অক্টোবর ১৬, ২০২২, ০১:২২ এএম
করোনা-পরবর্তী জীবন নিয়ে উদ্বেগে ওরা। হতাশা আর বেঁচে না থাকার আকাঙ্ক্ষাও ভর করেছে ওদের কারো কারো জীবনে। জীবন নিয়েই যেন ওদের সব অভিযোগ। করোনা-পরবর্তী জীবন নিয়ে কতটুকু সন্তুষ্ট— এমন প্রশ্নের উত্তরে ১০.১৮ শতাংশ শিক্ষার্থী উদ্বেগজনক অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। অনেকে আবার মানসিক চাপের কবলে আত্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্তের পথে পা বাড়িয়েছেন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪০৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।
এরমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ৫৭ জন, স্কুলের ২১৯ জন, মাদ্রাসার ৪৪ জন ও কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী ৮৪ জন। আত্মহননের পথকে জাগতিক সমস্যার সমাধান হিসেবে বেছে নেয়া এসব শিক্ষার্থীর ২৪২ জন নারী, পুরুষের সংখ্যা ১৬২ জন।
গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা-পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। বেড়েছে হতাশা, ভার্চুয়াল আসক্তি ও নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার মানসিকতাও। ফলে ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তা, একাডেমিক চাপে নাজেহাল ও অর্থনৈতিক সংকটে আত্মহননের মতো ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্তও নিয়েছেন শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ। করোনায় দীর্ঘ বিরতির ফলে সৃষ্ট সেশনজট, পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে হতাশা, শিক্ষাঙ্গনে পঠিত বিষয় বুঝতে না পারা এবং পারিবারিক টানাপড়েনের কবলে এমন ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন।
এক হাজার ৬৪০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে চালানো ওই জরিপে জানা গেছে, করোনা-পরবর্তী সময়ে আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ৩৪.১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। আত্মহত্যার উপকরণ জোগাড় করেও পিছিয়ে এসেছেন ৪.৭৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আর ২.৪৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতিরোধযোগ্য। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। আত্মহত্যা প্রতিরোধের নিশ্চিত নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ও কর্মসূচি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের কাজ সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দসহ এ সংক্রান্ত জাতীয় নীতি ও তার শতভাগ প্রয়োগের উদ্যোগ নিশ্চিত করতে হবে।
একই সাথে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন, অতিরিক্ত সিলেবাস কমিয়ে যথাসময়ে পরীক্ষা শেষ করা, চাকরি বাজারের উপযোগী সিলেবাস প্রণয়ন, শিক্ষা ঋণ প্রকল্প চালু ও জরুরি ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মনোবিজ্ঞানী এবং স্কুল কলেজে শিক্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাউন্সেলিংয়ে ওপর জোর দিতে হবে বলেও মত তাদের।
আঁচল ফাউন্ডেশনের ‘করোনা-পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর একাডেমিক চাপের প্রভাব ও তাদের আত্মহত্যার প্রবণতা’ শীর্ষক জরিপে দেখা গেছে, করোনা পরবর্তী একাডেমিক চাপের কারণে বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার অভিজ্ঞতা জানিয়েছে ৭৫.৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। জরিপে অংশ নেয়া ৭০.৭৩ শতাংশ শিক্ষার্থী মোবাইল, ল্যাপটপ ও ডেস্কটপের সাথে সম্পৃক্ত থেকে ভার্চুয়াল আসক্তির কথা জানিয়েছে। অনলাইন-নির্ভর এ আসক্তিতে একাকিত্ব, নিজেদের গুটিয়ে নেয়ার মানসিকতা ও অতিরিক্ত ঘুম অথবা নিদ্রাহীনতার কথা জানিয়েছে অনেকে। অপরদিকে সন্তানদের প্রতি অতিরিক্ত স্বপ্ন বা প্রত্যাশার চাপে ৫৫.৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন।
এ প্রসঙ্গে আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ আমার সংবাদকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা এবং আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে পড়া নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। যে সমস্যাগুলো নিয়ে তারা ভুগে থাকেন তাদের অনেক সমস্যার সমাধানই কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে সম্ভব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পড়াশোনার সঠিক পরিবেশ নিশ্চিত করা, শিক্ষকদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি এবং মন খুলে কথা বলার মতো সামাজিক পরিবেশ তৈরি করার মাধ্যমেও তাদের এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা আমার সংবাদকে বলেন, ‘মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তবে মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকির আরও কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, আমাদের আজকের সমাজকাঠামো ভোগবাদী। এ সমাজে পরস্পরের সাথে খুব বেশি প্রতিযোগিতা চলে। একইসাথে আমাদের যাপিত জীবনের চাহিদাও ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা যদি বর্তমান প্রজন্মের সাথে আমাদের প্রজন্মের তুলনা করি তাহলে দেখা যাবে— আমাদের শিক্ষা, সামাজিকীকরণ, আদর্শ, পরিমিত জীবনবোধ ও কম জিনিসিকে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা এবং সেগুলোর সঠিক ব্যবহার করার শিক্ষা ছিল। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম এই জায়গা থেকে অনেকটা সরে এসেছে।’
বর্তমানে আমরা এখন একটি বাজার অর্থনীতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আপনি পছন্দ করেন অথবা না করেন এ সমাজ অনেক বেশি ভোগবাদী। একটি জিনিস থাকার পরেও অন্য আরেকটি জিনিসের নতুন চাহিদার জন্ম নিচ্ছে। চাহিদাই যেন ফ্যাশনে রূপ নিচ্ছে। এর ফলে সবসময় চাই চাই মানসিকতা থেকে কল্পনার সাথে বাস্তবতার মিল হয় না। এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের চাওয়া এবং প্রাপ্তির মধ্যে বিশাল একটি তফাৎ তৈরি হয়েছে। এ তফাৎ এত বেশি যে, আমরা মানসিকভাবে নিতে পারছি না।
এর পেছনে অর্থনৈতিক কারণ, মনস্তাত্বিক কারণ ও পারিবারিক-সামাজিকীকরণ কারণে একটি মনস্তাত্বিক সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে প্রকৃতিগভাবে আমাদের সংগ্রামী জীবন আরও বেশি জটিল হয়ে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এ কারণে ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আমাদের সময় আমাদের এত আকাঙ্ক্ষা ছিল না। কিন্তু এই প্রজন্মে তা হারহামেশাই হচ্ছে না।
দ্বিতীয়ত, মিডিয়া, সোশ্যাল ও প্রযুক্তির নানামুখী ছোবল শিক্ষার্থীদের একটি ভিন্ন জগতে নিয়ে গেছে, আরও বেশি সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের সময় যে বয়সে গল্পের বই পড়েছি— একটি বিষয় নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবার সময় পেয়েছি। এখনকার বাচ্চারা সেই বয়সে স্মার্টফোনে বুঁদ হয়ে থাকছে। ফলে এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছে।
সর্বশেষ, আমরা একটি সমাজ একটি পরিবর্তনের সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের মধ্যে একটি সংস্কৃতিক পার্থক্য রয়েছে। এখানে একই সমাজে কেউ খুব রক্ষণশীল মূল্যবোধের, কেউ পশ্চিমা সংস্কৃতির মূল্যবোধে বিশ্বাসী কেউ আবার ঔপনিবেশিক মানসিকতার। একই সমাজে এত ধরনের মূল্যবোধের চর্চা প্রতিষ্ঠিত থাকায় কোনটি সঠিক আর কোনটি ভুল তা নির্ধারণ করাটা বেশ কঠিন হচ্ছে। এর ফলে কোনটি আমাদের গ্রহণ করা উচিত এবং কোনটি বর্জন করা উচিত তা স্পষ্ট হচ্ছে না।
এর একটি প্রভাব পড়ছে আমাদের পরিবারেও। আমরা আজকাল একক পরিবারে রূপ নিচ্ছি। ধীরে ধীরে আত্মীয় স্বজন থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আজকাল দেখা যায়— এ প্রজন্ম আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক রাখতে অনীহা প্রকাশ করে। তাদের আনন্দ উদযাপনের উপকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন প্রযুক্তিপণ্য। যে মানুষ প্রিয়জন ছেড়ে যন্ত্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবে সে তো মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভুগবেই।’