সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২২, ০১:৪০ এএম
বাংলাদেশের সীমানায় উড়ছে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান। এক মাসেরও বেশি সময় গোলাবর্ষণ চলছে। গত শুক্রবার বাংলাদেশে আশ্রিত এক রোহিঙ্গা নিহত ও পাঁচজন আহত হয়েছে।
গতকালও বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি গোলাগুলি অব্যাহত ছিল। দুবার মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানালেও তার কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। এখনো বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তে গোলাবর্ষণ ও মর্টারশেল নিক্ষেপে হতাহতের ঘটনায় আশ্রয় ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ওই ঘটনার পর থেকে রোহিঙ্গারা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
গত শুক্রবার রাতে ঘুমধুম ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী কোনারপাড়া এলাকায় শূন্যরেখায় থাকা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কয়েকটি মর্টারশেল বিস্ফোরিত হয়। এতে এক কিশোর যুবকের মৃত্যু হয়। তার নাম মো. ইকবাল (১৫)। সে শূন্য রেখার আশ্রয় শিবিরের রোহিঙ্গা মুনির আহমদের ছেলে। আহত পাঁচ রোহিঙ্গার মধ্যে চারজনের পরিচয় পাওয়া যায়। এরা হলো— জাহিদ আলম (৩০), নবী হোসেন (২১), মো. আনাস (১৫) ও সাহদিয়া (৪)।
প্রশাসন বলছে, মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টারশেল এবার বাংলাদেশ সীমান্তের ৩০০ গজ ভিতরে এসে পড়েছে। ফলে, সেখানকার স্থানীয়দের মাঝেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এদিকে শুক্রবার বিকেলে শূন্যরেখার কাঁটাতারের কাছে গরু আনতে গিয়ে তুমব্রু এলাকার চাকমাপল্লীর এক তরুণ মাইন বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হয়। তার বা পায়ের গোড়ালি আলাদা হয়ে গেছে। বর্তমানে সে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
১১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি মোহাম্মদ ওসমান বলেছেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সেখানকার মগ বৌদ্ধরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নির্যাতন করে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান মিয়ানমারে অবস্থান করছে। যাদের নির্যাতনের মাধ্যমে আবার বাংলাদেশে পাঠাতে নানা কৌশল অবলম্বন করছে। সীমান্তে উত্তেজনা যুদ্ধের ইঙ্গিত বহন করছে বলে মনে করছেন এই মাঝি।
উখিয়ার নাগরিক রফিকুল ইসলাম বলেন, বহুমুখী ষড়যন্ত্রের গোলা তুমব্রু সীমান্তে। কঠিন প্রস্তুতি ও ধৈর্যের সাথে পাতানো ফাঁদের পরিস্থিতি অতি কৌশলে মোকাবিলা করাই উত্তম বলে মনে করছি।’
ঘুমধুম ২ নম্বর ওয়ার্ডের তুমব্রু এলাকার ইউপি সদস্য দিল মোহাম্মদ ভুট্টু বলেন, গোলাগুলির বিকট শব্দে তুমব্রুর ভূখণ্ড কাঁপছে। এতে এলাকার মানুষ ফের আতঙ্কে আছেন। এক মাসের বেশি সময় ধরে মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির সাথে দেশটির নিরাপত্তাবাহিনীর গোলাগুলির ঘটনায় বাংলাদেশের মানুষ উদ্বিগ্ন। তারা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছেন না। চাষিরা মাঠে নামতে পারছেন না। শিক্ষার্থীরা পাঠের পরিবেশ হারাচ্ছে। এসএসসি পরীক্ষার্থীরাও কেন্দ্রে যেতে নিরাপদ বোধ করছে না।
বান্দরবান জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন পারভেজ তীবরীজি গণমাধ্যমকে বলেন, শূন্যরেখায় তিনটির মতো গোলা এসে পড়লে একটি বিস্ফোরিত হয়। যারা হতাহত হয়েছে তারা সবাই রোহিঙ্গা। ঘটনার পর শূন্যরেখায় থাকা রোহিঙ্গাদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই, তবে যারা আছে তাদের অনেকেই এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে।বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে নতুন করে কেউ যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে এ জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে আছে।
এদিকে শুক্রবারের ঘটনায় শিক্ষার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তা বিবেচনায় সীমান্তবর্তী ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ে থাকা পরীক্ষা কেন্দ্রটি সরিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিন। ওই কেন্দ্রের ৪৯৯ জন পরীক্ষার্থীকে শনিবার সকালের পরীক্ষা নতুন কেন্দ্রে নেয়া হয় বলেও জানান তিনি।
মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘এবারের মর্টারশেল ৩০০ গজ ভেতরে এসে পড়েছে। আমাদের চিন্তা শিশুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিয়ে। আমরা তাদের পার্শ্ববর্তী নতুন কেন্দ্র নিয়ে যাচ্ছি। এ ব্যাপারে রাতে মাইকিং করা হয়েছে। বাজারঘাট থেকে শুরু করে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় আমরা মাইকিং করেছি। গতকাল বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি উদ্বেগের সৃষ্টি করছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি লুইস গুয়েন।
তিনি বলেন, জাতিসংঘ প্রতিনিয়তি পর্যবেক্ষণ করছে, মিয়ানমারের মিশনের সাথেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সত্যি বলতে পুরো ঘটনা স্পষ্ট নয়। যদিও ঘটনাস্থলে দেখবার অনুমতি নেই। তাই উভয় দেশকে শান্তি বজায় রাখতে অনুরোধ করেন লুইস গুয়েন।
গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডিতে আহসানিয়া মিশনের এক অনুষ্ঠান শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, সীমান্ত পার হয়ে রোহিঙ্গারা যেন বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে সে জন্য সতর্ক রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্টগার্ড। তারা সীমান্তে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে। এরপরই যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশ ঢোকার চেষ্টা করছে তাদের পুশব্যাক করে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ যুদ্ধ চায় না, শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে চায়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ‘গত শুক্রবার একটি রোহিঙ্গা পরিবার মিয়ানমার সীমান্তের পাশে জিরো লাইনে অবস্থান করছিল। জিরো লাইন বলতে মিয়ানমারের সীমানা ও বাংলাদেশের সীমানার মাঝখানে যে লাইন থাকে সেটাকে বোঝানো হচ্ছে। সেই ক্যাম্পে এসে আমরা দেখলাম গোলাবারুদের আঘাতে একজন নিহত হয়েছে এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
আমরা শিগগিরই তাদের এই অবস্থান পরিবর্তন, এই গোলাবারুদ যাতে তারা বন্ধ করে সবসময় সেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কাজ করছে। আমরা মনে করি তারা তাদের ভুল বুঝতে পারবে। তারা সংযত থাকবে।’ মিয়ামারের সাথে বাংলাদেশ যুদ্ধে জড়াবে না, বরং শান্তিপূর্ণ সমাঝান চায় বলেও উল্লেখ করে মন্ত্রী।