিছুটা অ্যাডজাস্টমেন্টে যেতে হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সে অনুযায়ী জ্বালানি তেলের মূল্য পুনর্বিবেচনা করা হবে। সে ধারাবাহিকতায় অবশেষে ডিজেলের আগাম কর মওকুফ এবং আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

এর ফলে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) ও অন্য ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হ্রাসকৃত শুল্ক হারে ডিজেল আমদানি করতে পারবে। সে হিসাবে গত সোমবার রাতে এক বিজ্ঞপ্তিতে জ্বালানি তেলের দাম পাঁচ টাকা কমিয়েছে সরকার।

গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকে। বিশ্ববাজারে ডিজেলের দাম ব্যারেলপ্রতি (১৫৯ লিটার) ১৭০ মার্কিন ডলার উঠেছিল। এটি কমে ১৩৪ ডলারে আসার সময় দেশে জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে। গত রোববার ডিজেলে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। আর ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহার করা হয়েছে।

জ্বালানি তেলের দাম পাঁচ টাকা কমানোকে ‘গরু মেরে জুতা দান’ বলেছেন বলে এক অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান (মান্না)। তিনি বলেন, প্রতি লিটারে প্রায় ৫০ শতাংশ দাম বাড়িয়ে ৩ শতাংশ দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এটি নিছক প্রতারণাকারী ব্যবসায়ীর মতো ৪০ টাকা দাম বাড়িয়ে পাঁচ টাকা ছাড় দেয়া।

এদিকে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সূত্র মতে, সব ধরনের কর প্রত্যাহার করলে প্রতি লিটার ডিজেলের মূল্য কম করে হলেও ৩৬ টাকা কমানো সম্ভব। কারণ, বর্তমানে লিটারপ্রতি ১১৪ টাকার ডিজেল থেকে ৩৬ টাকা কর আদায় করছে সরকার। অথচ দাম কমলো মাত্র পাঁচ টাকা।

চলতি মাসে দুইবার জ্বালানি তেলের দাম উঠানামা করলেও বিইআরসি নীরব। এ যেন এক নিষ্প্রাণ প্রতিষ্ঠান। দাম নির্ধারণে নেই তার কোনো ক্ষমতা। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ক্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম আমার সংবাদকে বলেন, রাষ্ট্রের আইন পরিষদ, সংসদীয় কমিটি বিপিসির বিরুদ্ধে দুর্নীতি তুলে ধরেছে। কিন্তু মন্ত্রী, সচিবরা এ বিষয়ে কোনো কথা বলছেন না। বিপিসি ইতোমধ্যেই নিজেদের ইচ্ছেমতো মুনাফা তুলে নিয়েছে। জ্বালানি মন্ত্রণালয় নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে নিয়েছে, আবার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বিইআরসিতে গণশুনানির জন্য আসেনি। এখন আবার দাম কমানোর ক্ষেত্রে যতটুকু ন্যায্যভাবে কমানোর দরকার তা কমাতে পারবে— সেই আস্থা ভোক্তাদের নেই।

তিনি বলেন, বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো জ্বালানি তেলের দাম বাড়াচ্ছে এবং কমাচ্ছে সরকার। তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যেখানে যতটুকু প্রভাব পড়ার প্রয়োজন ছিল তা পড়েনি। কিন্তু দাম বাড়ানোর প্রভাব সব ক্ষেত্রেই পড়েছে। সরকারের রাজস্ব বেড়েছে, কোম্পানিগুলোর মুনাফা বেড়েছে। যে সময়ে যতটুকু বাড়ানোর প্রয়োজন তারা বিইআরসিতে আসবে, প্রস্তাব দেবে, গণশুনানি হবে এবং সেখানেই সিদ্ধান্ত হবে।

কিন্তু মন্ত্রী ও সচিব বলছেন, কত বাড়তে পারে, কত কমতে পারে। তাদের তো এটা বলার এখতিয়ার নেই, বিইআরসিতে আসলে তারা যা কমাতে বলছেন তার চেয়ে বেশিও কমতে পারে আবার কমও কমতে পারে, বেশিও বাড়তে পারে, আবার কমও বাড়তে পারে। কিন্তু তারা গোপনে দাম বাড়াচ্ছে আর কমাচ্ছে। তারা বিভিন্ন সময়ে বিইআরসিতেও প্রভাব খাটিয়ে সুবিধা নিয়েছে, এখন তেলের ক্ষেত্রে সরাসরি সুবিধা নিচ্ছে।

বিপিসি ২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ৯ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির করেছিল। তা দেখে স্তম্ভিত হয়েছে সবাই। পরবর্তী সময়ে গত ১৩ বছরে আরও বেশি দুর্নীতি হয়েছে, কত টাকা আত্মসাৎ করেছে। কোনো কন্ট্রোলার জেনারেলের মাধ্যমে অডিট করা হচ্ছে না। বিপিসির ১৬টি প্রতিষ্ঠানে ২৫ হাজার কোটি টাকা জমা হয়েছে ইতোপূর্বে। কিন্তু তারা এফডিআর করে কীভাবে তারা? এর মানে হচ্ছে এই টাকা তারা খরচ করবে না। এই ভয়াবহ অবস্থার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না!

এদিকে জ্বালানি তেলের দাম কমায় ভোক্তাপর্যায়ে কতটুকু সুবিধা পাবে তা নিয়ে শঙ্কিত অনেকে। এত অল্প দাম কমানোতে সাধারণ মানুষ কোনো সুবিধা পাবে কিনা সেটা বোঝা কঠিন এখন। কারণ, এত অল্প কমালে পরিবহন ব্যয় কমবে বলে মনে হচ্ছে না। তেলের দাম পাঁচ টাকা কমানোর ফলে পণ্যের দাম বা পরিবহন ভাড়া কমবে কিনা, তার ওপর নির্ভর করছে সাধারণ মানুষের সুবিধা।

দাম কমানোর ঘোষণার পর একজন মোটরসাইকেল চালক জানান, দিনে তার দুই লিটার তেলের প্রয়োজন হয়, সেই হিসাবে প্রতিদিন তার ১০ টাকা সাশ্রয় হবে। একইভাবে একজন প্রাইভেট গাড়ির মালিক জানান, দিনে গড়ে তার তেল প্রয়োজন হয় পাঁচ লিটার। দাম কমানোর পর এখন তার প্রতিদিন ২৫ টাকা সাশ্রয় হবে। তবে দূরপাল্লার পরিবহন বা গাড়িতে সাশ্রয় আরও বেশি হবে বলে জানা যায়। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে সড়ক ও নৌপথের সব ধরনের পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছিল। এই অজুহাতে কাঁচা বাজার থেকে শুরু করে মুদিপণ্যসহ সব পণ্যের দাম পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন দাম কমার ফলে পরিবহন ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করা হবে কি-না এ নিয়ে বিভ্রান্তিতে আছে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ। কারণ স্বল্প দাম হ্রাসে কতই বা কমবে!

Link copied!