সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২২, ০১:২০ এএম
ছাত্ররাজনীতির প্রশ্নে দ্বিধাদ্বন্দ্বে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। গত ৩ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের সমন্বিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিট থেকে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি ঘোষণা করা হয়। এ কমিটিকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি চর্চার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এতে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি চর্চা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে এমন সিদ্ধান্তের পর একদিকে যেমন অভিভাবককদের সমর্থন মিলছে, অপরদিকে ছাত্রনেতাদের কড়া সমালোচনাও বাদ যায়নি।তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা না থাকায় ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি চলবে কি চলবে না— এমন অঙ্কের জট এ মুহূর্তেই খুলছে না।
এদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, ছাত্ররাজনীতি চালু হলে সহিংসতা বাড়বে। একইসাথে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশও বিনষ্টের আশঙ্কা করছেন তারা।বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় থাকলেও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রায় ৪০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি ঘোষণা করার পর বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এ সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। এর মাঝে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় তার বিধানাবলির একটি ধারা উল্লেখ করে সঙ্গে সঙ্গে নোটিস জারি করেছে, যাতে বিনা অনুমতিতে এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ড করার অধিকার নেই বলে উল্লেখ করা হয়। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি করতে দেবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে।ড্যাফোডিল ও আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিও সহমত পোষণ করে তাদের আইনের নিজস্ব ধারা উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এছাড়া ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি প্রশাসনও তাদের ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ অনুযায়ী ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তারা বলছেন, ক্যাম্পাসে সংঘাতমুখর ছাত্ররাজনীতি থাকলে আইনের ৬(১০) ধারা পালনের পরিপন্থি হবে। তাছাড়া এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব রুলস-রেগুলেশনে ছাত্ররাজনীতির কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। ট্রাস্ট পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি কার্যত নিষিদ্ধ। শিক্ষার্থীরা সজ্ঞানে এসব শর্তাবলিতে স্বাক্ষর দিয়ে ভর্তি হয়েছে, যার পাশেই অভিভাবকদের স্বাক্ষরও রয়েছে। ছাত্ররাজনীতিতে সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষাসহায়ক ও রাজনীতি ব্যতিরেকে শিক্ষাবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। যেহেতু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন কমিটি ও উপকমিটি কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি নিয়ে তৈরি করে তারা নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ পাচ্ছে, সেহেতু পৃথকভাবে ছাত্ররাজনীতি অপ্রয়োজনীয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের অবস্থান জানান দিলেও ছাত্ররাজনীতির প্রশ্নে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) নীরব ভূমিকায় রয়েছে। প্রথমদিকে ইউজিসির কয়েকজন কর্মকর্তা ছাত্ররাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিলেও বর্তমানে নীরব ভূমিকায় রয়েছেন। ইউজিজিসি বলছে, সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে, ইউজিসি তা বাস্তবায়ন করবে।
এদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির প্রশ্নে সন্তানদের নিরাপত্তার প্রশ্নে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন অভিভাবকরা। বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকরা ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির সুযোগ না দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে সংশ্লিষ্ট উপাচার্যদের ই-মেইল করেছেন। এমন অভিভাবকের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতাদের সংগঠন বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি। একাধিক অভিভাবকের সাথে কথা হলে তারা রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবি জানিয়েছেন।
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, অনেক কষ্ট করে সন্তানকে বেসরকারিতে পড়তে দিয়েছি। সেখানে এতদিন তো ভালোই ছিল। এখন শুনছি রাজনীতি চলবে। কিন্তু ভর্তি করার সময় রাজনীতির কথা শুনিনি। রাজনীতি নেই জেনেই বেসরকারিতে ভর্তি করিয়েছি। আমি চাই না আমার সন্তান রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ুক।
ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় প্রশাসনের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, আমরা চাই না সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও রাজনীতির বিষফোঁড়া ছড়িয়ে পড়ুক। আর কোনো আবরার ফাহাদ হারিয়ে যাক অথবা কোনো মা সন্তানহারা হোক— তাও চাই না। আমার ছেলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেও তার সার্বিক নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছি। এখানে রাজনীতি চালু হয়ে সহিংসতা তৈরি হোক— এমনটা কাম্য নয়।
এদিকে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির প্রশ্নে অনলাইন এক জরিপে দেখা গেছে, ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে মত দিয়েছেন প্রায় ৭৪ শতাংশ শিক্ষার্থী। অপরদিকে পক্ষে মত দিয়েছেন ২৫ শতাংশ এবং এক শতাংশ শিক্ষার্থী মন্তব্য জানাননি।
এ প্রসঙ্গে সাবেক সচিব ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. প্রশান্ত কুমার রায় আমার সংবাদকে বলেন, ছাত্ররাজনীতি জাতির কণ্ঠস্বর। যে কোনো দেশের শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা জাতির জন্য অশনিসংকেত। ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা দেশকে আগামীতে নেতৃত্বশূন্য করার পাঁয়তারা। সুতরাং ছাত্ররাজনীতি নয়, অপরাজনীতি বন্ধ করতে হবে। ক্ষুধামুক্ত সোনার বাংলা, স্বাধীনতার চেতনায় সমৃদ্ধ প্রজন্ম, শিক্ষা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ‘অন্যরকম বাংলাদেশ’ গড়তে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের এমন সিদ্ধান্ত জাতির জন্য ইতিবাচক হবে না। একইসাথে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম বন্ধ করতে ও বিভিন্ন দাবি-দাওয়া পূরণের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। তবে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনায় ছাত্ররাজনীতি নিয়ে অভিভাবকদের মনে ভীতির সঞ্চারও হয়েছে। ইতিবাচক পরিবর্তনের মধ্যে সে ভীতি দূর করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক আমার সংবাদকে বলেন, যে কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতিচর্চা বন্ধ থাকতে পারে না। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বিভাজন করে শুরুতেই আমরা ভুল করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির এমন মানসিকতা পরিহার করতে হবে। যে শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনসংখ্যা সীমাবদ্ধতার কারণে ভর্তির সুযোগ পায়নি, সে হয়তো একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। উদ্দেশ্য একটাই— উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা। বেসরকারি-সরকারি বিষয় নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতিচর্চা থাকতে হবে; তবে সেটা অপরাজনীতি হলে চলবে না।
তিনি বলেন, ডাকসুকে কেন্দ্র করে অপরাজনীতি ও সহিংসতা হলে সেটা যেমন আমরা গ্রহণ করি না; তেমনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতির নামে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বা সহিংসতার পরিবেশ সৃষ্টি হোক, আমরা সেটাও চাই না। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা রাজনীতি নিয়ে, ছাত্রকল্যাণ নিয়ে একইসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকদের অনিয়ম নিয়ে কথা বলবে না— তা হতে পারে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের দাবিতে আন্দোলন হয়; সামান্য সেশন ফি বাড়ালে শিক্ষার্থীরা স্মারকলিপি দেয়, মিছিল করে। অথচ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব অর্থপাচারের প্রতিবাদ করতে গেলে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ছাত্রত্ব হারাতে হবে। সুনাগরিক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্যই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা হয়। সুনাগরিক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতাও জরুরি। শিক্ষার্থীদের তাদের মতপ্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। শুধু বই পড়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি হয়নি। চিন্তার স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের সুযোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতার জোগানও বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই হয়। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতিচর্চা উচিত কি না, এ প্রশ্নটাই অসংগতিপূর্ণ।