অক্টোবর ১৮, ২০২২, ০১:৩০ এএম
বাংলাদেশের ইতিহাসে নিষ্ঠুর অমানবিক পাশবিকতার শিকার হয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠপুত্র ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদরের ছোট ভাই শেখ রাসেল। প্রতিহিংসা-প্রতিশোধ না বুঝলেও ছোট্ট রাসেলের বুক ভেদ করেছিল ঘাতকের নির্মম বুলেট। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ছোট্ট রাসেলে সাথে ঘটে যাওয়া অমানবিকতা আজও বিশ্ববিবেককে নাড়া দেয় এবং নির্যাতন আর নিপীড়নের প্রতিবাদী মুখ হিসেবে শহীদ শেখ রাসেল উঠে আসে সবার উপরে। বিশ্বে অধিকার বঞ্চিত শিশুদের মানবিকসত্তার প্রতীক শেখ রাসেল।
১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনে জন্মগ্রহণ করা সেই শেখ রাসেলের ৫৯তম জন্মদিন আজ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মানবতার শত্রু ঘৃণ্য ঘাতকদের নির্মম বুলেট বঙ্গবন্ধু এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে নরপিশাচরা নির্মমভাবে তাকেও হত্যা করেছিল। সে তখন ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিল। আল্লাহর দোহাই দিয়ে না মারার জন্য খুনিদের কাছে আর্তি জানিয়েছিল শেখ রাসেল।
সে চিৎকার করে বলেছিল, ‘আল্লাহর দোহাই আমাকে জানে মেরে ফেলবেন না। বড় হয়ে আমি আপনাদের বাসায় কাজের ছেলে হিসেবে থাকব। আমার হাসু আপা দুলাভাইয়ের সাথে জার্মানিতে আছেন। আমি আপনাদের পায়ে পড়ি, দয়া করে আপনারা আমাকে জার্মানিতে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিন।’ কিন্তু সেদিন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠপুত্র রাসেলের সেই আর্তচিৎকারে স্রষ্টার আরশ কেঁপে উঠলেও টলাতে পারেনি খুনি পাষাণদের মন। বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মতো এই নিষ্পাপ শিশুকেও পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়।
১৫ আগস্টের কালরাতে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডে নিহত রাসেল সম্পর্কে চাক্ষুষ সাক্ষী বঙ্গবন্ধুর আবাসিক ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মুহিতুল ইসলাম জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘শেখ রাসেলকে নিচে নামিয়ে আনা হয়েছে। ভয়ার্ত রাসেল আমাকে দেখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। ও আমাকে সবসময় খেলার সাথী ভাবত। ও কাতর কণ্ঠে বলল, ভাইয়া ওরা আমাকে মারবে না তো? আমি আশ্বস্ত করে বললাম, না ভাইয়া ওরা তোমাকে মারবে না। তখন কে ভেবেছিল ৯ বছরের অবুঝ শিশুটিও ওদের হাত থেকে রেহাই পাবে না। রাসেলের করুণ মিনতি দেখে আমার চোখ ফেটে জল এলো। কিন্তু হায়, আমি অক্ষম। ওর জন্য কিছুই করতে পারছিলাম না।
তবে ওকে আড়াল করতে চেষ্টা করতেই এক ঘাতক এসে রাইফেলের বাঁট দিয়ে আমাকে উপর্যুপরি পেটাল। মারতে দেখে ভয়ে রাসেল আমাকে ছেড়ে দিলো। ভয়ে ও খুব চিৎকার করছিল। আমি মায়ের কাছে যাবো, মায়ের কাছে যাবো। ওপরে তখনো প্রচণ্ড গুলির শব্দ। একজন ঘাতক আরেকজন ঘাতককে বলল, যাও ওকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে এসো। এত মৃত্যুশোকের মধ্যেও আমার প্রাণটা খুশিতে ভরে গেলো। তাহলে হয়তো বেগম মুজিবকে আমরা হারাইনি। তিনি হয়তো অক্ষত আছেন। আমি তো আর জানতাম না যে, এটি ছিল নিষ্ঠুর ঘাতকদের একটি ছল। রাসেলকে যখন ওপরে নিয়ে যাওয়া হলো, মনে হলো যেন একটা নিস্তব্ধ পাথর আমার সামনে দিয়ে সরে যাচ্ছে। ওর শিশুমন কি কিছু বুঝতে পেরেছিল যে, পায়ে পায়ে ও মৃত্যুপুরীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? ওপরে নিয়ে যাওয়ার পর শিশুকণ্ঠের একটি আর্তচিৎকার। তারপর সব স্তব্ধ। রাসেলের হত্যাকাণ্ডটিই ছিল সে রাতের শেষ হত্যাকাণ্ড।’
সেদিন বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরা শেখ রাসেলকে হত্যার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তাদের সেই অপচেষ্টা শতভাগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। শহীদ শেখ রাসেল আজ বাংলাদেশের শিশু-কিশোর, তরুণ, শুভবুদ্ধিবোধসম্পন্ন মানুষদের কাছে ভালোবাসার নাম। অবহেলিত, পশ্চাৎপদ, অধিকারবঞ্চিত শিশুদের আলোকিত জীবন গড়ার প্রতীক হয়ে গ্রাম-গঞ্জ-শহর তথা বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ জনপদ-লোকালয়ে শেখ রাসেল আজ এক মানবিক সত্তায় পরিণত হয়েছে। মানবিক চেতনা সম্পন্ন সব মানুষ শেখ রাসেলের মর্মান্তিক বিয়োগ বেদনাকে হূদয়ে ধারণ করে বাংলার প্রতিটি শিশু-কিশোর তরুণের মুখে হাসি ফোটাতে আজ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কনিষ্ঠ পুত্র জন্মগ্রহণের পর বঙ্গবন্ধু তার প্রিয় লেখক খ্যাতিমান দার্শনিক ও নোবেলবিজয়ী ব্যক্তিত্ব বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে পরিবারের নতুন সদস্যের নাম রাখেন ‘রাসেল’।
এই নামকরণে মা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। শৈশব থেকেই দুরন্ত প্রাণবন্ত রাসেল ছিল পরিবারের সবার অতি আদরের। কিন্তু মাত্র দেড় বছর বয়স থেকেই প্রিয় পিতার সাথে তার সাক্ষাতের একমাত্র স্থান হয়ে ওঠে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। তবে সাত বছর বয়সে ১৯৭১ সালে সে নিজেই বন্দি হয়ে যায়। শেখ রাসেলের ভুবন ছিল তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামালকে ঘিরে।
‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ে বড় বোন শেখ হাসিনা স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ‘রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেজো ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেজো ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখব। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালো চুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড়সড় হয়েছিল রাসেল।’
শিশুপুত্র রাসেলকে নিয়ে আবেগঘন স্মৃতিচারণ করে কারাগারের রোজনামচায় বইয়ে ১৯৬৬ সালের ১৫ জুনের দিনলিপিতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না— যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে আগের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। জেলগেট দিয়ে একটি মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকেছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিলো। ওরা বলল, আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। এখন ধারণা হয়েছে, এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়।’
একই বইয়ে ১৯৬৭ সালের ১৪-১৫ এপ্রিলের অন্যান্য প্রসঙ্গ ছাড়াও রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “জেল গেটে যখন উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাঁড়াইয়া নাই দেখে আশ্চর্যই হলাম। আমি যখন রুমের ভিতর যেয়ে ওকে কোলে করলাম আমার গলা ধরে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে ‘আব্বা’ বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাপার কি?’ ওর মা বলল, বাড়িতে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কাঁদে তাই ওকে বলেছি আমাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকতে।” রাসেল ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দেই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, ‘তুমি আমার আব্বা’। আমার উপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না।’
গত বছর প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয় ‘শেখ রাসেল দিবস’। এর ধারাবাহিতকায় শেখ রাসেল জাতীয় দিবসের এবারের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে— ‘শেখ রাসেল নির্মলতার প্রতীক, দুরন্ত প্রাণবন্ত নির্ভীক।’ জাতীয়ভাবে সারা দেশে একযোগে এবং বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসসমূহে শেখ রাসেল দিবস-২০২২ পালিত হবে। দিবসটি উপলক্ষে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে সকাল ৬টায় বনানী কবরস্থানে শেখ রাসেলের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে দিবসটির কার্যক্রম শুরু হবে। সকাল সাড়ে ৬টায় নিজ নিজ মন্ত্রণালয় বা বিভাগ বা দপ্তর বা সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান ও প্রাঙ্গণে শেখ রাসেলের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হবে। আইসিটি বিভাগের উদ্যোগে সকাল সাড়ে ৭টায় পরিকল্পনা কমিশন-এর সামনে হতে বি আইসিসি প্রাঙ্গণ পর্যন্ত সকলের অংশগ্রহণে র্যালি অনুষ্ঠিত হবে। সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের (বিআইসিসি) হল অব ফেমে শেখ রাসেল দিবসের উদ্বোধন ও শেখ রাসেল পদক দেবেন।
বেলা আড়াইটায় ‘শেখ রাসেলের নির্মম হত্যাকাণ্ড ন্যায়বিচার, শান্তি ও প্রগতির পথে কালো অধ্যায়’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনার, একই স্থানে সন্ধ্যা ৬টায় ‘কনসার্ট ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস’ অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া দিবসটি উপলক্ষে দেশের সকল বিভাগ, জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হবে। শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের উদ্যোগে চিত্রাঙ্কন, দাবা, জাতীয় ফুটবল টুর্নামেন্ট ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়েছে। বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, কোনো শিশুই যাতে শেখ রাসেলের মতো নৃশংসতার শিকার না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, শেখ রাসেল বেঁচে থাকলে হয়তো আজ জাতির নেতৃত্ব দিতেন। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করতেন। কিন্তু বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্রের হাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নির্মমভাবে শহীদ হন। ঘাতকরা ১০ বছরের ছোট্ট রাসেলকেও সেদিন রেহাই দেয়নি। ছোট্ট রাসেল সেদিন ঘাতকদের মিনতি করে বলেছিলেন, ‘আমি মায়ের কাছে যাব’ কিন্তু সেই কুলাঙ্গার ঘাতকদল তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। মৃত্যুকালে রাসেল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিল। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকারদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা সফল হয়নি। রাসেল আজ বিশ্বে অধিকারবঞ্চিত শিশুদের প্রতীক ও মানবিকসত্তা হিসেবে বেঁচে আছে সবার মধ্যে।
শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আজ সকাল ৯টায় বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত শেখ রাসেলসহ ১৫ আগস্টে নিহত শহীদদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে। আ.লীগের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আ.লীগ, সহযোগী সংগঠন এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।