Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

জরুরি পণ্যে ফুরাচ্ছে রিজার্ভ

রেদওয়ানুল হক

নভেম্বর ৮, ২০২২, ১২:৫৮ এএম


জরুরি পণ্যে ফুরাচ্ছে রিজার্ভ

ক্রমশ কমছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ইতোমধ্যে আমদানিতে লাগাম টানা হয়েছে। তবুও শুধু জরুরি পণ্য কিনতেই নিয়মিত রিজার্ভ থেকে ডলার খরচ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে রপ্তানি কমে যাওয়া ও কাঙ্ক্ষিত প্রবাসী আয় না আসায় প্রতিমাসেই তৈরি হচ্ছে ঘাটতি। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ৭৫৫ কোটি ডলার বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে। একইসাথে কমছে রেমিট্যান্স।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গতকাল রিজার্ভ ছিল ৩৫ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। এর থেকে বাদ যাবে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের আমদানি বিল ১৩০ কোটি ডলার। ইতোমধ্যে যা পরিশোধ করা হয়েছে; সেটেলমেন্ট সম্পন্ন হওয়ার পর আজ এটি কেটে নেয়া হবে। সে হিসাবে রিজার্ভ দাঁড়াবে ৩৪ দশমিক ৪৭ বিলিয়নে। এ ছাড়া আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী আরও ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার বাদ যাবে। ফলে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ২৬ দশমিক শূন্য সাত বিলিয়নে।  

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিট ও মোট হিসাব করে। নিট হিসাবে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলসহ (ইডিএফ) বিভিন্ন তহবিলে জোগান দেয়া অর্থ বাদ দেয়া হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের গ্রস বা মোট হিসাবই প্রকাশ করে আসছে। সেই হিসাবে ইডিএফের সরবরাহ করা সাত বিলিয়ন ও শ্রীলঙ্কাকে দেয়া ২০ কোটি ডলার রিজার্ভে দেখাচ্ছে।

এছাড়া গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ডের (জিটিএফ) ২০ কোটি, লং টার্ম ফিন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি (এলটিএফএফ) তহবিলের তিন কোটি ৮৫ লাখ, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমানকে দেয়া চার কোটি ৮০ লাখ এবং ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের (আইটিএফসি) আমানত রিজার্ভে দেখানো হচ্ছে।

সব মিলিয়ে বর্তমানে রিজার্ভে যে অর্থ দেখানো হচ্ছে, সেখান থেকে ৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার বাদ যাবে বলে মনে করে আইএমএফ। সংস্থাটির হিসাব ধরলে রিজার্ভের পরিমাণ গত সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে যাবে। এর আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ২৫ বিলিয়ন ডলার। দু-একদিনের মধ্যেই রিজার্ভ ২৫ বিলিয়নের ঘরে নামবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র।

গত বছর ৪৮ বিলিয়নে থাকা রিজার্ভ দ্রুতগতিতে কমতে শুরু করে। কারণ রেকর্ড পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতির প্রেক্ষাপটে রিজার্ভ থেকে নিয়মিত ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। একপর্যায়ে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থপাচারের প্রমাণ পায় বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এমন প্রেক্ষাপটে বড় এলসিতে নজরদারি এবং জরুরি পণ্য ব্যতীত আমদানিতে লাগাম টানা হয়। এখন শুধু জরুরি পণ্যেই ডলার সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও রিজার্ভের নিম্নমুখী ধারা থামানো যাচ্ছে না।

জানা গেছে, জরুরি পণ্য ও সেবা কিনতে নিয়মিত রিজার্ভ থেকে ডলার সহায়তা দেয়া হচ্ছে। এর বেশিরভাগ খরচ হচ্ছে খাদ্য ও জ্বালানি খাতে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল চিনিসহ কয়েকটি পণ্য বাবদ ১৩১ মিলিয়ন ডলার দেয়া হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের এ পর্যন্ত ৫২৭ কোটি ৩৩ লাখ ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বিক্রি করা হয় ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার। তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেখানে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কিনেছিল প্রায় ৭৯৩ কোটি ডলার। ডলার কেনার চেয়ে এখন বিক্রির চাপ বেশি হওয়ায় রিজার্ভ কমছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক মাসে রিজার্ভ কমে বর্তমান পর্যায়ে নেমেছে।

এর আগে ধারাবাহিকভাবে যা বাড়ছিল। ১০ বছর আগে ২০১৩ সালের জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। পাঁচ বছর আগে ছিল ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে বেড়ে ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে পৌঁছায়। ওই বছরের ৮ অক্টোবর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নতুন মাইলফলক অতিক্রম করে। এরপর তা বেড়ে গত বছরের আগস্টে প্রথমবারের মতো ৪৮ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার হয়। এরপর থেকে গত কয়েক মাস ধরে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে আমদানি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিলাসী পণ্যে শতভাগ এলসি মার্জিন নির্ধারণের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে এলসি খোলার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নিতে হচ্ছে। সব ঠিক থাকার পরও কিছু ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে দিচ্ছে, এই এলসি খোলা যাবে না। বিশেষ করে গাড়ি, টিভি, ফ্রিজ, ফুল, ফলের মতো পণ্য আমদানিতে অনেক ক্ষেত্রে অনাপত্তি দিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার অনেক ব্যাংক ডলার সংকটের কারণে শতভাগ এলসি মার্জিন নিয়েও আমদানি এলসি খুলছে না। তবে আগের খোলা এলসির দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে এলসি খোলায় ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ কমলেও আমদানির দায় পরিশোধ বেড়েছে ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ। এই কারণে দিন দিন ডলারের সংকট বাড়ছে। বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে ডলার বিক্রির চাপে কমছে অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই সূচক।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রিজার্ভ কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এখন আমাদের ভাবতে হবে কীভাবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যায়। প্রথমে রেমিট্যান্স বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। ডলারের রেট একেক সময় একেকটা না দিয়ে বাজারের ওপর রেট ছেড়ে দেয়া উচিত। অর্থাৎ প্রয়োজনমতো রেট দিয়ে ব্যাংকগুলো ডলার কিনবে। তারা বলছেন, আমদানি বন্ধ করে রিজার্ভ বাড়ানো যাবে না।

যেসব পণ্য দরকার, তা আমদানি করতে হবে। তা না হলে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় বাড়াতেও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এখন থেকে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে কোনো ধরনের চার্জ নেবে না ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি রেমিট্যান্স পাঠানোর সুবিধার্থে সপ্তাহের ছুটির দিনেও বিদেশে থাকা এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো খোলা থাকবে।

গত ৬ নভেম্বর ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) যৌথসভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

এর আগে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজের মতো সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠালেও প্রতি ডলারে প্রবাসীরা ১০৭ টাকা পাবেন বলে জানায় বাফেদা। আগে যা ছিল ৯৯ টাকা ৫০ পয়সা। এ ছাড়া এখন বিদেশ থেকে যেকোনো পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠাতে কোনো ধরনের কাগজপত্র লাগছে না। আবার প্রবাসী আয়ের ওপর আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার।

Link copied!