অক্টোবর ২৭, ২০২২, ০১:৩০ এএম
মূল্যস্ফীতির চাপ, ডলার সংকটের প্রভাবে রিজার্ভে টান এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে চলমান অস্থিরতা সামাল দিতে প্রয়োজন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৈদেশিক ঋণ। এক্ষেত্রে বিদেশি দাতা গোষ্ঠীদের সাথে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে সরাকার। এরই অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ৪৫০ কোটি বা সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটি ঋণ ছাড়ের জন্য কঠিন শর্ত জুড়ে দিয়েছে। ভর্তুকি কমানো ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর যেসব শর্ত দেয়া হয়েছে তা মানতে গেলে দেশের আর্থিক পরিস্থিতি আরও অস্থির হয়ে উঠবে। দ্রব্যমূল্যের দামে তাৎক্ষণিক প্রভাবসহ জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে কয়েকগুণ।
এছাড়া কৃষিসহ উৎপাদন খাতে ভর্তুকি কমালে প্রভাব পড়তে পারে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে। এতসব সমস্যার পরও আইএমএফের ঋণ পেতে আগ্রহী সরকার। সব শর্ত মানার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই দেশে অবস্থানরত আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সাথে বৈঠকে বসছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। কিন্তু এত শর্তের পরও আইএমএফের ঋণ কেন গুরুত্বপূর্ণ?
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন, যদিও ঋণ মান বিবেচনায় আইএমএফের ঋণ খুবই খারাপ প্রকৃতির ঋণ তবুও সরকারের কাছে এটি খুবই প্রয়োজনীয়। কারণ সংস্থাটি যে প্রক্রিয়ায় ঋণ দেয় তা অত্যন্ত স্বচ্ছ ও টেকসই। কোনো দেশকে আইএমএফ ঋণ ছাড় করার অর্থ হচ্ছে ওই দেশের আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ঠিক আছে এবং দেশটি টেকসই অর্থনৈতিক কাঠামো দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। তাই অন্য দাতাগোষ্ঠী সহজেই ওই দেশের জন্য ঋণ ছাড় করবে। এসব বিবেচনায় দেশের আর্থিক ধাক্কা সামাল দিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বচ্ছ ইমেজ তৈরি ও বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সমালোচনার জবাব দেয়ার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে কাজ করবে এ ঋণ।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর আমার সংবাদকে বলেন, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার সংকট কাটিয়ে উঠতে আইএমএফের ঋণ দরকার। সরকার সেদিকেই নজর দিয়েছে। আইএমএফও ঋণ দিতে চাচ্ছে। সংস্থাটির সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে শর্ত মেনে হলেও ঋণটা নিতে হবে। কারণ আইএমএফের ঋণ একটি আস্থার সৃষ্টি করবে। ঋণের গুরুত্বের বিষয়ে আইএমএফের সাবেক আরেকজন কর্মকর্তা ড. রেজা কিবরিয়ার সাথে কথা হয় আমার সংবাদের।
তিনিও একই মত দিয়ে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ঋণ নেয়া ছাড়া সরকারের বিকল্প উপায় নেই। বাজেট ঘাটতি ও রিজার্ভ সংকট কাটাতে সরকারকে মোটা অঙ্কের বৈদেশিক ঋণ নিতে হবে। আইএমএফ যদি ঋণ দেয়, তাহলে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকাসহ সব দাতাগোষ্ঠী এগিয়ে আসবে। ফলে সরকার অনায়াসে আরও ৬-১০ বিলিয়ন ঋণ নিতে পারবে।
জানা গেছে, এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যেকোনো মূল্যে আইএমএফকে রাজি করাতে কাজ করছে সরকার। সব ধরনের শর্ত মেনে নেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে আইএমএফের প্রতিনিধিদলের সাথে বৈঠকে বসছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা। ইতোমধ্যে গতকাল বাংলাদেশে এসেছেন আইএমএফ প্রতিনিধি দল। ২৬ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের আর্থিক সংস্কার এবং নীতি নিয়ে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন তারা। দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন আইএমএফের মিশন প্রধান রাহুল আনন্দ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রের তথ্যমতে, আজ ও আগামী রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে মোট ১৩টি বৈঠক শেষে আগামী ৯ নভেম্বর গভর্নরের সাথে বৈঠকে বসবে আইএমএফ প্রতিনিধিরা। এর মধ্যেই অর্থ মন্ত্রণালয় ও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক শেষে চূড়ান্ত হবে ‘প্রোগ্রাম ডিজাইন’। আইএমএফের শর্ত মেনে নিলে ও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ শুরু করলেই সাইন হবে লেটার অব ইনটেন্ট।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য মতে, বাংলাদেশ সরকারের ৪৫০ কোটি ডলার আবেদনের প্রেক্ষিতে একটি ‘প্রোগ্রাম ডিজাইন’ প্রস্তুত করে নিয়ে এসেছে আইএমএফ প্রতিনিধি দল। এখন সে ডিজাইনের আওতায় সরকারের আর্থিক নীতি ও সংস্কার প্রস্তাব এবং তা বাস্তবায়নের সক্ষমতা যাচাই করে দেখা হবে। একই সঙ্গে আর্থিক সূচকগুলো পরীক্ষা করে দেখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে দুদিনব্যাপী সিরিজ বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। সব ঠিক থাকলে আগামী ৯ নভেম্বর গভর্নরের সাথে বৈঠকে চূড়ান্ত করা হবে আইএমএফ সহায়তা প্রোগ্রাম। এরপরই অর্থ মন্ত্রণালয় ও গভর্নরের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে স্বাক্ষর হবে লেটার অব ইনটেন্ট। ফিরে গিয়ে আইএমএফ বোর্ডের কাছে চূড়ান্ত প্রোগ্রাম ডিজাইন জমা দেবে প্রতিনিধিদল। বোর্ডে পাস হলেই মিলবে কাঙ্ক্ষিত ঋণ। সম্প্রতি আইএমএফের বার্ষিক সভা শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সংস্থাটি প্রদত্ত শর্তাবলি সম্পর্কে সাংবাদিকদের কিছু ধারণা দেন।
এগুলো হলো— রাজস্ব প্রশাসনের আধুনিকায়ন, রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা, জিডিপি অনুপাতে কর আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করা, ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং খারাপ ঋণ কমানো। ইতোমধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে এখনই বাস্তবায়ন জরুরি নয় এমন সব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ স্থগিত রাখাসহ নিতান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অতি প্রয়োজনীয় ছাড়া আমদানির ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
প্রসঙ্গ, গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। এখন এই রিজার্ভ ৩৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে গেছে। রিজার্ভ ধরে রাখতে নানা উদ্যোগ নেয়ার পর অর্থনীতির অন্যান্য সূচক নিম্নমুখী হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি অর্থনীতিতে ধীরে ধীরে সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, কমে গেছে রপ্তানি আয়। কমেছে রেমিট্যান্স প্রবাহও।