সেপ্টেম্বর ১১, ২০২২, ০৪:৪০ এএম
পুরুষরাই বেশি অপরাধ করে আর নারীদের অপরাধপ্রবণতা কম— একটা সময় সমাজের মানুষের এমন ধারণা থাকলেও বাস্তবে ধারণার বাইরেই ধীরে ধীরে অপরাধপ্রবণতায় জড়িয়ে পড়ছেন নারীরা। এ ক্ষেত্রে পুরুষকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছেন নারীরা। হত্যা, নির্যাতন, চুরি-ছিনতাই, অপহরণ, অস্ত্র বহন, মাদক কারবার ও প্রতারণাসহ সব অপরাধেই জড়াচ্ছেন নারীরা। গড়ে উঠছে নারীদের পরিকল্পিত অপরাধচক্রও। দিনে দিনে এ চক্রে বাড়ছে নারী অপরাধীদের সংখ্যাও। দেশের প্রায় প্রতিটি পরিবারেই হরহামেশাই পারিবারিক কলহের ঘটনা ঘটছে। এই কলহকে কেন্দ্র করেও হিংস্র হয়ে উঠছেন নারীরা। ঘটাচ্ছে খুনের মতো ঘটনাও।
সম্প্রতি রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তিতে বিয়ের ১০ মাসের মাথায় ছুরিকাঘাত করে স্বামীকে হত্যা করেন সুমাইয়া নামে এক নারী। পুলিশ জানায়, ওই নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ছুরিটিও উদ্ধার করা হয়েছে। হত্যার কারণ সম্পর্কে পুলিশ জানায়, বিয়ের পর ওই নারী তার স্বামীর আগের একটি সংসার রয়েছে জানতে পেরেই স্বামী শাওন পেদাকে খুন করে। বছরের শুরুর দিকে সাভারেও এক নারী তার স্বামীকে ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে হত্যা করেন। পুলিশ জানায়, জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যাওয়াকে কেন্দ্র করে ঝগড়ার পরই ওই নারী তার স্বামীকে মারতে সন্ত্রাসী ভাড়া করেন। সন্ত্রাসীরাও স্ত্রীর সামনেই স্বামীকে আনোয়ারকে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে হত্যা করে। এমন ঘটনা দেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই ঘটছে এখন।
গত এপ্রিল মাসে রাত ৯টায় মৌচাক মার্কেট থেকে হাসান আলী নামে এক প্রবাসী কেনাকাটা শেষে রিকশাযোগে রামপুরার বাসায় ফেরার পথে রিকশা না পাওয়ার অজুহাতে একই পথে সাথে যাওয়ার অনুরোধ করেন এক নারী। অনেক চিন্তা ভাবনার পর হাসান আলী ওই নারীকে রিকশায় উঠান এবং রামপুরা টিভি সেন্টারের সামনে পৌঁছালেই কয়েকজন যুবক তার রিকশাটি ঘিরে দাঁড়ায়। এ সময় ওই নারী চাকু বের করে সাথে থাকা নগদ টাকাসহ সব দেয়ার কথা বলেন। বাধ্য হয়ে সব দিয়েও দেন হাসান আলী। এ ছাড়াও প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে শুধু শহর-বন্দরই নয়, দেশের মফস্বল এলাকার নারীরা এখন ব্ল্যাকমেইলিং থেকে শুরু করে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতানোর মতো অপরাধেও জড়াচ্ছেন। তবে রাজধানী ঢাকায় বেপরোয়া গতিতে বাড়ছে নারী অপরাধীর সংখ্যা। সচিবালয় থেকে শুরু করে বস্তি পর্যন্ত রয়েছে তাদের অবাধ বিচরণ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা রকম অপরাধ করেও সহজে পার পেয়ে যাচ্ছেন নারীরা। দাপটের সাথে আবার ঘটিয়ে চলছেন অঘটন। নারীদের নতুন নতুন অপরাধের তালিকায় যোগ হচ্ছে তদবির বাণিজ্য, ম্যারেজ মিডিয়ার প্রতারণা, যৌন আবেদন দেখিয়ে প্রতারণা, পকেটমার, জাল টাকা বহনসহ বিভিন্ন ধরনের ভয়ঙ্কর সব অপরাধ। আবার বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়েরাও জড়াচ্ছেন অপরাধকাণ্ডে। সম্প্রতি অনুসন্ধানে জানা গেছে, যাত্রাবাড়ী, বনানীসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেহব্যবসার আড়ালে পুরুষদের জিম্মি করে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করছেন তারা। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পেজ কিংবা গ্রুপ খুলে বিভিন্ন বয়সি পুরুষদের টানছেন তারা। তবে এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। যদিও অধিকাংশ পুরুষ এমন ঘটনার শিকার হলেও সম্মান নষ্টের ভয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হচ্ছেন না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নারী দিয়ে অপরাধ সংঘটন অনেকটাই সহজ। যে কারণে দিনে দিনে বেশি মাত্রায় নারীদের অপরাধ জগতে টানা হচ্ছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরাধ জগতে হাই-সোসাইটির মেয়ের আগমন ঘটছে বেশি। এদের ব্যবহার করা হচ্ছে প্রতারণায়, বিত্তবানদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়ার কাজে। তবে নারীরা অপরাধে জড়ালেও এর নেপথ্যে সক্রিয় রয়েছে সংঘবদ্ধ পুরুষচক্র। গত বছর গ্রেপ্তারের পর নারী অপরাধীদের কাছ থেকে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পায় গোয়েন্দা পুলিশ। মানুষকে প্রতারণার মাধ্যমে তাদের টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়াসহ খুনের মতো অপরাধে জড়িত ওই সব নারী। তাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। রয়েছে অপরাধ করেও ছাড়া পাওয়ার মতো শক্ত খুঁটি, যোগাযোগ রক্ষা করছে প্রশাসনের প্রভাবশালী কর্তাব্যক্তিদের সাথেও। ধরা পড়ার পরও এরা সহজেই বেরিয়ে আসে।
ঢাকার একটি ঘটনায় জানা গেছে, ঢাকার জুরাইনের এক যুবকের সাথে ফোনে পরিচয় ফরিদপুরের মেয়ে লিপির। ফরিদপুর শহরের একটি কলেজে পড়ার সময় ফোনে জুরাইনের ওই যুবকের সাথে পরিচয় হয় তার। পরিবারের অজান্তে গোপনে বিয়েও করেন লিপি।শেষে জড়িয়ে পড়েন অপরাধ জগতের জালে। রাজধানীতে স্বামীকে সাথে করে প্রবাসী পাত্রীর জন্য পাত্র জোগাড়ের ম্যারেজ মিডিয়া খুলে শুরু করেন প্রতারণার ব্যবসা। প্রবাসী পাত্রী সেজে নিজেই কুড়িখানেক পাত্রের সাথে বিয়ের অভিনয় করেন, কোনো কোনো পাত্রের সাথে অল্পদিনের জন্য সংসারও করে। পাত্রকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে চম্পট দেন পাত্রের কাছ থেকে। সর্বশেষে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে আছেন লিপি। গত আগস্টে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে রাজধানীর এক নারী অপরাধী চক্রের সদস্য। পুরুষ সহযোগীসহ ওই নারী অপরাধীর মূল টার্গেট ছিল সমাজের বিত্তবান লোকদের ফাঁদে ফেলে তাদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়া। সুন্দরী এ নারীর টিমে দেখা গেছে একাধিক ক্যামেরাম্যান, ভিডিও ক্যামেরাসহ সংলাপ ধারণের জন্য উচ্চমানের ডিজিটাল টেপরেকর্ডার। ওই চক্রটি সমাজের উপর তলার লোকদের ফোন নম্বর জোগাড় করে তাদের সাথে প্রেমালাপের মাধ্যমে ঘনিষ্ঠ হয়। তারপর যৌন কর্মের প্রস্তাব দিয়ে তাদের আস্তানায় নিয়ে জোর করে পুরুষ লোকটির নানা ধরনের আপত্তিকর ছবি তুলে, ভিডিওচিত্র ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করে। ওই চক্রটির খপ্পরে পড়ে কোটি টাকা খোয়াতে হয়েছে দেশব্যাপী পরিচিত এক ব্যবসায়ী নেতাকেও। বিপুল পরিমাণ টাকা খুইয়েও তিনি চেপে গেছেন লোকলজ্জার ভয়ে। একটি রাজনৈতিক দলের সংসদ সদস্যও ওই নারীচক্রের খপ্পরে পড়েছিলেন। তাকেও গুনতে হয়েছে বড় অঙ্কের টাকা।
এ ছাড়া প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত স্থানেও ঘটেছিল এমন ঘটনা। সরকারের একজন পদস্থ ব্যক্তি এক সুন্দরী নারী তদবিরকারকের খপ্পরে পড়ে তার অনেক অবৈধ কাজ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে। ঢাকায় নারী ছিনতাইকারীদের অন্তত আট-দশটি স্পট রয়েছে। প্রকাশ্যে বোরকা পরে ছিনতাই করা ওইসব নারীদের রুখতে পারছে না পুলিশ। তাদের দাপটের কথাও স্বীকার করছেন পুলিশের কর্মকর্তারা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন স্পটে নারী ছিনতাইকারীদের সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ঢাকা শহরে যে পরিমাণ মাদক প্রবেশ করে তার ৯০ শতাংশের বহনকারী নারী, একইভাবে মাদক বিক্রির ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের। গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সীমান্ত এলাকা গলিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা আগ্নেয়াস্ত্রের বেশির ভাগের বাহক নারী। অর্থের বিনিময়ে এরা আগ্নেয়াস্ত্র বহন করে পৌঁছে দেয় গন্তব্যে। রাজধানী শহরে পুলিশের গোয়েন্দা তালিকায় আছে কয়েক ডজন মোস্ট ওয়ান্টেড সুন্দরীর নাম। এদের আসল কাজ বিয়ে বাণিজ্য। কাঁচা টাকার মালিক বিত্তবানদের ব্ল্যাকমেইল করে বড় অঙ্কের টাকার কাবিন করে শেষে নানা অজুহাতে ঝগড়া বাধিয়ে কাবিননামার টাকা আদায় করাই এদের কাজ। ওই চক্রটির একাধিক সুন্দরী কাজ করে শোবিজেও। একজনকে ছেড়ে প্রতারণার মাধ্যমে আরেকজনকে বিয়ে করে আবার কাবিননামায় উল্লেখ করা টাকা হাতিয়ে নেয়াই এদের কাজ।
এদিকে ঢাকার বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ডাকাতি ও স্বর্ণ চুরির অপরাধী চক্র ব্যবহার করছে বাসাবাড়ির বুয়াদের। কাজের কথা বলে কৌশলে বুয়াদের বাসাবাড়িতে ঢুকাচ্ছে একটি চক্র। কাজের ফাঁকে এরা খোঁজ নেয় বাড়ির কোন কোন স্থানে স্বর্ণসহ নগদ টাকা রাখা হয়। কাজের বুয়া হিসেবে মালিকের বিশ্বস্ততা অর্জন করেই বাসার চাবি সাবানের ওপর ছাপ দিয়ে বাইরে এনে তৈরি করে ডুপ্লিকেট চাবি। বাসার মালিক বাইরে গেলেই সুযোগ বুঝে পুরুষ সহযোগীদের খবর দিয়ে এনে ডাকাতির ঘটনা ঘটাচ্ছে নারীরা। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে জাল টাকা বহনকারী একাধিক নারীও।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি জাল টাকার চক্রের সাথেও জড়িত একাধিক নারী সদস্য। এ ছাড়া পুরুষ পকেটমারের মতোই এখন রাজধানীতে বিচরণ করছে কয়েক ডজন নারী পকেটমার। তবে ঈদসহ বাজারে বেশি জনসমাগমের পার্বণগুলোতে বেশি মাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে নারী পকেটমার।
তবে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত নারীদের কেউ তেমন সন্দেহ না করার সুযোগে একটি চক্র নারীদের অপরাধ জগতে টেনে আনছে, যাতে তাদের দিয়ে নির্বিঘ্নে অপরাধ ঘটানো যায়। নারী অপরাধীর সংখ্যা বাড়ছে এমনটি এখনো পুরোপুরি বলা না গেলেও জাল টাকা চক্র, পকেটমার, মাদক বিক্রি-বহনসহ অন্য কিছু অপরাধে সক্রিয় নারীরা এমনটাই বলছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন ঘটনায় নারী অপরাধের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু ঘটনার পরিকল্পনাকারী কিংবা নেতৃত্বেও থাকছে নারী। আবার নারীদের পূঁজি করে অস্ত্র-মাদক এসব বহন— এসব কাজও বেশি হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি না থাকায় মূলত নারীদের অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় নারীতে অপরাধ বাড়ছে। তবে তিনি এও বলছেন, নারীদের মধ্যে যে অপরাধ প্রবণতা থাকবে না এমনটিও নয়। একজন পুরুষকে যেভাবে সন্দেহের চোখে দেখা হয় নারীকে সেভাবে দেখা হয় না। আর এ সুযোগেই তারা অপরাধে জড়াচ্ছেন। অন্যদিকে অপরাধীরা নারীকে সুযোগ দিচ্ছে এবং নারীরাও অপরাধে জড়াচ্ছেন।’