নভেম্বর ৮, ২০২২, ০১:০৯ এএম
কমতে শুরু করেছে গরমের তেজ। শীতের ছোঁয়ায় কমছে বিদ্যুতের চাহিদা। দুর্ভোগের লোডশেডিং পরিস্থিতি অনেকটা উন্নতি হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, ধীরে ধীরে লোডশেডিং আরও কমে আসবে। শীতে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিছুদিন আগেও রাজধানী ঢাকায় পাঁচ ঘণ্টার ওপর এবং সারা দেশে আট ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং করা হচ্ছিল। সারা দেশে গড়ে তখন ঘাটতি ছিল দেড় হাজার মেগাওয়াটের বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই শীতে লোডশেডিং কমলেও সামনের গ্রীষ্মে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিবে। কারণ তখন জ্বালানি সংকট আরও তীব্র হবে। শীতে বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা কমে, তখন লোডশেডিং পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হবে। কিন্তু এটা সমাধান নয়। সরকারকে উৎপাদনেই মনযোগী হতে হবে।
পিডিবির দেয়া তথ্য মতে, গত ২১ অক্টোবর থেকে ঘাটতি গড়ে ৫০০ মেগাওয়াটে নেমে এসেছে। জ্বালানি সাশ্রয়ে সরকার কৃচ্ছ্রতা সাধনে নানা উদ্যোগ নিয়েছিল। সে হিসাবে গত জুলাই মাসের ১৮ তারিখ থেকে সারা দেশে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের ঘোষণা দেয় সরকার। সে সময় এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং চালুর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি-বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী বলেছেন, বিদ্যুতের যে ঘাটতি আমরা সবাই সেটা ভাগ করে নেব। তাতে দিনে এক থেকে দেড় ঘণ্টা, কোথাও দুই ঘণ্টাও লোডশেডিং হতে পারে। কিন্তু দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এবং পৃথিবীর এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
আপনারা আগেও শুনেছেন দোকানপাট বন্ধ থাকবে ৮টার পর। সেখানে এসি ২৪ ডিগ্রির ওপর রাখতে হবে। মসজিদে মুসল্লি যারা আপাতত তারা এসি ব্যবহার থেকে বিরত থাকবেন। যারা নির্দেশনা মানবে না তাদের বিরুদ্ধে আমরা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীও একইভাবে পরীক্ষামূলক এক সপ্তাহের এক ঘণ্টা লোডশেডিং ঘোষণা করেন। এদিকে জ্বালানি সংকট বেড়েই চলছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ানো হচ্ছিলো লোডশেডিংও। গত ১৫ দিন আগেও রাজধানীতে পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টা এবং ঢাকার বাইরে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা লোডশেডিং দেখা গেছে। সরকার বারবার আশ্বাস দিলেও সংকট কিছুটা কাটছে শীতে।
এর আগে আগস্টে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে। আগস্টেও সমাধান না হওয়ায় প্রথমে সেপ্টেম্বর, তারপর অক্টোবর ও নভেম্বরের কথা বলে আসছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। বারবারই ব্যর্থতার পরিচয় দেয় বিদ্যুৎ বিভাগ।
এর আগে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম ঊর্ধ্বমুখী। সরকার এ খাতে বহু বছর ভর্তুকি দিয়েছে। সাশ্রয়ের জন্য এখন আমরা কিছুটা লোডশেডিং দিচ্ছি। তবে আমরা আশাবাদী, শীত এলে চাহিদা কমে গেলে লোডশেডিং ঠিক হয়ে যাবে।
এদিকে উৎপাদন কমে যাওয়ায় জুলাইয়ের চেয়ে অক্টোবরে লোডশেডিং পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা। জুলাই-আগস্টে গড়ে দৈনিক দুই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছিল। এখন এর পরিমাণ তিন হাজার মেগাওয়াট পেরিয়ে গেছে। এর মূল কারণ গ্যাসের সরবরাহ কমেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২২৫ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে গড়ে ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস দিচ্ছে পেট্রোবাংলা।
এদিকে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) বলছে, এসি ব্যবহারের সময় তাপমাত্রা চার-পাঁচ ডিগ্রি বাড়িয়ে ২০-৩০ ভাগ বিদ্যুৎ চাহিদা কমানো সম্ভব ছিল। কিন্তু তা আমাদের দেশে কার্যকর হয়ে উঠেনি। অনুরূপভাবে সঠিক পরিকল্পনা ও নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে এসির ব্যবহার সীমিত করার মাধ্যমে সারা দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা বহুলাংশে কমানো সম্ভব। অন্যথায় শুধুমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনে নির্ভরতা বাড়িয়ে দেশের বিদ্যমান বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে। আসন্ন শীতে ৫০ শতাংশ বিদ্যুতের চাহিদা কমতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমাদের বিকল্প জ্বালানির বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসতে শুরু করেছে। কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে আগামী গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। তবে দুঃসংবাদ হলো কয়লার দামও বেড়ে গেছে। আমরা চেষ্টা করছি এর চাইতে যেন খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়।
বিপিডিবির ওয়েব সাইটে দেয়া তথ্যানুযায়ী, গত ১৯ অক্টোবর ঘাটতি ছিল ১৪৭৫ মেগাওয়াট, ২০ অক্টোবর ঘাটতি ছিল ১০৩৯ মেগাওয়াট, ২১ অক্টোবর ঘাটতি ছিল ১৮৪ মেগাওয়াট, ২২ অক্টোবর ঘাটতি ছিল ৫১৩ মেগাওয়াট আর গত বৃহস্পতিবার ঘাটতি ছিল ৪৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। জুলাইয়ে দিনে গ্যাস সরবরাহ ছিল ২৮০ থেকে ২৮৫ কোটি ঘনফুট। এরমধ্যে এলএনজি থেকে পাওয়া যেত ৫৫ কোটি ঘনফুট। কয়েকদিন ধরে এলএনজি থেকে পাওয়া যাচ্ছে ৩৮ কোটি ঘনফুট।
এলএনজির কার্গো আসার পরিমাণ কমায় সরবরাহ কমেছে বলে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কমেছে। এখানে দুটো ঘটনা ঘটছে। এক, ব্যয় সাশ্রয়ে সরকার তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কম চালাচ্ছে। দুই, ফার্নেস অয়েল সংকটে বেসরকারি খাতে উৎপাদন কম হচ্ছে। ৮০০ থেকে ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাওয়া যাচ্ছে বেসরকারি কেন্দ্রগুলো থেকে।
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান বলেছেন, বিদ্যুতের বর্তমান পরিস্থিতি সাময়িক। খুব দ্রুত সমস্যা কেটে যাবে। শীত এলে বিদ্যুতের চাহিদা কমে আসবে। আগামী ডিসেম্বর থেকে এক এক করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হবে। একই সময়ে সঞ্চালন লাইনের কাজও শেষ হবে। সবমিলিয়ে আমরা আশা করছি, আগামী ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী সময়ে আমাদের লোডশেডিং থাকবে না।
তিনি আরও বলেন, দেশে যত শিল্পকারখানা বাড়বে, বিদ্যুতের চাহিদা তত বাড়বে। সেই বিষয়টি বিবেচনা করেই মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে সোলার হতে পারে বড় সমাধান। সোলার দিয়ে চাহিদার বড় একটি অংশ মোকাবিলা করার চেষ্টা চলছে। পিডিবি চেয়ারম্যান বলেন, বৈশ্বিক অস্থিরতা, ডলার ও জ্বালানি সংকট থেকে তো আমরা বিচ্ছিন্ন নই। যার কারণে জ্বালানি সাপ্লাই চেইনের ক্ষেত্রে কিছু বিঘ্ন হয় এবং হচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে সহসাই আমরা হয়ত এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করতে পারব বলে আশা করছি।
চলমান বিদ্যুৎ-জ্বালানি পরিস্থিতির বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বিদ্যুৎ খাত চরম সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অবস্থা খুবই শোচনীয়। এখন খুব বেশি কিছু করার নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বেশি। স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করা হয়েছে। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদনও কমছে।
এদিকে, দেশে রিজার্ভ সংকট রয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল তেল ও গ্যাসের সংগ্রহ না করতে পারলে আসন্ন গরমে লোডশেডিং পরিস্থিতির আবারো অবনতি হতে পারে।
তারা আরও জানান, শীতে বিদ্যুতে চাহিদা কিছুটা কমে, তখন লোডশেডিং পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হবে। কিন্তু এটা সমাধান নয়। জ্বালানির সংকট নিরসনের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দ্রুত উৎপাদনে আনার চেষ্টা করতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ ব্যবহারে কৃচ্ছ্রসাধন চালিয়ে যেতেই হবে।
বিশিষ্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক অধ্যাপক ড. ম. তামিম বলেন, শীত পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ খাতে উন্নতি পাওয়া যেতে পারে। তবে আগামী গ্রীষ্মে এ পরিস্থিতি কী হবে, ভাবা যাচ্ছে না। ভয়াবহ এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যত তাড়াতাড়ি উৎপাদনে আসবে পরিস্থিতির তত তাড়াতাড়ি উন্নতি হবে।