Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২৪,

৪৫ ধারায় আতঙ্ক

শরিফ রুবেল

অক্টোবর ৩১, ২০২২, ০১:২৬ এএম


৪৫ ধারায় আতঙ্ক

চাকরি আইনের ৪৫ ধারার প্রয়োগ বেড়েছে। এতে প্রশাসনে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। কে কখন ৪৫ ধারায় খড়গে পড়েন তা নিয়ে কর্মকর্তাদের কানাঘুষা চলছে। এ নিয়ে আমলাদের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ফলে কেউ কেউ ইতোমধ্যে নিজের কর্মকাণ্ডের হিসাব নিজেই মেলাতে শুরু করেছেন। আবার যাদের চাকরির মেয়াদ ২২ বছরের উপরে এমন সবাই রয়েছেন বাধ্যতামূলক অবসর ঝুঁকিতে। সবার মধ্যে প্রশ্ন এরপর কে? গেল কয়েক দিনে চারজন চাকরি হারিয়েছেন। বয়স থাকা সত্ত্বেও তাদের জনস্বার্থে অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। এই ‘বাধ্যতামূলক’ অবসর নিয়ে এখন পুলিশ ও প্রশাসনে ব্যাপক আলোচনা চলছে। এই অবসরের মাধ্যমে নির্বাচনের আগে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কী সরকার বিশেষ কোনো বার্তা দিতে চাচ্ছে? এমন আলোচনা হচ্ছে সর্বমহলে। অতীতে সেনা সমর্থিত সরকার ছাড়া জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ, বিএনপি সবাই আইনের এই ধারা ব্যবহার করেছে।

তবে আইনজ্ঞরা বলছেন, সবার আগে সংবিধান। চাকরি আইনের ৪৫ ধারা সংবিধানের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এটি অবিলম্বে বাতিল হওয়া উচিত। আইনের ৪৫ ধারায় বলা আছে— ‘কোনো সরকারি কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ ২৫ বৎসর পূর্ণ হইবার পর যেকোনো সময় সরকার, জনস্বার্থে, প্রয়োজনীয় মনে করিলে কোনোরূপ কারণ না দর্শাইয়া তাহাকে চাকরি হইতে অবসর প্রদান করিতে পারিবে।’ এই আইনের অপব্যবহার হচ্ছে। সংবিধানে কাউকে শাস্তি দেয়ার আগে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ দেয়ার অধিকার দেয়া আছে। সেটি মানা হচ্ছে না। অতীতে এভাবে সরকার যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে তারা অনেকেই উচ্চ আদালতে গেছেন, আদালতে সরকারের অর্ডার বা সিদ্ধান্ত টেকেনি। তা ছাড়া আদালতের রায় পেতে এত সময় লেগেছে যে, এর মধ্যে ওই কর্মকর্তা চাকরি শেষ করে অবসরে চলে গেছেন। ফলে আইনটি যৌক্তিকতা হারিয়েছে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া এই আইন অকার্যকর বা বাতিল করা সম্ভব হবে না।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সিদ্দিক উল্লাহ মিয়া বলেন, ‘চাকরি আইনের ৪৫ ধারা অনুযায়ী সরকার চাইলে যে কাউকে প্রয়োজন মনে করলে অবসরে পাঠাতে পারে। যেহেতু আইন বলবৎ আছে, তাই এই আনের যেকোনো ধারা ব্যবহার করতে কোনো বাধা নেই। এটি আইনগতভাবে বৈধ। তবে সব কিছুর ঊর্ধ্বে সংবিধান। কোনো ব্যক্তিকে বয়স হওয়ার আগেই অবসরে পাঠাতে হলে তার সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে কি-না সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, কোনোভাবেই যেন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন্ন না হয়। কারণ কারো ওপর জোর করে কোনো আদেশ চাপিয়ে দিলে তা নিয়ে সমালোচনা হয়। এতে সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে।

সরকারি চাকরি আইনের ৪৫ নম্বর ধারায় বলা আছে, কোনো সরকারি কর্মচারীর চাকরির  মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর যেকোনো সময় সরকার জনস্বার্থে প্রয়োজনীয় মনে করলে কোনো কারণ না দেখিয়ে তাকে চাকরি থেকে অবসর দিতে পারবে। তবে শর্ত থাকে, যে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিতে হবে।’

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান বলেন, ‘কারো বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ থাকে, সেটি দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। তবে তার একটি পদ্ধতি আছে। প্রথমে ওই ব্যক্তিকে শোকজ করে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। জবাব পাওয়ার পর তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে লঘু বা গুরু দণ্ডে দণ্ডিত করা যেতে পারে। চাকরি থেকেও অপসারণ করা যেতে পারে। কিন্তু তথ্য সচিবের বেলায় কিছুই করা হয়নি। অনেকে এই ঘটনা ভিন্নভাবে দেখছেন। মনে করছেন, এটি আমলাদের প্রতি সরকারের একটা কঠোর বার্তা। আমলাদের সব কিছু যে সরকার মনিটর করছে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে সেটি দেখানো হলো।’

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘চাকরি আইনের ৪৫ ধারাসহ আরো বেশ কয়েকটি ধারা বাতিল চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট হয়েছিল। এ ধারায় সাংবিধানিক অধিকারের ব্যত্যয় ঘটে। এখন সরকার চাইলে সরকারি চাকরি আইনটি সংশোধন করে বাধ্যতামূলক অবসরের বিতর্কিত ধারাটি বাদ দিতে পারে। এটি সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে।’ মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সাবেক তথ্য ও সমপ্রচার সচিব মো. মকবুল হোসেনকে চাকরি থেকে অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। এর একদিন যেতে না যেতেই পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার তিন কর্মকর্তাকে ‘জনস্বার্থে’ অবসরে পাঠানো হয়।

এ বিষয়ে সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান বলছেন, ‘কাউকে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়ে কখনোই সরকার ব্যাখ্যা দেয় না। যা নিতান্তই অনুচিত। সরকার যাকে পছন্দ করছে না তাকে ২৫ বছর হলেই সরিয়ে দেবে আর কাউকে মেয়াদ শেষের পরেও তিন-চারবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেবে, এটি কেমন কথা। পুরো বিষয়টি আসলে সবসময়ই সরকারের খেয়ালখুশি মতো। এতে কোনো স্বচ্ছতা নেই। চাকরি জীবনের শেষ প্রান্তে থাকা কাউকে বাধ্যতামূলক অবসর দিলে তাকে কারণ জানানো উচিত। না হলে তিনি আদালতে যেতে পারেন প্রতিকারের জন্য। কয়েকজন আদালতে গেছেন এবং তাদের পক্ষে সিদ্ধান্তও পেয়েছেন। এটি সরকারের জন্য বিব্রতকর। তাই কারণ জানালে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার জন্যও ভালো আবার সরকারের জন্যও স্বস্তিকর হতে পারে।’

সরকারের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বাধ্যতামূলক অবসরের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে শুধু জনস্বার্থে চাকরি থেকে অবসর দেয়ার কথা বলা হলেও তার কোনো কর্মকাণ্ড জনস্বার্থবিরোধী হয়েছে, সে সম্পর্কে কিছু বলা হয় না। বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া অনেক কর্মকর্তাই কখনো জানতে পারেননি তাকে কেন বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার।

সরকারি চাকরি থেকে গত রোববার ‘বাধ্যতামূলক’ অবসরে পাঠানো তথ্য ও সমপ্রচার সচিব মো. মকবুল হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি জানি না আমাকে কেন অবসরে পাঠানো হলো। মানুষকে ফাঁসি দিলেও তো একটা ট্রায়াল হয়। কিন্তু আমি জানি না কোন কারণে সরকারের এ সিদ্ধান্ত।’

সাবেক সচিব বদিউর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কেউ তার ব্যক্তিগত সুবিধা-অসুবিধার জন্য হয়তো চাকরি ছেড়ে দিতে পারেন, তাতে কোনো অসুবিধা নেই। তবে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করার বিষয়টি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের লক্ষণ নয়। রাষ্ট্রের সেটি করা উচিত নয়।’

তার মতে, ‘যদি কেউ অন্যায়-দুর্নীতি করে, আচরণবিধি লঙ্ঘন করে তবে তাকে বিদ্যমান আইনে শাস্তি দেয়া যায়। তারপরও ১৯৭৪ সালের বিধান সরকারি চাকরি আইনে রাখা আছে। কারণ অনেক সময় বিভাগীয় মামলা করলে অভিযোগ প্রমাণ করা কষ্টকর হয়ে যায়। সময়ক্ষেপণ হয়। এর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করলে সরকার হেরে যায়। এ জন্য সরকার এটিকে ইস্কাপনের টেক্কা হিসেবে হাতে রাখে। তবে আইনি ভিত্তিতে এটিকে বেআইনি বলা যাবে না। কিন্তু সংবিধানের ভিত্তিতে এটি কল্যাণমূলক আইন নয়। আমি এটিকে কালা-কানুন বলি।’

Link copied!