নিজস্ব প্রতিবেদক
অক্টোবর ২২, ২০২২, ০১:০০ এএম
নিজস্ব প্রতিবেদক
অক্টোবর ২২, ২০২২, ০১:০০ এএম
ময়মনসিংহে সমাবেশের দিন গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও এবার ঘোষণা দিয়ে খুলনায় দুই দিন পরিবহন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাস মালিক সমিতি। নছিমন-করিমন-ভটভটিসহ সব ধরনের যান চলাচল বন্ধের প্রতিবাদে খুলনায় দুই দিনের পরিবহন ধর্মঘট চলছে। খুলনা জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতি ও খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন যৌথভাবে এই ধর্মঘট ডেকেছে।
গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে দুদিনের এই ধর্মঘট শুরু হয়েছে। গতকাল ভোর থেকে অনেক যাত্রী সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালে এসে বাস না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। কেউ কেউ অন্য যানবাহনে চড়ে গন্তব্যে রওনা দিচ্ছেন। এদিকে বাসের পর লঞ্চ চলাচলও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ১০ দফা দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার ঘর্মঘট ডেকেছে বাংলাদেশ লঞ্চ লেবার অ্যাসোসিয়েশন। ফলে সারা দেশ থেকে খুলনা কার্যত বিছিন্ন হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তি সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে।
বাংলাদেশ লঞ্চ লেবার অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ধর্মঘটের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, ১০ দফা দাবিতে তারা যাত্রীবাহী লঞ্চে ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট শুরু করেছেন। ফলে দুটি রুটে ছয়টি লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। বাস ধর্ঘটের কারণে খুলনায় কোনো যানবাহন প্রবেশ করতে পারছে না। খুলনা থেকে কোনো যানবাহন ছেড়ে যাচ্ছে না। ফলে খুলনার সাথে ১৮টি রুটের বাস চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে পড়েছে। এতে দূর-দূরান্তের যাত্রীরা চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।
খুলনা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনা অভিযোগ করে বলেন, শনিবার খুলনার সোনালী ব্যাংক চত্বরে বিএনপি বিভাগীয় গণসমাবেশ ডেকেছে। এই গণসমাবেশে নেতাকর্মীদের আসা ঠেকাতে সরকারের নির্দেশে বাসমালিক সমিতি এই ধর্মঘট ডেকেছে। এসব অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন বাসমালিক সমিতির সহ-সভাপতি কাজী এনায়েত হোসেন। তিনি বলেন, সরকারের নির্দেশে বাস বন্ধ করার অভিযোগ সঠিক নয়।
মাগুরায় বাস বন্ধ, ট্রেন-ট্রলারে নেতাকর্মীরা : খুলনা নগরের সাথে বাস চলাচল বন্ধ রেখে বিভাগের অন্য সব জেলায় বাস চলাচল স্বাভাবিক রেখেছে মাগুরার বাসমালিক ও চালকরা। তবে খুলনার সাথে সরাসরি বাস চলাচল বন্ধ থাকলেও ইতোমধ্যে মাগুরার অধিকাংশ নেতাকর্মীরা খুলনা পৌঁছে গেছেন বলে দাবি করেছে জেলা বিএনপি। জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আকতার হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার রাতেই অনেক নেতাকর্মী বাসে করে খুলনা চলে গেছেন। আবার অনেকে আজ যশোর পর্যন্ত বাসে গিয়ে, সেখান থেকে ট্রেনে করে খুলনা গেছেন। বাকি নেতাকর্মীরা শনিবার বাসে করে যশোর যাবেন।
পরে সেখান থেকে ভেঙে ভেঙে ছোট যানবাহন ও মোটরসাইকেলে করে খুলনা পৌঁছাবেন। দুর্ভোগ ও কষ্ট করে হলেও মাগুরা বিএনপির নেতাকর্মীরা খুলনার সমাবেশে যোগদান করবেন। তিনি জানান, খুলনার সমাবেশকে সামনে রেখে মাগুরায় বিএনপির কোনো নেতাকর্মীকে পুলিশ হয়রানি বা আটক করেনি। তবে শুক্রবার ভোরে খুলনার সোনাডাঙ্গা থানা পুলিশ মাগুরার শ্রীপুর উপজেলা বিএনপির ১০ নেতাকর্মীকে আটক করেছে। ওই নেতাকর্মীরা বাস থেকে খুলনায় পৌঁছানোর পরই তাদের আটক করা হয়। এ ছাড়া খুলনায় হোটেলে থাকা মাগুরার নেতাকর্মীদের পুলিশ নানাভাবে হয়রানি করছে।
এদিকে মহম্মদপুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যক্ষ মৈমুর আলী মৃধা ও সদস্য সচিব আক্তারুজ্জামান সমাবেশ সফল করতে এবং কর্মীদের উৎসাহ দিতে শুক্রবার সকালেও উপজেলা সদরে নেতাকর্মীদের নিয়ে লিফলেট বিতরণ করেছেন। তারা বলেন, সমাবেশ সফল করতে তারা যেকোনো উপায়ে খুলনা পৌঁছাবেন। ইতোমধ্যে অনেক নেতাকর্মী বিভিন্নভাবে খুলনা পৌঁছে গেছেন। বাকি নেতা কর্মীরাও খুলনা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন।
বিএনপির নেতা জানান, তারা আজই নদীপথে একাধিক ট্রলারে করে খুলনার উদ্দেশে রনা দেবেন। শালিখা উপজেলা বিএনপির সভাপতি আনিচুর রহমান মিল্টন জানান, সব বাধা উপেক্ষা করে দলীয় নির্দেশে অনেক নেতাকর্মী ইতোমধ্যে বিভিন্নভাবে খুলনা পৌঁছে গেছেন। অনেকে যশোর থেকে ট্রেনে করে খুলনা গেছেন।
শুক্রবার অনেকে রওনা করেছেন। শ্রীপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি বদরুল আলম হিরো জানান, তিনি নেতাকর্মীদের নিয়ে খুলনা যাওয়ার জন্য আটটি বাস ও পাঁচটি মাইক্রোবাস ভাড়া করেছিলেন। কিন্তু সরকার দলের চাপে বৃহস্পতিবার বাস ও মাইক্রোবাস মালিকরা ভাড়া বাতিল করেছে। যে কারণে শুক্রবার রাতেই অনেক নেতাকর্মী বাসে করে খুলনা পৌঁছেছেন।
২০০ নেতাকর্মীকে পাংশা দিয়ে ট্রেনে করে পাঠানো হয়েছে। অনেক নেতাকর্মী যশোর পর্যন্ত বাসে গিয়ে বিকল্প উপায়ে খুলনা যাচ্ছেন। মাগুরা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইসহাক মল্লিক ও মটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ইমদাদুর রহমান জানান, মাগুরায় আন্তঃজেলা বাস ধর্মঘটের কোনো প্রভাব পড়েনি। সরাসরি খুলনা বাদে সব জেলার সাথে বাস চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।
সাতক্ষীরা-খুলনা রুটে বাস চলাচল বন্ধ, হেঁটে সাঁতার কেটে সমাবেশে : সাতক্ষীরা-খুলনা মহাসড়কে শুক্রবার সকাল থেকে বন্ধ রয়েছে যাত্রীবাহী বাস চলাচল। খুলনা রুটে চলছে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট। ফলে চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। এদিকে আজ দুপুরে খুলনা নগরের সোনালী ব্যাংক এলাকায় অনুষ্ঠিত হবে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ। পরিবহন বন্ধ থাকায় আশাশুনি, শ্যামনগর ও কালিগঞ্জ উপজেলার বিএনপির নেতাকর্মীরা নদীপথে খুলনায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে।
শুক্রবার দুপুরের পর থেকে অনেক নেতাকর্মী লঞ্চ দিয়ে খুলনার উদ্দেশে রওনা দিয়েছে বলে জানা গেছে। সাতক্ষীরা জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির আহ্বায়ক সাইফুল করিম সাবু বলেন, সাতক্ষীরায় পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়নি। তবে বাস মালিক ও শ্রমিকরা নিরাপত্তাজনিত কারণে খুলনা রুটে বাস বন্ধ রেখেছে। যদি কোনো বাসমালিক বাস চালাতে চায় সে ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই।
সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাড. সৈয়দ ইফতেখার আলী বলেন, খুলনার সমাবেশ বাধা দিতে সরকার পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে। তারা বাস বন্ধ করে দেবে এটি আমরা আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। বেশির ভাগ নেতাকর্মী রওনা হয়েছে, হেঁটে অথবা নদীতে সাঁতার কেটে আজ খুলনাতে অসংখ্য নেতাকর্মী পৌঁছে যাবে। তবে সাতক্ষীরায় বিএনপির কোনো নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়নি। সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান বলেন, অহেতুক কোনো মানুষকে পুলিশ হয়রানি করবে না। তবে কেউ বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বাগেরহাটে গণপরিবহন বন্ধ, ছয় হাজার পরীক্ষার্থীর দুর্ভোগ : শুক্রবার ভোর থেকে বাগেরহাট জেলা সদরসহ সব উপজেলার যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন জনসাধারণ। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে আসা পরীক্ষার্থীরা। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় কেউ হেঁটে, কেউ ভ্যান বা ইজিবাইকে চড়ে চেষ্টা করছেন খুলনা, যশোর, পিরোজপুরসহ নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছানোর। বাগেরহাটে শুক্রবারের নিয়োগ পরীক্ষায় ছয় হাজার পরীক্ষার্থী অংশ নেয়ার কথা রয়েছে।
সরেজমিন বাগেরহাট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে দেখা যায়, নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে গোপালগঞ্জে যাবেন ইয়ামিন নামের এক পরীক্ষার্থী। বড় ভাইয়ের সাথে বের হয়ে কোনো যানবাহন না পাওয়ায় হাঁটতে দেখা যায় তাকে। আক্ষেপ করে বলছিলেন, সমাবেশ খুলনায় হলেও ঢাকার পরিবহন বন্ধ রাখা হয়েছে। সময়মতো কেন্দ্রেই হয়তো যেতে পারব না।
পাবনা থেকে পিরোজপুরের উদ্দেশে আসা হাসান নামের এক ব্যক্তি বলেন, খুলনায় ভোর ৪টার সময় পৌঁছালেও ভ্যানে চড়ে বাগেরহাট আসতে সময় লেগেছে প্রায় চার ঘণ্টা। বাসস্ট্যান্ডে এসে আর কিছু না পাওয়ায় অপেক্ষায় রয়েছি। বাড়ি যেতে পারব কি-না তাই নিয়ে সংশয়ে রয়েছি।
খুলনায় বাড়িতে বাড়িতে পুলিশের অভিযান ৬০ নেতাকর্মী আটক দাবি বিএনপির : খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলায় বৃহস্পতিবার সারারাত অভিযান চালিয়ে ৬০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে দাবি করেছে বিএনপি। এর মধ্যে খুলনা মহানগরী থেকেই আটক করা হয়েছে ৪৭ জনকে। শুক্রবার দুপুরে খুলনার কেডি ঘোষ রোডের বিএনপি কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু এই অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, নানা উসকানির মুখে আমরা সমাবেশে অংশ নেবো। যেকোনো মূল্যে শনিবার স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জনস্রোত হবে খুলনায়। খুলনা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন অভিযোগ করেন, বৃহস্পতিবার বিকাল থেকেই নগরজুড়ে পুলিশের ধরপাকড় শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার সারারাত পুলিশ শতাধিক বিএনপি নেতাকর্মীর বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে। খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে ৬০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। পুলিশের তৎপরতায় বিভিন্ন এলাকায় ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তবে ধরপাকড় চালিয়ে সমাবেশমুখী জনস্রোত ঠেকানো যাবে না।
জনগণকে বাধা দিয়ে খুলনার সমাবেশকে বন্ধ করতে চাচ্ছে সরকার —মির্জা ফখরুল : বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সরকার জনভীতি রোগে ভোগে। মানুষ দেখলেই ভয় পায়। নির্বাচনগুলো সেভাবেই করে যাতে দলগুলোকে বাদ দিয়ে করা যায়। সেই পদ্ধতিতেই নির্বাচন করে। অসুখটাই তাই, রোগটাই তাই। তারা ভয় পাচ্ছে এভাবে যদি জনগণ জেগে ওঠে তাহলে উত্তাল সৃষ্টি হবে, আর হবেই। তখন তাদের অত্যন্ত ধিকৃত অবস্থায় চলে যেতে হবে। শুক্রবার দুপুরে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয় সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, কি কারণে জনগণকে বাধা দিয়ে খুলনার সমাবেশকে বন্ধ করতে চাচ্ছে সরকার— তার একটাই কারণ, সমাবশে মানুষ যদি বাড়তে থাকে তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব হবে না। জনগণের উত্তাল তরঙ্গে তাদের ভেসে যেতে হবে। খুলনায় বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকার একটি সন্ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে আন্দোলন করছি। এরই অংশ হিসেবে শনিবার খুলনায় আমাদের সমাবেশ। এই সমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকার একটি সন্ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করছে খুলনায়। পথে পথে আমাদের নেতাকর্মীদের, সাধারণ মানুষদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, খুলনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য চন্দ্র রায় যে বাড়িতে অবস্থান করেছিলেন বৃহস্পতিবার রাতে সেই বাসায় পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে সেখান থেকে ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমি জানতে পেরেছি নির্দেশ দেয়া হয়েছে সড়কে যাকে যেখানে পাওয়া যাবে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। বৃহস্পতিবার তারা (আওয়ামী লীগ) লাঠিসোটা রামদা নিয়ে শোডাউন করেছে। মোটরসাইকেল নিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে।’