নভেম্বর ৩, ২০২২, ০১:৩৬ এএম
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ পেতে আর্থিক সংস্কারের রোডম্যাপ জানাতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সাথে গত কয়েকদিনের সিরিজ বৈঠক শেষে গতকাল গর্ভনর আবদুর রউফ তালুকদারের কাছে আর্থিক চিত্র সম্পর্কে সংস্থাটির মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়। এর সাথে দেয়া হয় সংস্কারের পরামর্শ। গভর্নর বিষয়গুলো আমলে নিয়ে শিগগিরই সংস্কার কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনার কথা জানান আইএমএফ মিশনকে।
এর প্রেক্ষিতে সংস্কার পদ্ধতি ও সময়সীমাসহ রোডম্যাপ তৈরির কথা জানিয়েছে সংস্থাটি। গভর্নরের দপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ আমার সংবাদকে বলেন, রুটিন অনুযায়ী গভর্নরের সাথে বৈঠক করেছে আইএমএফ মিশন।
তারা গভর্নরকে সফরের ‘মিড আপডেট’ অবহিত করেছে। এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান ও পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে। বালাদেশের আবেদনকৃত সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ ছাড় করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আর্থিক সক্ষমতা যাচাই করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগের সাথে বৈঠক করেছে প্রতিনিধিদল। এসব বৈঠকে দেশের আর্থিক সূচকগুলো সম্পর্কে নানা প্রশ্ন জানতে চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে দেয়া হয়েছে সংস্কারের পরামর্শ। প্রাপ্ত তথ্য পরীক্ষা করে এর ওপর নিজেদের মূল্যায়ন তৈরি করে তা গভর্নরের কাছে পেশ করা হয়েছে।
জানা গেছে, কয়েকদিনের বৈঠকে সংস্থাটি ঋণখেলাপি বন্ধে পদক্ষেপ, ডলার বাজার, মূল্যস্ফীতি, জ্বালানির দাম বৃদ্ধির প্রভাব, আর্থিক খাতের বিভিন্ন সূচক ও আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) ভূমিকাসহ টেকসই অর্থনীতির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছে।
এসময় খেলাপি ঋণ বন্ধের পদক্ষেপ সম্পর্কে জোড়ালোভাবে জানতে চাওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অব্যাহত খেলাপি ঋণ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। এছাড়া সরকারি ব্যাংকগুলোর পর্ষদে আমলাদের নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা ও তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে। পর্ষদের ওপর রাজনৈতিক চাপ ও প্রভাবশালী মহলের প্রভাবসহ খাত সংশ্লিষ্ট যাবতীয় সমস্যা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছে মিশন সদস্যরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর তথ্যমতে, প্রত্যাশিত মুদ্রাস্ফীতির উন্নয়ন, দ্বিতীয় দফায় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব, মূল্যস্ফীতির প্রত্যাশা সমীক্ষার ফলাফল, বিনিময় হারের চাপ এবং প্রত্যাশিত উন্নয়ন সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন মিশন সদস্যরা। এছাড়া সুদের হার করিডোর সিস্টেম বাস্তবায়নে বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ এবং সময়সীমা, প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসন এবং সুশাসনকে শক্তিশালী করার জন্য আইএমএফের সেফগার্ডস অ্যাসেসমেন্টের সুপারিশের পরিচালন বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছে।
ব্যাংকগুলোর আর্থিক সক্ষমতা এবং সেক্টরভিত্তিক আর্থিক সূচকগুলোর ওপর আপডেট তথ্য পরীক্ষা করে দেখেছে সংস্থাটি, বাণিজ্যিক ব্যাংক, সহযোগী প্রতিষ্ঠান, ইক্যুইটি বাজার, সামপ্রতিক কার্যক্রম এবং ঝুঁকিবিষয়ক আপডেট, ১০টি ব্যাংকের সাথে পাইলট প্রকল্পের অবস্থা, ব্যাঙ্কগুলোর ঝুঁকির উন্নতি ও ব্যবস্থাপনা এবং অন্যান্য সংস্কার পর্যালোচনা করে দেখেছে প্রতিনিধিদল।
এসব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংকও নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছে। জানা গেছে, ডলারের একরেট নির্ধারণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুত পদক্ষেপ নিতে চাইছে না। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আগামী ৩-৬ মাসের মধ্যে একটি কাছাকাছি দর নির্ধারণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এখনই একরেট নির্ধারণ না করে সময় নিয়ে একরেট নির্ধারণ করতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। অন্যদিকে এখনই বিনিয়োগে সুদহার তুলে না নিয়ে ধাপে ধাপে কার্যকর করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ব্যাপক ঘাটতির বিষয়ে উদ্যোগ জানতে চেয়েছে তারা। ঋণ পুনঃতফসিলের তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে বলে দাবি করেছে সংস্থাটি। তারা জানিয়েছে কোন কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে সুবিধা দেয়া হয়েছে তা প্রকাশ করা হয় না। স্বচ্ছতা ও সুশাসনের জন্য এই তথ্য প্রকাশ করা জরুরি।
এছাড়া আইএমএফের পক্ষ থেকে খেলাপি ঋণের হিসাব পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়। বলা হয়, সরকার যে খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যান দিচ্ছে, প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও বেশি। এই খেলাপি ঋণের সাথে আদালতে চলা খেলাপি ঋণ নিয়ে মামলা ও পুনঃতফসিলকৃত ঋণের তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। ব্যাংকি খাতের সংস্কার নিয়েও প্রশ্ন করে আইএমএফ। একই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতের আহ্বান জানায় মিশন প্রধান। ব্যাংকের বোর্ড গঠনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় এবং সরকারি ব্যাংকে আমলাদের নিয়োগে উদ্বেগ ও তাদের পারফরমেন্স জানতে চাওয়া হয়।
এছাড়া বছরে চারবার মুদ্রানীতি প্রকাশের কথা বলেছে সংস্থাটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আপাতত দুইবার মুদ্রানীতি ঘোষণার কথা জানানো হয়েছে। বিবিএসের রিপোর্টের আলোকে পর্যায়ক্রমে চারবারে উন্নীত করার পরিকল্পনা আছে বলেও জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
উল্লেখ্য, আইএমএফের প্রতিনিধিদলটি আগামী ৯ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ অবস্থান করবে। তাদের রিপোর্টের ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশ সংস্থাটি থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা পাবে কি-না। সফররত আইএমএফ মিশনের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ব্যাংক, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি), বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়কারী ব্যাংকগুলোর নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) সঙ্গে বৈঠক করেছে।
এছাড়াও প্রতিনিধিদলের একটি অংশ অর্থমন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাথে (বিবিএস) বৈঠক করে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাথেও বৈঠকের কথা রয়েছে। এসব বৈঠকে ভ্যাট কাঠামো পরিবর্তন, সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমানো, জ্বালানি তেলের পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারে ভর্তুকি কমাতে বলেছে আইএমএফ মিশন।