Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪,

লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত দেশ

মহিউদ্দিন রাব্বানি

অক্টোবর ১৪, ২০২২, ০১:১৬ এএম


লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত দেশ

চলতি মাসে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা থাকলেও বাস্তবে হয়েছে তার উল্টোটি। এদিকে তীব্র গরমে হাঁসফাঁস জনজীবন, তার ওপর সীমাহীন লোডশেডিং। দু’-এক ঘণ্টা পরপর যাচ্ছে বিদ্যুৎ। রাজধানীতে গড়ে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা, বিভাগীয় ও জেলা শহরে আট থেকে ১০ ঘণ্টা লোডশেডিং থাকছে। গ্রাম পর্যায়ে লোডশেডিংয়েংর প্রভাব আরও চরমে। ব্যাহত হচ্ছে শিল্পোৎপাদন। থেমে যাবে রপ্তানির গতি। বিশ্ব বাজারে ঊর্ধ্বমুখী দাম ও ডলার সংকটের কারণে এলএনজি আমদানি করছে না সরকার।

এ কারণে জিজেল সাশ্রয়ে সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকার কৃচ্ছ্রতা সাধন গেলেও মিলছে না সুফল। আগস্টে ১৮ তারিখ সারা দেশে এলাকাভিত্তিক এক ঘণ্টার লোডশেডিং ঘোষণা করে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। পেট্রোলপামপ সপ্তাহে এক দিন বন্ধ রাখা, এসি ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।

পরবর্তীতে এলাকাভিত্তিক সপ্তাহে একদিন শিল্পোৎপাদন কারখানাও লোডশেডিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা হয়। সরকারি-বেসরকারি অফিসের কর্মঘণ্টা কমানো হয়েছে এক ঘণ্টা। এত কিছুর পরও প্রতিনিয়ত বাড়ছে লোডশেডিং। দিন দিন যেন হাহাকার বেড়েই চলছে।

এদিকে  বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া আমদানি বিল পরিশোধ না করায় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ফার্নেস অয়েল আমদানি করছে না। এতে বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র অসক্ষমতার আংশিক উৎপাদন করছে। পাশাপাশি মেইনটেন্যান্স ও কারিগরি ক্রটির কারণেও বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। এদিকে জ্বালানির অভাবে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। পড়ে থাকছে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা।

গত ৪ অক্টোবর জাতীয় গ্রিডে ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর থেকে লোডশেডিং বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত। চলতি ৮ অক্টোবর (বন্ধের দিন) রেকর্ড দুই হাজার ১০৭ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়। যদিও রোববার তা কিছুটা কমেছে। তবে গত পাঁচ থেকে ছয় দিন ধরে সারা দিনই রাজধানীসহ সারা দেশে প্রচুর লোডশেডিং হচ্ছে। এমনকি মধ্য রাতেও চলছে এক থেকে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং। সব মিলিয়ে গত ৯ অক্টোবর ৩৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোপুরি বন্ধ ছিল।

আর ৯৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় আংশিক। মাত্র ৩৬টি কেন্দ্র সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করা হয়। এতে দিনে পিক আওয়ারে সর্বোচ্চ ৯ হাজার ৭০৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। আর রাতে পিক আওয়ারে উৎপাদন করা হয় ১২ হাজার ৩৮৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। ওই দুই সময়ে লোডশেডিং ছিল যথাক্রমে— এক হাজার ৭০২ মেগাওয়াট ও ৯৮৫ মেগাওয়াট। চলতি মাসের ৪ তারিখে দেশের ৬০ শতাংশ এলাকায় ব্ল্যাক আউটের কবলে পড়ার পর থেকে বেড়েই চলছে লোডশেডিং। দুর্ভোগে পড়েছে পুরো জাতি। ৮ অক্টোবর রেকর্ড পরিমাণ লোডশেডিং করা হয়।

ওইদিন বেলা ৪টায় দুই হাজার ১০৭ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়। আর ৯ অক্টোবর সর্বোচ্চ লোডশেডিং করা হয় বেলা ৩টায়। ওই সময় এক হাজার ৭৭৭ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) দেয়া লোডশেডিংয়ে হিসাবে তথ্য বিভ্রট আছে। মূলত এই হিসাব আরও বেশি হবে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ দুই হাজার থেকে দুই হাজার ২০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করা হয়েছে। এখন তা বেড়ে হয়েছে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত। গত তিন মাসের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তিন থেকে চার ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকছে না এখন। আর ঢাকার বাইরে কোনো কোনো এলাকায় সাত থেকে ১৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। ময়মনসিংহ বিভাগে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) আওতাধীন এলাকায় দিনের অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎ থাকছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দাম বেড়ে যাওয়ায় তরলীকৃত গ্যাস (এলএনজি) আমদানি কমানো হয়েছে। গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন কমেছে। বিল বকেয়া বাড়তে থাকায় তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকেও চাহিদামতো উৎপাদন করা যাচ্ছে না। আগাম শীতে বিদ্যুতের চাহিদা কমার ভরসায় ছিল সরকার। গরম না কমায় সেটিও কাজে আসেনি। তাই অক্টোবরে লোডশেডিং বন্ধ করার পুরোনো সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার।

গত রোববার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু গণমাধ্যমকে বলেন, গ্যাস আনতে না পারায় নভেম্বরের আগে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতির আশা নেই। লোডের কারণে আমরা দিনের বেলা কিছু পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ রাখছি। আবার দিনে যেগুলো চালাচ্ছি সেগুলো রাতে বন্ধ রাখছি। এ জন্য লোডশেডিংয়ের জায়গাটা একটু বড় হয়ে গেছে। আমরা চেয়েছিলাম অক্টোবর থেকে কোনো লোডশেডিংই থাকবে না। কিন্তু সেটি আমরা করতে পারলাম না। কারণ আমরা গ্যাস আনতে পারিনি। অক্টোবর মাসটা একটু কষ্ট করতে হবে। আশা করছি, সামনের মাস থেকে আরেকটু ভালো হবে।

অন্যদিকে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হাবিবুর রহমান বলেছেন, দু’-একদিনের মধ্যেই বিদ্যুৎ পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হতে শুরু করবে। তিনি বলেন, ঘোড়াশালের একটি উপকেন্দ্রে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে পূর্বাঞ্চলের উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ পশ্চিমাঞ্চলে আনতে না পারায় পরিস্থিতি বেশি অবনতি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরস্পরবিরোধী কথাবার্তায় বিভ্রান্ত হয় সাধারণ মানুষ।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক অধ্যাপক ড. ম. তামিম বলেন, ‘এক মাস পর হয়তো বিদ্যুৎ খাতে উন্নতি পাওয়া যেতে পারে। তবে আগামী গ্রীষ্মে (মার্চ-এপ্রিল) পরিস্থিতি কী হবে, ভাবা যাচ্ছে না।’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানি-বিষয়ক বিশেষ এই সহকারী ম. তামিম আরও বলেন, ‘জুনে ৮৫ কোটি ঘনফুট সরবরাহের কথা ছিল পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে ছিল দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ওমান ও কাতার থেকে আনা ৫০ কোটি ঘনফুট এলএনজি। এ দুই দেশ থেকে প্রতি মাসে পাঁচটি করে এলএনজির জাহাজ আসছিল গত জুন থেকে।

চুক্তি অনুসারে, অক্টোবরে আসবে মোট চারটি জাহাজ। আর ডলার-সংকটের কারণে খোলাবাজারে (স্পট মার্কেট) এলএনজি কেনা বন্ধ রয়েছে গত জুলাই থেকে। তবে বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম কমছে। গত তিন মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে এখন। ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) এবং ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এটি নিশ্চিত করেছেন। জুলাই মাসে দিনে একবার লোডশেডিং করার কথা থাকলেও তা দুই থেকে তিনবার করতে হয়েছে। অক্টোবরে চাহিদা কমার বদলে আরও বেড়েছে।

ডিপিডিসি সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ মেগাওয়াট ঘাটতি হচ্ছে। গত তিন মাসে এমন পরিস্থিতি হয়নি। কোথাও কোথাও এখন দিনে পাঁচবার লোডশেডিং করতে হচ্ছে। কিছু দিন ধরে পরিস্থিতি খুব খারাপ যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ডেসকোর এমডি আমির কাউসার আলী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দিনে ৩০০ মেগাওয়াটের মতো সরবরাহ ঘাটতি হচ্ছে। কোনো কোনো ফিডারে (নির্দিষ্ট গ্রাহক এলাকা) দিনে চারবার পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র বলছে, ভারত থেকে আমদানির বাইরে দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৯ হাজার ৫৩৭ মেগাওয়াট। দিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে ৯ হাজার থেকে সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট। আর এখন চাহিদা আছে ১২ হাজার থেকে সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত। বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন সক্ষমতার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কাজে লাগাতে পারছে না শিল্পকারখানা। বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বেশির ভাগই নিজেরা ফার্নেস তেল আমদানি করে চালায়। বাড়তি দামে ডলার কিনে জ্বালানি তেল আমদানি করতে হচ্ছে তাদের। এতে করে লোকসান হচ্ছে তাদের। এদিকে পড়ে আছে অলস বিদ্যুৎকেন্দ্র।

পিডিবির তথ্য বলছে, দেশে এখন মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১৩৩। এর মধ্যে গ্যাসচালিত ৫৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার ১৭ মেগাওয়াট। উৎপাদন হচ্ছে মাত্র পাঁচ হাজার মেগাওয়াট। অর্ধেকের বেশি উৎপাদন ক্ষমতা অলস পড়ে থাকছে গ্যাসের অভাবে। ফার্নেস তেলচালিত ৫৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা পাঁচ হাজার ৫৪১ মেগাওয়াট এবং ১১টি ডিজেল কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা এক হাজার ৫১৫ মেগাওয়াট। সব মিলে জ্বালানি তেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা সাত হাজার মেগাওয়াটের বেশি হলেও দিনে গড়ে উৎপাদন হচ্ছে আড়াই থেকে চার হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত।

এদিকে গতকাল বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, গরমের তীব্রতা না কমলে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। তাপমাত্রা কমার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে। লোডশেডিং নিয়ে আপাতত কিছুই করার নেই। অন্যদিকে বিদ্যুতের এমন মহা দুর্যোগে বাড়ছে জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম। চলতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ার কথা জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।

Link copied!