Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪,

সঞ্চালন লাইন আধুনিকায়নের তাগিদ

মহিউদ্দিন রাব্বানি

অক্টোবর ৭, ২০২২, ০১:১৯ এএম


সঞ্চালন লাইন আধুনিকায়নের তাগিদ

জাতীয় গ্রিডে আকস্মিক বিপর্যয়ের ফলে ব্ল্যাক আউটের কবলে পড়ে দেশের ৬০ শতাংশ এলাকা। গত মঙ্গলবার দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্ল্যাকআউটের (বিদ্যুৎ বিপর্যয়) ঘটনা ঘটে। দীর্ঘ বিদ্যুৎহীনতায় দুর্ভোগে পড়ে সাধারণ মানুষ। থেমে যায় শিল্পের চাকা।

মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ে স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, ব্যাংক ও নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থা। বিদ্যুৎ বিতরণ ও সঞ্চালনকে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে পরিচালনা করতে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও এত বড় ত্রুটির কবলে পড়ে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। এমন ধরনের টেকনিক্যাল বিপর্যয় ঘটলে খুব দ্রুত উত্তরণ সম্ভব নয় বলেও জানায় পিজিসিবি।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, বিপর্যয়টি কী কারণে, কোথায় হয়েছে, এ বিষয়ে সঠিকভাবে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে তদন্ত কমিটি মাঠে কাজ করছে। আমাদের পুরোনো অভিজ্ঞতা আছে, তাই বলছি, বিষয়টি চিহ্নিত করতে কিছুদিন সময় লাগতে পারে। আমরা এখনো স্মার্ট গ্রিড ব্যবস্থা চালু করতে পারিনি বিধায় কোথায় সমস্যা হয়েছে তা এখনো চিহ্নিত করতে পারিনি।

সারাদেশে একসঙ্গে বিদ্যুৎ বিপর্যয় কেন বারবার ঘটে এমন প্রশ্নে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত ফ্রিকোয়েন্সি গরমিলের কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। বিদ্যুৎ যে তরঙ্গে প্রবাহিত হয়, কোনো কারণে এর হেরফের হলে এমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সাধারণত মিলি সেকেন্ডের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটে যায়। এমন ঘটনা প্রতিরোধ করার মতো নানা ধরনের ব্যবস্থা থাকলেও বিভিন্ন দেশে মাঝে মাঝে গ্রিড বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো সঞ্চালন লাইনে হয়তো একসঙ্গে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে। যদি কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে এর ১০ ভাগ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে গ্রিড ট্রিপ (বিপর্যয়) করার মতো ঘটনা ঘটে থাকে। বাংলাদেশে ৫০ মেগা হার্টজ তরঙ্গে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। কোনো কারণে এই তরঙ্গ যদি ৪৮-এ নেমে আসে বা ৫২-তে উঠে যায়, তাহলেই ট্রিপের ঘটনা ঘটতে পারে।

এর আগে ২০১৪ সালে যখন বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছিল তখন ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যবস্থা কয়েক মিলি সেকেন্ডের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এতে জাতীয় গ্রিড ট্রিপ করে।

যেভাবে বিপর্যয় ঘটতে পারে : বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদনের পর বিদ্যুৎ গ্রিড সাবস্টেশনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। এই জাতীয় গ্রিড দেশের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গার গ্রিড সাবস্টেশনে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়। এই গ্রিড সাবস্টেশন এবং জাতীয় গ্রিড দুটোরই নিয়ন্ত্রণ রয়েছে রাষ্ট্রীয় কোম্পানি পাওয়ার গ্রিডের হাতে। গ্রিড সাবস্টেশন থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় বিতরণ কোম্পানির সাবস্টেশনে। বিতরণ কোম্পানির সাবস্টেশন থেকে মানুষের বাড়ি বাড়ি বিদ্যুৎ পৌঁছায়। বিতরণ জটিলতার কারণে সাধারণত গ্রিড বিপর্যয় ঘটে না। বিপর্যয় ঘটে সঞ্চালন জটিলতার কারণে।

উৎপাদন এবং সঞ্চালন ব্যবস্থার গ্রিডের এই অংশটুকু নিয়ন্ত্রণ করে ন্যাশনাল লোড ডেসপাস সেন্টার বা এনএলডিসি। ন্যাশনাল লোড ডেসপাস সেন্টার বিদ্যুতের চাহিদা দেখে কেন্দ্র চালানোর নির্দেশ দেয়। এমনকি কোন কেন্দ্র কত বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে তাও ঠিক করে দেয় এনএলডিসি। এই কাজটি স্বয়ংক্রিয় পন্থায় হওয়ার কথা। অভিযোগ রয়েছে, আমাদের এখানে সেটি অনেক ক্ষেত্রে হয় না। অর্থাৎ এনএলডিসি তাদের কার্যালয়ে বসেই সব বিদ্যুৎকেন্দ্র স্কাডারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তারা টেলিফোনে কেন্দ্রগুলোকে কত লোডে চালাতে হবে তা জানায়। আবার কোনো কেন্দ্র বন্ধ করতে হলেও তারা এনএলডিসি থেকে বন্ধ করতে পারে না।

কেন্দ্রগুলো বন্ধ করতে হলেও আবার সেই টেলিফোনের ওপারের মানুষের ওপর ভরসা করতে হয়। গ্রিড বিপর্যয়ের প্রধান কারণ হচ্ছে চাহিদার সঙ্গে উৎপাদনের ভারসাম্য না থাকা। অর্থাৎ কখনও চাহিদা রয়েছে ১০ হাজার মেগাওয়াটের, কিন্তু উৎপাদন হঠাৎ আট হাজার মেগাওয়াটে নেমে গেল, অথবা ১২ হাজারে উঠে গেল। এরকম হলে বিদ্যুৎ প্রবাহের তরঙ্গে বিঘ্ন ঘটে, সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। কখনও যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে সেই সমাধান কয়েক মিলি সেকেন্ডের মধ্যে করতে হয়। অর্থাৎ চাহিদার চাইতে যদি হুট করে অনেক বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যায় তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাৎক্ষণিক সরবরাহ বন্ধ করলে আর গ্রিড বিপর্যয় ঘটে না।

যেভাবে ঠেকানো যায় গ্রিড বিপর্যয় : স্থিতিশীল গ্রিডের জন্য অটোমেশনের কোনো বিকল্প নেই। নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মানুষের বদলে যত বেশি যান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে, গ্রিড ততই স্থিতিশীল হবে। তবে এর জন্য বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন। খুব অল্প সময়ে সম্ভব না হলেও সরকার এর মধ্যেই এ সংক্রান্ত উদ্যোগ নিয়েছে। ক্রমান্বয়ে স্মার্ট গ্রিডের সমপ্রসারণ করলে এ ধরনের গ্রিড বিপর্যয়ের ঘটনা এড়ানো সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিদ্যুতের উৎপাদন থেকে সঞ্চালন ও বিতরণ এই তিন জায়গাতেই সমান গুরুত্ব দেয়ার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। দেশে এখন বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র আসছে। পায়রা, রামপাল, মাতারবাড়ী, রূপপুরের সব ইউনিট ২০২৪ এবং ২০২৫-এর মধ্যে উৎপাদনে চলে আসবে। এর মধ্যেই গ্রিড স্থিতিশীল না করতে পারলে বিপর্যয় আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। কোনো কারণে একটি এক হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র আকস্মিক বন্ধ হয়ে গেলে গ্রিড সংকটে পড়তে পারে দেশ। এর আগে ২০১৪ সালে যখন বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছিল তখন ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যবস্থা কয়েক মিলি সেকেন্ডের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এতে জাতীয় গ্রিড ট্রিপ করে। একবার গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয় দেখা দিলে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যায়। বড় বিপর্যয় ঠেকাতে কেন্দ্রগুলোতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে এ ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকে। বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হলে কারিগরি কারণে সেটি চালু হতে সময় লাগে। ফলে চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায় না।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম আমার সংবাদকে বলেন, আমাদের সঞ্চালন অবকাঠামো অনেক পুরোনো। ফলে পুরোনো পদ্ধতিতে লোড ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে। আধুনিক গ্রিড না থাকায় বিপর্যয়ের উৎস খুঁজতেও দেরি হচ্ছে। আমাদের সঞ্চালন লাইনগুলোর আধুনিকায়ন করা খুবই জরুরি।

জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন জানান, সঞ্চালন লাইন আধুনিকায়নের পাশাপাশি ‘গ্রিড রিলায়েবিলিটি স্টাডি’ আমরা করছি। বিদ্যুৎ খাতের সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে কাজ করছি। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ বিতরণে সঞ্চালন ব্যবস্থায় যাতে কোনো ধরনের ত্রুটি না থাকে, সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। মঙ্গলবার কেন আকস্মিক এমন ঘটনা ঘটেছে সেটি এখনও আমরা জানতে পারিনি। তবে তদন্ত প্রতিবেদনে প্রাথমিকভাবে বলা যায় ঘোড়াশাল কেন্দ্র থেকে এমন দুর্ঘটনা ঘটে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন হাতে না আসা পর্যন্ত বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে ফ্রিকোয়েন্সিতে গরমিল হলেই এটি হতে পারে। ফ্রিকোয়েন্সিতে গরমিল নানা কারণে হয়। কোথাও সরবরাহ ঘাটতি দেখা দিলে বা হুট করে কোথাও থেকে সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে এমন হতে পারে।

Link copied!