অক্টোবর ৪, ২০২২, ০১:২৭ এএম
শেখ হাবিবুর রহমান। বাড়ি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায়। ২০০৭ সালে একই উপজেলার তানজিলা হক উর্মির সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন হাবিবুর। দীর্ঘদিন ভালোই চলছিল হাবিবুর তানজিলা দম্পতির সংসার। তবে জীবিকার তাগিদে হাবিবুর রহমান সৌদি আরবে গেলেই স্ত্রী তানজিলার চলাফেরা ও ব্যবহারের ধরন বদলে যায়। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য থেকে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এ কারণে দুজনের মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় তাদের দাম্পত্য জীবন আর এগোয়নি। ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি আদালতের মাধ্যমে স্ত্রী তানজিলাকে তালাক দেন হাবিবুর। তালাকের পর আদালতের নির্দেশে যথাযথ নিয়ম মেনেই দেনমোহর, খোরপোশ ও সন্তানের ভরণপোষণও পরিশোধ করেছেন হাবিবুর। তবুও নিস্তার মেলেনি। মামলা থেকে রেহাই পাননি হাবিবুর রহমান। তালাকের দেড় বছর পর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সাবেক স্ত্রীর করা যৌতুক ও নির্যাতন মামলায় দুর্বিষহ জীবন পার করছেন এই প্রবাসী ও তার পরিবার। মামলা নং ২/৩৫। মামলা যেন তাদের পিছু ছাড়ছেই না।
শুধু হাবিবুর রহমানই নন, এ মামলায় আসামি করা হয়েছে তার পরিবারের একাধিক সদস্যকেও। কেউ কেউ জেল খেটে কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে এখনো মামলার ঘানি টানছেন। প্রতি মাসেই হাজিরা দিতে আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন। মামলা থেকে রেহাই পেতে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরেও কাজ হয়নি। মিলছে না প্রতিকার। হাবিবুর রহমানের পরিবারের দাবি, আইন মেনেই আইনজীবীর মাধ্যমে তালাক দিয়েছেন হাবিবুর। তারপরও ব্যক্তিগত ক্ষোভ আর আক্রোশ থেকেই তার নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। এমনকি মামলায় ডিভোর্সের তথ্যটিও গোপন করা হয়েছে। শারীরিক নির্যাতনের প্রমাণ হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসকের একটি ব্যবস্থাপত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। অথচ হাবিবুর তখন বিদেশে অবস্থান করছিলেন বলে অভিযোগ করে পরিবার।
এদিকে তালাক কার্যকর হওয়ার দেড় বছর পর আইনগতভাবে স্ত্রী না থাকা সত্ত্বেও কিভাবে যৌতুক ও নির্যাতনের মামলা হয় এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিলা আক্তার ঝুমা বলেছেন, ‘যদি নির্যাতন মামলায় কোনো গরমিল থাকে তাহলে আসামিও প্রতিকার চাইতে পারে। যেমন— ডিভোর্স কার্যকরের পর যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের মামলা করা হয়েছে। এমন হলে বাদীর বিরুদ্ধেও মামলা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তাকে প্রমাণ করতে হবে যে, মামলাটি মিথ্যা ছিল।’ এমন ঘটনার ভুক্তভোগী শুধু গোপালগঞ্জের শেখ হাবিবুর রহমান একাই নন, সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১ এর (গ) ধারার মামলার গ্যাঁড়াকলে পড়ে অনেকেই ভুগছেন। কেউ কেউ মামলার ঘানি টেনে নিঃস্ব হয়েছেন। অনেকে বছরের পর বছর কারাবরণ করেছেন। এ ধারার অপপ্রয়োগেরও অভিযোগ রয়েছে অহরহ। যৌতুক দাবিতে স্বামী কর্তৃক মারধরের ঘটনা ঘটলে প্রতিকারের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু এ ধারার প্রয়োগের চেয়ে অপব্যবহারই বেশি হচ্ছে বলে দাবি করেছেন আইনজ্ঞরা।
দেশে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি কোনো কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হলে স্ত্রীপক্ষ অন্যপক্ষের লোকজনদের হয়রানি করতেও হরহামেশা এ ধারায় মামলা করছে বলে অনুসন্ধানে দেখা গেছে। এমনকি কথিত জখমের ঘটনার আগেই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার নজিরও পাওয়া গেছে।
আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ঢালাও মামলার কারণে আদালতের কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি সত্যিকারের যে ঘটনা সেগুলোর বিচারকাজ পড়ছে দীর্ঘসূত্রিতায়। এ ছাড়া এ ধরনের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট দম্পতির সন্তানরা এক ধরনের নেতিবাচক মানসিকতা নিয়ে বড় হচ্ছে। এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, নারী নির্যাতন বা যৌতুক মামলায় বাদী আইনজীবীদের পরামর্শে চিকিৎসকের কাছ থেকে জখম হওয়ার মেডিকেল সনদ নেন। এরপর সেই সনদসহ তিনি থানায় গিয়ে এজাহার করার অনুরোধ করেও ব্যর্থ হয়েছেন মর্মে একটি এফিডেভিট স্থানীয় নোটারি পাবলিকের কার্যালয় থেকে সংগ্রহ করে অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন। এভাবে এটি একটি মামলায় রূপান্তরিত হয়। পরিসংখ্যান বলছে বাংলাদেশে বর্তমানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে প্রায় লক্ষাধিক মামলার বিচার কাজ চলমান রয়েছে।
এদিকে এসব ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা বলছেন, যৌতুক ও মারধরের মামলা বেশির ভাগ মিথ্যা ও বানোয়াট হয়। এমনকি ট্রাইব্যুনালে যত মামলা হয় তার ৮০ শতাংশই যৌতুক, ধর্ষণ ও যৌন পীড়নের অভিযোগে করা হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ নারী নির্যাতন হলেও অন্য ধরনের বিরোধের কারণেই এসব করা হয়েছে। বিচারকরা মামলাগুলো আপসে নিষ্পত্তির পরামর্শ দিচ্ছেন। পাশাপাশি মামলাগুলো সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এইডের কাছে পাঠানোর কথা বলেছেন।
এদিকে নিজের বিচারিক অভিজ্ঞতা নিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারক তার নিবন্ধে বলেন, এই আইনে দায়ের করা মামলার ৮০ শতাংশই যৌতুক-সংক্রান্ত। এর মধ্যে কেবল যৌতুক দাবিতে মারপিট করে সাধারণ জখম করা কিংবা গুরুতর জখম করা ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে যৌতুক দাবিতে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটানো মামলার সংখ্যা ৫ শতাংশের কম। তিনি বলেন, তাহলে প্রশ্ন আসে, বাকি মামলাগুলো কি মিথ্যা? এর জবাবে বলা যায়, শুধু যৌতুক দাবিতে মারধর করে সাধারণ জখম হওয়ার মামলার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হলেও এই মামলাগুলোর ক্ষেত্রে যৌতুকের জন্য মারপিট করার উপাদান অনেক ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। তবে এই মামলাগুলো একেবারেই মিথ্যা নয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো কারণে মতের অমিল হলে কিংবা তাদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া না থাকার কারণে বনিবনা না হলে কিংবা স্বামীর আত্মীয় স্বজনের সাথে স্ত্রীর মতামতের পার্থক্যের কারণে পারিবারিক জীবন অশান্তিপূর্ণ হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে স্ত্রী কোনো উপায়ান্তর না দেখে ও এ সংক্রান্ত কোনো ফোরাম না পেয়ে বাধ্য হয়ে দ্রুত প্রতিকার লাভের আশায় স্বামীকে এবং তার নিকটাত্মীয়দের আসামি করে এই আইনের ১১(গ) ধারার বিধান অনুযায়ী মামলা করে থাকেন।
এ বিষয়ে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ এর রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘বিভিন্ন মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাস্তবিক ঘটনা যেমন ঘটছে তেমনি কিছু ক্ষেত্রে মিথ্যা অভিযোগে মামলাও হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের এমন সদস্যদেরও আসামি করা হয়, যাদের আসলে ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততা থাকে না।’ এ আইনজীবী আরও বলেন, ‘স্বামী-স্ত্রীর মতের অমিল, পরকীয়া, স্বামীর পরিবারের সাথে স্ত্রীর বনিবনা না হওয়া, দেনমোহর ও খোরপোশের টাকা দ্রুত আদায়ের চেষ্টা হিসেবে স্বামীপক্ষকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবেও অনেকে মামলা করেন। তবে হাইকোর্টের নির্দেশনার পর এ ধরনের প্রবণতা কিছুটা কমে অনেকেই এখন আপসে যাচ্ছেন।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, ‘নারী নির্যাতনের ১১(গ) ধারায় অপব্যবহার হচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায়, অনেকে তালাকের তথ্য গোপন করে মামলা করেন। যেটি এক প্রকার মিথ্যা মামলা। তাই মামলা করার আগেই যদি যাচাই-বাছাই করা হতো তাহলে এসব মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার মাত্রাটা কমে যেতো। আর মামলা মিথ্যা প্রমাণ হলে মামলাকারীকে শাস্তি দিতে হবে। তবে এসব মামলার প্রবণতা কমে আসবে। আসলে অনেকে দীর্ঘদিন মামলা চলার পর মুক্তি পেলে মিথ্যা মামলার শাস্তি দিতে আর ফিরতি মামলা করতে চান না। আইন আদালতে ঝামেলায় আর জড়াতে চান না। কেউ কেউ ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর স্বামীপক্ষের কাছে দেনমোহরের টাকা দ্রুত আদায় করতে কিংবা পারিবারিক অশান্তির কারণে স্বামীপক্ষকে ‘শিক্ষা’ দিতে এ ধরনের মামলা করেন। তবে দুঃখের বিষয় হলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে কতিপয় আইনজীবী ও স্ত্রীপক্ষের লোকজনও মামলা করতে প্ররোচনা ও উসকানি দেন। আমাদের মতে, মামলার গুরুত্ব বুঝে এগুলো তদন্তে দেয়া উচিত। তদন্তে যদি ঘটনার সত্যতা মেলে তবেই এ বিষয়ে পরবর্তী বিচারিক প্রক্রিয়া চলতে পারে।