অক্টোবর ২৩, ২০২২, ১২:৩৪ এএম
সমস্যায় থাকা বেশ কয়েকটি ব্যাংক চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) আয় করেছে। বাস্তবে তাদের আয় হওয়ার কথা নয়। কিন্তু নিয়মের ফাঁকফোকর গলিয়ে এসব ব্যাংক আর্থিক প্রতিবেদনে আয় দেখিয়েছে। একই কারণে বেড়েছে সম্পদের পরিমাণও। এতে বাহির থেকে ব্যাংকগুলোর অবস্থা মোটাতাজা দেখা গেলেও বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। কৌশলগত আয় দেখানোয় পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর শেয়ার বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের তালিকায় থাকছে। ফলে শেয়ারের কারসাজি করে সুবিধা নিচ্ছে একটি পক্ষ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রভিশনে ছাড় দেয়ার পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কমাতে অবলোপনে (রাইট অফ) ছাড় দেয়ায় ব্যাংকের মুনাফায় এই উন্নতি হয়েছে। এ ছাড়া অনাদায়ী সুদ আয় খাতে যোগ করার ফলে হিসাবে বড় গরমিল তৈরি হচ্ছে। এতে সাময়িক সুবিধা মিললেও দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিতে পড়ছে ব্যাংক।
জানা গেছে, কয়েকটি ব্যাংক প্রভিশন সংরক্ষণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাড় নিয়েছে। এ ছাড়া আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে যোগ দেয়ার পরপরই ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দিয়েছে। এসব ছাড় দেয়ার কারণে কোনো কোনো ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করার পরও নিয়মিত করে রেখেছে। আবার আদায় ছাড়া পুনঃতফসিল করা ঋণের সুদ দেখিয়েছে আয় খাতে। সুযোগ পেয়ে অনেকে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করেনি। এতে প্রকৃত অবস্থা ভিন্ন হলেও মুনাফা বেড়ে গেছে কিছু কিছু ব্যাংকের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২১ সাল শেষে দেশের ১৪টি ব্যাংক প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণ করতে পারেনি। বরং মূলধন ঘাটতি ঢাকতে নিয়েছে ডেফারেল নামক বিশেষ সুবিধা। সুযোগ নেয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম বেসরকারি খাতের আইএফআইসি ব্যাংক লিমিটেড। ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণের বিধান কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছে ব্যাংকটি। এতে মূলধন ঘাটতি থেকে সাময়িক মুক্তি পেলেও ব্যাংকটি দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, প্রভিশন সংরক্ষণে চার বছর সময় নিয়েছে ব্যাংকটি। ধাপে ধাপে এই বকেয়া প্রভিশন সংরক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, ঋণের মানভেদে শূন্য দশমিক ২৫ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন সংরক্ষণের বিধান রয়েছে। কোনো কারণে এটি রাখতে ব্যর্থ হলে মূলধন থেকে এ ঘাটতি সমন্বয় করার কথা।
এতে ব্যাংকের মূলধন কমে যাওয়ার পাশাপশি পুঁজিবাজারে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয়ার সুযোগ নেই। এই দুই সমস্যা সমাধানে ডেফারেল নামক অস্ত্র ব্যবহার করছে আইএফআইসি ব্যাংক। এতে কাগজে-কলমে সাময়িক সমাধান হলেও দীর্ঘমেয়াদে হুমকির সম্মুখীন হবে বেসরকারি খাতের এ ব্যাংকটি।
আইএফআইসি ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ৫১৩ কোটি টাকা। যেটি রাখার জন্য ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময় নিয়েছে ব্যাংকটি। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ শ্রেণিকরণের ক্ষমতা ব্যাংগুলোর হাতে দেয়ার পাশাপাশি বেশকিছু সুবিধা দিয়েছে। নতুন সুবিধা অনুযায়ী খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে আড়াই থেকে সাড়ে চার শতাংশ অর্থ জমা দিলেই চলবে। আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। এসব ঋণ পরিশোধ করা যাবে ৫ থেকে ৮ বছরে। আগে এ ধরনের ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ দুবছর সময় দেয়া হতো।
তবে গত ৪ আগস্ট এক নির্দেশনা জারি করে খেলাপি ঋণে ছাড় কমায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওইদিন জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, পুনঃতফসিলের পর আরোপিত সুদ প্রকৃত আদায় ছাড়া ব্যাংকের আয় খাতে স্থানান্তর করা যাবে না। মন্দ মানে শ্রেণিকৃত ঋণ তৃতীয় ও চতুর্থবার পুনঃতফসিল করার ক্ষেত্রে প্রকৃত আদায় ছাড়া সংরক্ষিত প্রভিশন ব্যাংকের আয় খাতে নেয়া যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশনা আসার আগেই চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ের আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে ব্যাংকগুলো।
এ সুবিধা কাজে লাগানোর পরও জুন প্রান্তিকে গত বছরের তুলনায় সবচেয়ে বেশি মুনাফা কমেছে আইএফআইসি ব্যাংকের। প্রথম ছয় মাসে আগের বছরের তুলনায় এ ব্যাংকটির মুনাফা ৪০ শতাংশ কমে গেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৫২ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৮৭ পয়সা। চলতি বছরের জুন শেষে শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে ১৭ টাকা ৫৮ পয়সায়, যা গত বছরের জুন শেষে ছিল ১৬ টাকা ৩৯ পয়সা।
নতুন নিয়ম অনুযায়ী সুবিধা উঠে যাওয়ায় ব্যাংকটির লাভ আরও কমে গিয়ে লোকসানের দিকে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া ডেফারেল সুবিধা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষন কঠিন হয়ে পড়বে বেসরকারি খাতের এ ব্যাংকটির।
বিভিন্ন ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণে বিশেষ সুবিধা নেয়া প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘যেহেতু ঘাটতিতে থাকলে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয়া যায় না, তাই বিনিয়োগকারীদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক ডেফারেল সুবিধা দিয়ে থাকে। খেলাপি ঋণের কারণে বাস্তবে এসব ব্যাংক লোকসানে থাকে। নিয়ম মেনে প্রভিশন রাখলে এরা কোনো লভ্যাংশই দিতে পারবে না। এতে বঞ্চিত হবে সাধারণ বিনিয়োগকারী। এ সমস্যা সমাধানের জন্য খেলাপি ঋণ বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় একটা সময় সুবিধা বন্ধ করে দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।’
ডেফারেল সুবিধার সুযোগ নিয়ে লাভ দেখানোয় বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হচ্ছেন কি-না জানতে আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মাদ শাহ আলম সরোয়ারকে মুঠোফোনে কল দিলে তিনি পরে জানাবেন বলে ফোন কেটে দেন। এরপর হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তিনি উত্তর দেননি। পরে আরও কয়েকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।