অক্টোবর ১১, ২০২২, ০৪:০৭ এএম
গত এক দশকে ব্যাংক খাতে ঘটে যাচ্ছে একের পর এক কেলেঙ্কারি। গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে এমন ঘটনাগুলোর হিসাব ধরলেও অন্তত ৪০ হাজার কোটি টাকা নয়ছয় হয়েছে। হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, অ্যানন টেক্স, বেসিক ব্যাংক, ফার্মার্স ব্যাংকসহ সরকারি-বেসরকারি এক ডজনের বেশি ব্যাংকের জালিয়াতির তথ্য ফাঁস হয়েছে।
সবশেষ ইসলামি ধারার তিনটি ব্যাংক থেকে একটি অখ্যাত গ্রুপ ছয় হাজার ৩৭০ কোটি টাকা নামে-বেনামে হাতিয়ে নিয়েছে। তবে রহস্যজনকভাবে এ ঘটনায় নীরব দর্শক সংশ্লিষ্টরা। আগের ঘটনাগুলোতে মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটলেও এ ক্ষেত্রে একেবারেই ভিন্নচিত্র। এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও কোনো পর্যায় থেকে বিষয়টিতে পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রভাবশালী মহলের সংশ্লিষ্টতা থাকায় বিষয়টি চাপিয়ে রাখার চেষ্টা করছে কোনো একটি পক্ষ। এমন নীরবতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ তদন্ত কোন পথে যাবে তাও এখন বড় প্রশ্ন। অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থাগুলো বলছে এ ধরনের ঘটনা যতটা ক্ষতিকর তার চেয়েও আশঙ্কাজনক বিষয়টি চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরাও পর্যন্ত বিষয়টিতে মন্তব্য করতে রাজি হচ্ছেন না। এত কিছুর পরও অন্তত দুজন বিশ্লেষকের সাথে কথা হয়েছে আমার সংবাদের। আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা রক্ষায় জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, ‘বড় ঋণের ক্ষেত্রে জামানতে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ এমনিতেই অনেক সময় একই জামানত একাধিক ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। এ ক্ষেত্রে নিয়ম ভঙ্গের যে ঘটনা ঘটেছে সেটি পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিয়েই হয়েছে। তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।’
বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ বলেন, এ ধরনের ঘটনায় সার্বিক ব্যাংক খাতে আস্থার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে। এ ক্ষেত্রে কয়েক ধরনের সমস্যা হতে পারে। প্রথমত, আমানত সংগ্রহের ক্ষেত্রে বড় বাধা আসতে পারে। কারণ সাধারণ মানুষ আস্থা হারিয়ে ব্যাংক-বিমুখ হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সংকট তৈরি হবে।
তৃতীয়ত, অবিশ্বাসের কারণে লেনদেন চ্যানেল পরিবর্তন করতে বাধ্য হওয়ায় ব্যবসায়িক খরচ বৃদ্ধি পাবে। যা মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব তৈরি করবে। এ ছাড়া এ ধরনের ঘটনায় পুরো সিস্টেমের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে অখ্যাত একটি গ্রুপকে বিশাল অঙ্কের ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংক পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বেনামি প্রতিষ্ঠানে অর্থ সরিয়ে নেয়ার যে সন্দেহের কথা বলা হয়েছে, তার সাথে একমত পোষণ করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘মনে হচ্ছে নাবিল নামক গ্রুপটিকে খোলস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।’
ইসলামি ব্যাংকের মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচাতে হলে এ ধরনের ঘটনায় কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যেহেতু আইন ভঙ্গ হয়েছে তাই সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে। কারণ এক জায়গায় প্রশ্রয় দেয়া হলে সব জায়গায় অনিয়ম শুরু হবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, যেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব তদন্তে বিষয়টি উঠে এসেছে তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির উচিত হবে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া। কারণ পুরো বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের দিকেই বর্তায়।
তিনি বলেন, অনিয়মের সাথে যারা জড়িত তাদের সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। বিষয়টি যেহেতু পরিচালনা পর্ষদের সংশ্লিষ্টতায় হয়েছে তাই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটি নতুন কোনো ঘটনা নয়। ব্যাংক খাতে এ ধরনের অপরাধ একের পর এক ঘটে যাচ্ছে। এটি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা লুটপাটের ধারাবাহিকতা। এ ক্ষেত্রে অর্থপাচারের বিষয়টি সবাইকে মনে রাখতে হবে। বেনামি কোম্পানির নামে ঋণ নিয়ে টাকা বিদেশে সরিয়ে নেয়া হতে পারে।
তিনি বলেন, যেহেতু ব্যাংক মালিক ও কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কারসাজি হয়েছে, তাই দুদক ও সিআইডিসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উচিত বিষয়টি তদন্ত করে জড়িত সবাইকে শাস্তির আওতায় আনা। দেশের আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা রক্ষায় দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দেন তিনি।
এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় উল্লেখ করে টিআইবি প্রধান বলেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ না করে দিনের পর দিন প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। যেহেতু এ ধরনের ঘটনায় প্রভাবশালী চক্র জড়িত তাই জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
উল্লেখ্য, পর্যাপ্ত জামানত ছাড়াই ইসলামি শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত তিনটি ব্যাংক থেকে ছয় হাজার ৩৭০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে অখ্যাত নাবিল গ্রুপ। এর মধ্যে অন্তত তিন হাজার ২৭০ কোটি টাকা বেনামি ঋণ হিসেবে সন্দেহের তালিকায় রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে বিশাল অঙ্কের এ ঋণ অনুমোদন হয়েছে। আইনের তোয়াক্কা না করেই গ্রুপটির নামে-বেনামে বিভিন্ন কোম্পানিকে ঋণ অনুমোদন করেছে ব্যাংক তিনটি। যদিও এত বিশাল অঙ্কের টাকা ব্যয় করার সক্ষমতা নেই এসব প্রতিষ্ঠানের। এমনকি ঋণের নথিও গায়েব করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক পরিদর্শনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। বিষয়টি অধিকতর তদন্তের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন বিভাগে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে আসা তথ্যানুযায়ী, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড চার হাজার ৫০ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এক হাজার ২০০ কোটি টাকা এবং সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক এক হাজার ১২০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে অখ্যাত গ্রুপটিকে। এসব ঋণ অনুমোদনের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো ধরনের জামানত রাখা হয়নি। এছাড়া ঋণের অর্থ কোথায় ব্যবহার হবে তাও পরিষ্কার নয়। এসব ঋণ ব্যাংকের পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে বেনামি ঋণ হিসেবে সন্দেহ করে প্রতিবেদন দাখিল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল। অধিকতর পরীক্ষার জন্য ব্যাংকগুলোর কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো ব্যাংক একক কোনো প্রতিষ্ঠানকে ফান্ডেড এবং নন ফান্ডেড মিলিয়ে তার পরিশোধিত মূলধনের ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে। এর মধ্যে ফান্ডেড ১৫ শতাংশ এবং নন ফান্ডেড ২০ শতাংশ। আর বর্তমানে এই তিন ব্যাংকের মোট পরিশোধিত মূলধন তিন হাজার ৬৯০ কোটি টাকা।
এক্ষেত্রে গ্রুপটিকে এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ঋণ দেয়া হয়েছে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। এ বিষয়ে গত ২ অক্টোবর তথ্য-উপাত্তসহ প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক আমার সংবাদ। এরপর ধারাবাহিকভাবে দেশের শীর্ষ গণমাধ্যমগুলোতে বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো মামলা বা সংশ্লিষ্ট কেউ জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হননি।
প্রসঙ্গত, বিগত সময়ে দেশে ঘটে যাওয়া আর্থিক কেলেঙ্কারিগুলোর মধ্যে হলমার্কের ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি। বিসমিল্লাহ গ্রুপ ও অ্যানন টেক্সের ঋণ কেলেঙ্কারি প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতিতে নাম লিখিয়েছে ওয়ান ব্যাংক। এ ছাড়া বেসিক ব্যাংকের তিন হাজার ১০০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি বা সাবেক ফার্মার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা) এক হাজার ৮০০ কোটি টাকার কেলেঙ্কারি ব্যাংক খাতে চরম অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এমন হাজার হাজার কোটি টাকা জালিয়াতিতে রাষ্ট্রীয় ব্যাংক ছাড়াও এবি ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, সাউথ বাংলা, ব্র্যাক ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংকসহ ব্যাংক খাতের কর্তাব্যক্তিরা অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বড় এসব আর্থিক কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের একটি অংশ ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাতে সহযোগিতা করেছে, নিজেরাও লাভবান হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছাড় দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ফলশ্রুতিতে প্রতিটি ঘটনায় মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটলেও কিছু ক্ষেত্রে মামলা থেকে বাদ পড়েছেন প্রকৃত অপরাধীরা। কেউ কেউ জামিনে বা অসুস্থতার নাম দিয়ে হাসপাতালে আয়েশি জীবনযাপন করলেও কোনো ঘটনায় কেউ সাজাপ্রাপ্ত হননি।