Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

নাগালের বাইরে ওষুধ

মাহমুদুল হাসান

নভেম্বর ১০, ২০২২, ১২:৩৮ এএম


নাগালের বাইরে ওষুধ

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে বেড়েছে সব ধরনের ওষুধের দাম। কাঁচামাল আমদানি ব্যয়বৃদ্ধি, ডলার বিনিময় মূল্য, পরিবহন ও সরবরাহ ব্যয় এবং জ্বালানি তেলের দামসহ বিভিন্ন অজুহাতে বেড়েছে ওষুধের দাম।

জ্বর-ব্যাথার প্যারাসিটামল থেকে শুরু করে গ্যাস, পেটের সমস্যা, হূদরোগ, অ্যান্টিবায়োটিক, রক্তাল্পতা, ত্বকের ওষুধ কিনতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। আর বিদেশি ওষুধের দাম একেবারেই নাগালের বাইরে। ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণে নেই নিয়মিত নজরদারি। আমদানিকৃত ওষুধের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বহুগুণ বেশি দামে বিক্রির অভিযোগ রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ১১৭টি ওষুধ সরকার মূল্য নির্ধারণ করে। বাকি প্রায় ১৫শ কোম্পানির ৩৭ থেকে ৪২ হাজার ব্যান্ডর ওষুধ রয়েছে। এসব ওষুধের দাম প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ও আমদানিকারক নির্ধারণ করে। এ ক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর নির্বিকার। অথচ বিশ্বের অন্যান্য দেশে সব ওষুধের দাম নির্ধারণ করে সরকার।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মও এমটিই নির্দেশ করে। দেশের ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতিতেও তা ছিল। কিন্তু, ১৯৯৪ সালে ওষুধ কোম্পানির দাবির মুখে বলা হলো, ১৭ শতাংশ ওষুধের দাম সরকার নির্ধারণ করবে। বাকিটা নির্ধারণ করবে উৎপাদক প্রতিষ্ঠান। এটিকে বলা হলো ইন্ডিকেটিভ প্রাইস।

ওষুধ শিল্প সংশ্লিষ্টরা সম্প্রতি ওষুধের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে বলছেন, ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহূত কাঁচামালের দাম বেড়েছে। প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল, পরিবহন ও সরবরাহ ব্যয়, জ্বালানি তেলের দাম, ডলারের বিনিময় মূল্য ও মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এলসি খুলতে বেশি খরচ হচ্ছে।

ওষুধের ক্রয়ে উচ্চমূল্য জোগাড়ে ব্যর্থ হয়ে অনেকে সাত দিনের ওষুধ চার দিন কিনছেন। কেউ কেউ আবার বেশি জরুরি ওষুধ কিনলেও প্রেসক্রিপশনের বাকিগুলো খাওয়া ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের নিয়মিত চিকিৎসা নেন মানিকগঞ্জের পঞ্চাশোর্ধ্ব সালেহা বেগম।

গতকাল ছোট ছেলে আরাফাতকে সাথে নিয়ে এসেছেন হাসপাতালটিতে গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ভুগছেন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ আর হার্টের সমস্যা নিয়ে। রোজ খেতে হয় হাফ ডজনের বেশি ওষুধ। ব্যবহার করতে হয় ইনসুলিন। আগে মাসে প্রায় তিন থেকে চার হাজার টাকার ওষুধে চলে যেত। কিন্তু এখন সব কিছুর দাম বেড়েছে। তাই বাধ্য হয়ে অনেক জরুরি ওষুধ বাদ দিতে হচ্ছে। বেসরকারি একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হাবিবুর রহমান ঢামেক হাসপাতালের সামনের শরীয়তপুর ফার্মায় বাবার জন্য ওষুধ কিনতে এসেছেন।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বেতন বাড়েনি কিন্তু সব কিছুর দাম বেড়েছে। ওষুধের দাম বৃদ্ধির পর থেকে মনে হচ্ছে আমাদের ওষুধ খেয়েও মরার অধিকার নেই। সালেহা-হাবিবদের কথার সত্যতা মিলে মিরপুরের ও ঢাকা মেডিকেল এলাকার ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দক্ষিণ গেট সংলগ্ন ওষুধ বিক্রেতা আমির হোসেন জানান, সরকার তো মাত্র অল্প কয়েকটা ওষুধের দাম পুনর্নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু সারা বছরই তো ওষুধ কোম্পানি নিজেরা দাম বাড়ায়। এই বাজারে ওষুধ কিনে খাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। আমাদের বেচাকেনা কমেছে। অনেকেই প্রেসক্রিপশনের অর্ধেক ওষুধ কিনেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগ নিরাময়ের পূর্বশর্ত চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ওষুধ সেবন করতে হবে। কিন্তু অর্থনৈতিক সঙ্কটে ওষুধ সেবন ছেড়ে দিলে দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক জটিলতার সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। আগামীতে জনস্বাস্থ্যে এর প্রভাব পড়তে পারে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম আমার সংবাদকে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও ওষুধের দাম বৃদ্ধির কারণে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ ঠিকমতো ওষুধ কিনে খাচ্ছে না। এটি আশঙ্কার একটি বিষয়। কারণ সঠিক পরিমাণে ও পর্যাপ্ত সময় ধরে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করলে ব্যাক্টেরিয়াগুলো পরোপুরি ধ্বংস না হয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তখন এই ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে ওই অ্যান্টিবায়োটিকের আর কোনো প্রভাব থাকে না। এ অবস্থায় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।’

সম্প্রতি ২০টি জেনেরিকের ৫৩টি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়িয়েছে সরকার। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্যারাসিটামলের ১০টি ও মেট্রোনিডাজলের ছয়টি জেনেরিকের দাম বেড়েছে। এর বাইরে দেশে উৎপাদিত ও আমদানিকৃত প্রায় ৪২ হাজার ব্রান্ডের ওষুধের দাম নির্ধারণ করে প্রস্তুতকারক ও আমদানিকারক। এর আগে সর্বশেষ ২০১৫ সালে কয়েকটি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছিল। প্রায় সাত বছর পর আবারো বাড়ানো হয়েছে অতি প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম।

এর মধ্যে বিভিন্ন মাত্রার প্যারাসিটামলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৫০ থেকে শতভাগ। মাত্র ৪০ টাকার এমোক্সিসিলিনের দাম করা হয়েছে ৭০ টাকা, ২৪ টাকার ইনজেকশন ৫৫ টাকা। ৯ টাকার নাকের ড্রপের দাম বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৮ টাকা। কোনো কোনো ওষুধের দাম ৯৯ থেকে ১৩৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সভাপতি শাহজালাল বাচ্চু আমার সংবাদকে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মানুষ ওষুধের দোকানে কম আসছে কি-না সেটি আন্দাজ করা যাচ্ছে না। তবে এ পরিস্থিতি সামনের দিকে অগ্রসর হলে ওষুধ কিনতে মানুষ হিমশিম খাবে। এর চেয়েও বড় সঙ্কট তৈরি হবে বৈদেশিক মূদ্রা বিনিময়ে সঙ্কটের (ডলার ক্রাইসিস) কারণে যদি ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে বিঘ্ন হয়।’

দেশের ওষুধ বাজারের চিত্র : সরেজমিন একাধিক ফার্মেসি ঘুরে দেখা যায়, নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) থাকা রোগীদের চিকিৎসায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত হয়েছে অ্যাকট্রেমা ইনজেকশন, যা পরিমাণের ভিত্তিতে ২১ থেকে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বিক্রি করা হয় ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকায়। দেশের বাজারে বিদেশি ওষুধ অ্যাকট্রেমা দেড় থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্তও বিক্রি হচ্ছে। এজাসিটি ইনজেকশন সাড়ে চার হাজার টাকা থেকে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৯ হাজার টাকায়।

ফরজিকা ৪০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা, টেমিফ্লু তিন হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা, সানিলক এসপিএফ এক হাজার ৭৫০ টাকা থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। হামদর্দদের শিশুদের গ্যাস্ট্রিকের নল-নেহাল সিরাপ দুই মাস আগেও ৬০ টাকা ছিল, এখন ৭৫ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।

বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের তৈরি শিশুদের জ্বরের নাপা সিরাপ (৬০ মিলি) ২০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ টাকা করা হয়েছে। একই সিরাপ ১৫ মিলির দাম ১৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৪ টাকা করা হয়েছে। বড়দের জ্বরের জন্য নাপা ৫০০ এমজি প্রতি পিস ট্যাবলেট ৮০ পয়সা থেকে বেড়ে এক টাকা ২০ পয়সা হয়েছে। প্রতি পিস নাপা এক্সটেন্ড দেড় টাকা থেকে দুই টাকা হয়েছে।

গ্যাস্ট্রিকের প্রতি পিস প্রোসিপটিন ৪০ এমজি ট্যাবলেট ৯ টাকা করা হয়েছে। বাত ব্যথার চিকিৎসায় ব্যবহূত রেডিয়েন্ট ফার্মার প্রতি পিস কার্টিকেয়ার ট্যাবলেটের দাম ১৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২১ টাকা করা হয়েছে। একই রোগের জন্য এই কোম্পানির প্রতি পিস কার্টিকেয়ার ম্যাক্স ট্যাবলেটের দাম ২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২২ টাকা করা হয়েছে। কার্টিকেয়ার টিএস ট্যাবলেটের দাম ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৫ টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যালসিয়ামের কোরাল ডি ট্যাবলেট ১১ থেকে ১২ টাকা হয়েছে।

স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের তৈরি উচ্চরক্তচাপের চিকিৎসায় ব্যবহূত এনজিলক ৫০ এমজি ট্যাবলেট ৮ থেকে বাড়িয়ে ১০ টাকা করা হয়েছে। উচ্চরক্তচাপের জন্য এই কোম্পানির আরও একটি ওষুধ ওসারটিল ৫০ এমজি ট্যাবলেটের দাম ৮ থেকে বেড়ে ১০ টাকা হয়েছে। ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যবহূত কমপ্রিট ৪০ এমজি ট্যাবলেট সাত থেকে আট টাকা হয়েছে। কাশির চিকিৎসায় ব্যবহূত তুসকা প্লাস (১০০ মিলি) সিরাপের দাম ৮০ থেকে ৮৫ টাকা হয়েছে। ঠাণ্ডা-কাশির জন্য ফেক্সো (৫০ মিলি) সিরাপ ৫০ থেকে ৫৫ টাকা হয়েছে। স্কয়ারের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ মক্সাসিলিন (১০০ মিলি) সিরাপ ৪৭ থেকে বেড়ে ৭০ টাকা হয়েছে।

এছাড়া শিশুদের নাকের এন্টাজল ০.০৫ শতাংশ ড্রপ ১১ থেকে ১৯ টাকা হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য তৈরি এন্টাজল ০.১ শতাংশ ড্রপ ১১ থেকে ২০ টাকা হয়েছে। পেট খারাপের চিকিৎসায় ব্যবহূত প্রোবায়ো ক্যাপসুলের দাম ১৪ টাকা থেকে বেড়ে ২৫ টাকা হয়েছে। ড্রাগ ইন্টারন্যাশনালের তৈরি ডায়াবেটিসের ডায়মোরাল ৪০ এমজি একটি ট্যাবলেট আট থেকে বেড়ে ১২ টাকা হয়েছে। শরীরের পানিশূন্যতা পূরণে এসএমসি কোম্পানির তৈরি ওরস্যালাইন এন প্রতি প্যাকেটের দাম পাঁচ থেকে ছয় টাকা হয়েছে। এসকেএফ কোম্পানির তৈরি শিশুদের জিংক সিরাপ (১০০ মিলি) ৩৫ থেকে বেড়ে ৫০ টাকা হয়েছে। আমাশয়ের চিকিৎসায় ব্যবহূত সব কোম্পানির তৈরি মেট্রোনিডাজল গ্রুপের ট্যাবলেটের দাম এক টাকা করে বেড়েছে।

অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টের চিকিৎসায় ব্যবহূত একমি কোম্পানির তৈরি মোনাস ১০ ট্যাবলেট ১২ থেকে ১৬ টাকা হয়েছে। ইনসেপ্টার তৈরি গ্যাস্ট্রিকের ওমিডন ১০ ট্যাবলেট প্রতি পিস তিন টাকা থেকে বেড়ে চার টাকা হয়েছে। অপসোনিন কোম্পানির তৈরি গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ ফিনিক্স ২০ এমজি পাঁচ থেকে সাত টাকা হয়েছে। ব্যথা ও গ্যাস্ট্রিকের চিকিৎসায় ব্যবহূত রেডিয়েন্ট ফার্মার ন্যাপ্রোসিন প্লাস ২০ এমজি+ ৩৭৫ এমজি ট্যাবলেট ১৬ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ২০ টাকা হয়েছে। এরিস্টোফার্মার মাল্টি ভিটামিন এরিস্টো গোল্ড ১৫ পিস ট্যাবলেটের কৌটা ১০৫ থেকে বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা এবং ৩০ পিস ট্যাবলেটের কৌটা ২১০ থেকে ২৭০ টাকা হয়েছে।  

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আইয়ুব হোসেন দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘শুধু ওষুধ নয়, সব জিনিসের দাম বেড়েছে। ওষুধের কাঁচামালের দাম বেড়েছে। ওষুধ প্রস্তুতকারকদের লোকসান হচ্ছে। তাই তারা ওষুধের মূল্য নির্ধারণের আবেদন করেছিল। আমরা ১১৭ জেনেরিকের মধ্যে ২০ জেনেরিকের দাম পুনর্নির্ধারণ করে দিয়েছি।

তিনি বলেন, অনেক ওষুধ প্রস্তুতকারক আগের দামেও ওষুধ বিক্রি করছেন। আবার অনেকের উৎপাদন বন্ধের উপক্রম। তবে অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণের সুযোগ নেই। কেননা, আমাদের এই বাজারে এক জনের সাথ্যে অন্যের প্রতিযোগিতা রয়েছে। আমাদেরও মনিটরিং রয়েছে। কেউ নির্ধারিত মুল্যের বেশি দামে ওষুধ বিক্রয় করার অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেবো।’

Link copied!