অক্টোবর ৪, ২০২২, ০১:৩৩ এএম
ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের ফলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। দু’দেশের সংকট শুরু হওয়ার ছয় মাসের মাথায় দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য এক লাফে ৫০ শতাংশ বাড়ানো হয়। সরকারের তরফ থেকে তখন বলা হয়েছে— বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে দেশে দাম সমন্বয় করা হয়েছে। বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশে আবার সমন্বয় করা হবে।
এদিকে বিশ্ববাজরে টানা তিন মাস ধরে জ্বালানির মূল্য নিম্নমুখী। এবার বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম গত আট মাসে সর্বনিম্ন রেকর্ড গড়লেও দেশে জ্বালানির দাম সমন্বয় করার মুরোদ নেই সরকারে। মাত্রাতিরিক্ত হারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম। বেড়েছে উৎপাদন ও পরিবহন খরচ। জনদুর্ভোগ বেড়েছে চরম পর্যায়ে। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস
অবস্থা। স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাহত হচ্ছে নাগরিক জীবন। পরে গত আগস্ট মাসের শেষের দিকে সব ধরনের জ্বালানির মূল্য পাঁচ টাকা কমেছে।
নামমাত্র মূল্যহ্রাসে কোনো প্রভাব পড়েনি জনজীবনে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকার অপরিকল্পিতভাবে এক লাফে দাম বাড়িয়েছে। সাধারণ জনগণের কথা না ভেবে এমন দাম বৃদ্ধি করেছে। আবার নামমাত্র পাঁচ টাকা কমাতেও সাধারণ মানুষের কোনো লাভ হয়নি। মূলত ব্যবসায়ীদের লাভবান করতেই জ্বালানির দাম পাঁচ টাকা কমানো হয়েছে।
এর আগে জ্বালানির দাম বাড়ানোর সময় জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমানো হলে আমরা আবার দাম সমন্বয় করব। এদিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম টানা তিন মাস ধারাবাহিক কমলেও দেশে দাম না কমাতে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, বিশ্ববাজারে দাম কমছে, দেশে কমবে কবে? বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে আগস্ট মাসে এক লাফে গড়ে প্রায় ৪৭ শতাংশ দাম বাড়ে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম। একই অজুহাতে গত বছর নভেম্বর মাসে জ্বালানি তেলের দাম ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি করে সরকার। সব মিলিয়ে ১০ মাসে দাম বাড়ানো হয় প্রায় ৭০ শতাংশ। আর ওই সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে গড় মূল্য বৃদ্ধি পায় ২০ শতাংশ। অর্থাৎ বিশ্ববাজারের তুলনায় দেশের বাজারে দাম ৫০ শতাংশ বেশি বাড়ানো হয়।
এদিকে সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, এখনো বিপিসি লোকসান গুনছে। গেল কয়েক মাসে এ খাতে সরকারের লোকসান চার হাজার কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেই দেশে বাড়ানো হয়। কিন্তু দাম কমলেও প্রভাব পড়ে না দেশে। বিশ্বেবাজারে এখন জ্বালানি তেলের দাম অনেকাংশে কমেছে, কিন্তু দেশে এখনো দাম সমন্বয় না করা অন্যায্য। সরকারের উচিত, বিশ্ববাজার অনুযায়ী জ্বালানি তেলের দাম কমানো এবং এর প্রভাবে গণপরিবহন ও যেসব জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, তা কমিয়ে জনসাধারণের জীবনযাত্রায় অব্যাহত চাপ কমানোর ব্যবস্থা নেয়া।
বিশেষজ্ঞরা মূল্য সমন্বয়ের বিষয়ে বলেন, যেই যুক্তিতে সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছিল, সেই যুক্তি এখন আর নেই। এর পরও দাম কমানো হচ্ছে না। আমরা কিছু বুঝতে পারছি না। যদি সরকার মনে করে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল আগের সেই দামে ফিরে গেলে দেশে দাম কমাবে, তাহলে এটি অন্যায় হবে।
এ ছাড়া বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন, দাম না কমিয়ে যে বাড়তি মুনাফা হচ্ছে তা ‘প্রাইস স্টাবলাইজেশন ফান্ড (মূল্য স্থিতিশীলতা তহবিল)’ নামের একটি তহবিলে রেখে দেয়া উচিত। বিশ্ববাজারে আবার দাম বাড়লে তখন দেশে জ্বালানি তেলের দাম না বাড়িয়ে ওই তহবিল থেকে সমন্বয় করা উচিত। এতে মানুষের ওপর হঠাৎ করে বাড়তি চাপ পড়বে না বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ।
এদিকে ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির (আইইএ) প্রতিবেদন বলছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে ব্যারল প্রতি (১৫৯ লিটার) পৌঁছেছিল ১৩০ ডলারে। আর গতকাল তা কমে ৭৯ ডলার থেকে ৮১ ডলারে নেমে এসেছে। গত তিন মাসে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ৬৫ শতাংশ কমেছে বলেও সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম আমার সংবাদকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে দেশে কমে না— এটি অন্যায্য। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে দেশেও দেশের বাজারে কমা উচিত। সমপ্রতি ডিজেলের দাম লিটারে পাঁচ টাকা কমলেও যাত্রীভাড়া বা পণ্যমূল্য কমেনি। মানুষ কোনো সুফল পায়নি। যখন বিশ্ববাজারে দাম কমেছে; কিন্তু দেশে কমানো হয়নি, সে ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মুনাফা হচ্ছে। এ বিষয়ক একটি তহবিল গঠন করে এই মুনাফা সেখানে রেখে দিতে হবে।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জ্বালানি তেলের সমন্বয়হীনতার বিষয়ে বলেন, ‘মূলত দুটি কারণে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সাথে প্রতিনিয়ত সমন্বয় করা হয় না। প্রথমত, অভ্যন্তরীণ মার্কেটে মূল্য সরকার নিয়ন্ত্রিত দাম। এমনকি এলএনজি ছাড়া অন্য কিছুতে বেসরকারি খাত নেই বলে কোনো প্রতিযোগিতাও নেই। তেল আনাই হয় সরকারি প্রতিষ্ঠান বিপিসির মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, সরকার সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে তেল ক্রয় করে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে। সরকার গণমানুষ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথা চিন্তা করে আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠানামা থেকে ভোক্তাদের বাইরে রাখতে চায়। কিন্তু মাঝে মধ্যে এটি ভোক্তার জন্য সমস্যাও হয়ে দাঁড়ায়। ফলে বিপিসি এফডিআর অক্ষত রেখে তেলের দাম বাড়িয়ে সমন্বয় করেছে আর ভোক্তাকে এখন নিজের এফডিআর ভেঙে সে তেল কিনতে হচ্ছে। এ জন্য ভোক্তাকে সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি তেল দিতে মাঝে মধ্যে যৌক্তিক সমন্বয়টাও দরকার।’