নভেম্বর ১৩, ২০২২, ১২:৩২ এএম
চোরের হাতে মাল আর ছিনতাইকারীর হাতে জান— সোপর্দ করেই যেন বর্তমান সময়ে চলতে হচ্ছে রাস্তায়, থাকতে হচ্ছে বাসায়। নিরাপত্তার বিষয়টিও যেন হয়ে উঠেছে দুষ্কর। এরমধ্যে ছিনতাইয়ের বিষয়টি ভিন্ন, কারণ ছিনতাইয়ের ঘটনা দেশে ধারাবাহিকভাবেই ঘটে থাকে। যদিও কখনো কখনো কিছুটা কমবেশি। অর্থাৎ থেমে নেই; থেমে নেই ছিনতাইকারীর হাতে মালের পাশাপাশি জান খোঁয়ানোর ঘটনাও।
তবে বাসাবাড়িতে চুরির ঘটনাটিই সম্প্রতি বেড়ে গেছে উদ্বেগজনক হারে এবং এটিই এখন নাগরিকদের আতঙ্কের কারণ। যদিও মাঝে মধ্যে ঢাকায় দু’-চারটি চুরির ঘটনা ঘটে থাকে, পুলিশও জড়িতদের আইনের আওতায় আনে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তা নিত্যনৈমিত্তিক ও ধারাবাহিক ঘটনায় রূপ নিয়েছে। আশি-নব্বইয়ের দশকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অজোপাড়াগাঁয়ের গ্রামগুলোতে গভীর রাতে গরুচোর পড়েছে বলে চিৎকার শোনা গেলেও দীর্ঘসময় পর সেসব ঘটনারও পুনরাবৃত্তি ঘটছে এখন। সে সময়কালে রান্নাঘরে ঢুকে হাঁড়িপাতিল চুরির ঘটনাও ঘটত অহরহ।
তবে এখনকার চোরদের নজর দামি আসবাবপত্রের দিকে। যেনতেনভাবে নয়, এই ক্যাটেগরিতে চুরির ঘটনা বাড়ছে হু হু করেই। কম্পিউটার, সিলিং ফ্যান, মোবাইল, ব্লেন্ডার, স্বর্ণের গয়না, নগদ টাকা এসবের দিকেই এখন নজর বেশি। কেন হঠাৎ আশি-নব্বইয়ের দশকের আদলে চুরির ঘটনা বাড়ছে তার উত্তরে সুশীল সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ কিংবা অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকটের যে প্রেক্ষাপটে রয়েছে দেশ, তার প্রভাবেই এসব ঘটনা বাড়ছে। আরও বৃদ্ধির আশঙ্কাও করছেন তারা।
বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের বিষয়টি উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারপারসন খন্দকার ফারজানা রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে জিনিসপত্রের দাম এতটা বেড়েছে যে, একটি শ্রেণি নিয়মিতই মারজিনালাইজড হচ্ছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেকটাই সংকুচিত হয়ে গেছে। যারা নিম্নবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত তাদের জীবন ধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা নিম্নবিত্তের দিকে চলে যাচ্ছে। প্রত্যেকটি পণ্যের দামই অপরিবর্তিত না হয় ঊর্ধ্বমুখী, নিম্নমুখী নেই কোনোটিই। যে কারণে মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। বৈধভাবেও জীবন ধারণে ব্যর্থ হচ্ছে। হয়তো এ জন্যই অনেকেই অবৈধ পথ বেছে নিচ্ছেন। চুরির মতো ঘটনায়ও জড়িয়ে পড়ছেন।
তিনি বলেন, কাউকে কাউকে হয়তো ছোটখাটো জিনিসিপত্র চুরি করে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে চাচ্ছে। এ ছাড়া ছোট অপরাধ হিসেবে বিবেচনা হওয়ায় চুরির ঘটনায় পুলিশ রিপোর্ট কম হয়। এ সুযোগেও একটি গোষ্ঠী চুরিতে জড়িয়ে পড়ছে। জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে যারা হিমশিম খাচ্ছে তারা ছাড়াও অনেক সময় মাদকাসক্তরাও চুরির ঘটনা ঘটাচ্ছে।
এসব ঘটনার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশেষ প্রয়োজনে তিন দিনের জন্য পরিবারকে গ্রামে পাঠান রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানাধীন কাজলার বাসিন্দা সজল আহম্মেদ। ফাঁকা বাসা তালাবদ্ধ করে নিশ্চিন্ত মনে পরদিন অফিসে যান তিনি।
দুপুরের দিকে পাশের পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা তাকে ফোন করে জানান, তার বাসায় চুরি হয়েছে।
তারাও প্রথমে টের পাননি চুরির বিষয়টি। ঘটনা সম্পর্কে আমার সংবাদকে সজল জানান, পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা স্থানীয় একটি স্কুলের শিক্ষকতা করেন। তিনি দুপুরের খাবার খেতে এসে আবার স্কুলের উদ্দেশে বের হওয়ার সময় বুজতে পারেন বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে রেখেছে কেউ। নিচের ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের ফোন করলে তারা উঠে এসে দরজা খুলে দেন। বের হয়েই দেখতে পান সজল আহম্মেদের ফ্ল্যাটের তালা নেই। ভেতরে প্রবেশ করে দেখেন আসবাবপত্রের সবই এলামেলো। সজলকে ফোনে জানালে তিনি বাসায় গিয়ে দেখেন তার কম্পিউটার, মোবাইল, ৬৫ হাজার টাকা, প্রেশার কুকারসহ বেশ কিছু মালামাল খোয়া গেছে। বাসার নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ করে বাড়িওয়ালাকে নোটিস করে গত মাসেই বাসা ছেড়ে দেন। অফিসে সহকর্মীদেরও এ ঘটনা জানিয়ে সচেতন থাকার পরামর্শ দেন তিনি। তার সহকর্মীদের একজন রফিকুল ইসলাম। বাসা শনির আখড়া এলাকার তুষার ধারা ৪ নম্বর গলিতে। তিনি তার স্ত্রীকে ঘটনাটি জানান। জানানোর দুই ঘণ্টা পরই কাকতালীয়ভাবে তার বাসাতেও চুরির ঘটনা ঘটে। ঘড়িসহ দামি বেশ কিছু আসবাবপত্র নিয়ে যায়। আলমিরাসহ অন্যান্য সব তন্নতন্ন করে খুঁজেও গয়না ও নগদ টাকা না পেয়ে চলে যায় চোর। একই দিন একই এলাকায় তার বোনের বাসাতেও চুরির ঘটনা ঘটে। ওই বাসা থেকে নেয়া হয় নগদ দুই লাখ টাকাসহ দামি আসবাবপত্র।
এদিকে সজল আহম্মেদের পর একই বাসার ষষ্ট তলায়ও চুরির ঘটনা ঘটে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে। ওই বাসার বাসিন্দা ফয়সাল জানান, তার একটি ল্যাপটপ, পানির ফিল্টার, সিলিং ফ্যান, ব্লেন্ডার ও বাচ্চার খেলার মোটরগাড়ি চুরি হয়। একই বাড়িতে পরপর দুটি চুরির ঘটনায় পুরো বাড়ির ভাড়াটিয়াদের মধ্যেই দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাড়তি হয়রানির ভয়ে থানা পুলিশে অভিযোগ করেননি তিনি। তবে চুরির ঘটনা জানিয়ে প্রবাসে থাকা বাড়ির মালিককে বাসা ছেড়ে দেবেন বলে জানালে ওই সপ্তাহেই বাড়ির নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত প্রত্যেক ফ্লোরেই সিসিটিভি ক্যামেরা বসান মালিক। এখন সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে বাড়ির নিরাপত্তা কতটা নিশ্চিত হয়, তা দেখার বিষয় বলেন ফয়সাল। গত মে মাসে রাজধানীর হাতিরঝিলের মহানগর প্রজেক্টে সিনিয়র সাংবাদিক আলম রায়হানের বাসায়ও চুরির ঘটনা ঘটে। টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, ক্যামেরাসহ মূল্যবান সামগ্রী চুরি গেছে তার বাসা থেকে। এতে অন্তত ১২ লাখ টাকার ক্ষতি হয় তার। মহানগর আবাসিক এলাকার ডি-ব্লকে একটি বাসার চতুর্থ তলায় চুরির এই ঘটনা ঘটে।
এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে গভীর রাতে গরু চুরির ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। গণমাধ্যমগুলোও এমন খবর আসছে। নরসিংদীর পলাশেও গরু চুরির ঘটনা বেড়েছে উদ্বেগজনকহারে। যা অতীতের ২০-৩০ বছর আগে ঘটত। এখন পুনরায় সেসব ঘটনা পুনরাবৃত্তিতে মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে পলাশ থানার মানুষের।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন চুরির ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। এতে সব মিলিয়ে প্রতি মাসে অন্তত অর্ধশতাধিক চুরির ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে কিছু ঘটনায় মামলা হলেও বাকিগুলো অজানাই থেকে যাচ্ছে। এসব ঘটনায় অধিকাংশ ভুক্তভোগী ভুগেন হতাশায়। কারণ, মামলা করেও দীর্ঘসময় ধরে ঘটনার কোনো অগ্রগতি কিংবা চুরি যাওয়া মালামাল উদ্ধার সম্ভব হয় না।
জানা গেছে, খোদ রাজধানীতেই গত ছয় মাসে প্রায় হাজারের মতো ছোট-বড় চুরির ঘটনা ঘটেছে। যার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা থানায় কোনো মামলা করেননি। এরমধ্যে শুধু গত সেপ্টেম্বরেই রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৭৩টি চুরির মামলা রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও বাস্তবে এর সংখ্যা আরও বেশি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাসাবাড়ি ছাড়াও দোকান, মার্কেট এমনকি শপিংমলেও এখন কমবেশি প্রতিদিনই চুরির ঘটনা ঘটছে। এতে নগরবাসীর অভিযোগ— থানা পুলিশ সদস্যরা রাতে ভালোভাবে টহল ডিউটি পালন করেন না। এ জন্য নিত্যদিন চোর চক্রের উৎপাত বাড়ছে। তা ছাড়া চোর ধরতে পুলিশের আগ্রহ একেবারেই কম।
তবে বিভিন্ন মার্কেট কিংবা শপিংমল সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মার্কেটের নিরাপত্তাকর্মীদের কঠোরভাবে বলা হয়েছে, চুরির দৃশ্য দেখলেই যেন তারা কমিটিকে ফোন করে বিষয়টি জানায়।
জানা গেছে, বর্তমান সময়ে তালা না ভেঙেই চুরির ঘটনা ঘটছে। যে কারণে আশপাশে থাকা লোকজনও টের পাচ্ছে না। ভুক্তভোগীরা আমার সংবাদকে জানান, তরল জাতীয় পদার্থের ব্যবহারে তালা খুলেই চুরির ঘটনা ঘটাচ্ছে। তরল পদার্থ ব্যবহারের কারণে কোনো শব্দ পাওয়া যায় না।
পুলিশ বলছে, রাজধানী ছাড়াও সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে চুরির ঘটনায় ভুক্তভোগীরা মামলা করতে চান না। আবার মামলা হলেও পুলিশ চুরির মামলাটি অনেক সময় গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করে না। কারণ, বিষয়টি যেহেতু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দেখভাল করেন না, তাই নিচের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এ অপরাধটিকে অনেকটা ক্ষুদ্রভাবেই দেখেন। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া চুরির ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তও হয় না। সেই সাথে অপরাধী চক্রও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে কাউকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হলেও খুব দ্রুতই জামিন পেয়ে যায় সেই অপরাধী। কারণ, চুরির মামলায় দ্রুত জামিন পাওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। এতে একই চোর বারবার চুরির ঘটনা ঘটাচ্ছে। পাশাপাশি কারাগারে গিয়েও তাদের সংশোধনের মতো তেমন কোনো সুযোগ থাকছে না।
গোয়েন্দা পুলিশ সদস্যরা বলছেন, ঢাকায় চোর চক্রের সদস্যরা এখন আর তেমন ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস চুরি করে না। আগে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস চুরির ঘটনায় অনেক চোরচক্র গ্রেপ্তার হয়েছে। ফলে আগের ঘটনাগুলো থেকে তারা শিক্ষা নিয়ে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস চুরিতে তেমন আগ্রহ দেখায় না। তবে বর্তমানে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে চুরির সময় স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা-পয়সা নিয়ে তারা পালিয়ে যাচ্ছে। আর এসব চোরচক্রের সদস্যদের অধিকাংশই মুঠোফোন ব্যবহার করেন না। এতে তাদের ধরাও খুব কঠিন হয়ে যায়।
তারা আরও বলছেন, দিনের বেলায় সাধারণত ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসগুলো বেশি চুরি হয়ে থাকে। তবে রাতে চুরি হয়ে থাকে স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা। আর রাতের চুরির ঘটনাগুলোতে চোর চক্র কয়েক দিন ধরে ফাঁকা পড়ে থাকা বাসাগুলোকেই টার্গেট করছে। সমপ্রতি কলাবাগানে একটি চুরির ঘটনায় এক চোর চক্রকে ধরতে সক্ষম হয় রমনা বিভাগীয় পুলিশ। তবে এই চোর চক্রকে ধরতে গিয়ে মিলেছে আরও বেশ কয়েকটি চক্রের সন্ধান।
সব মিলিয়ে পুলিশের তথ্য বলছে— পুরো ঢাকায় অন্তত চার হাজার চোর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যাদের অধিকাংশই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চুরির ঘটনা ঘটায়। এমনকি মিরপুরের কাফরুল এলাকার বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও মার্কেটে চুরি করা একটি চক্রের মূল হোতাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ওই ঘটনাও মিলেছে অবাক করার মতো তথ্য। এই চোর চক্রটি বাসার গ্রিল কাটতে বেশ দক্ষ। এমনকি তারা বাসার গ্রিল কাটার যন্ত্রসহ পুরো ঢাকায় শুধু চুরির উদ্দেশে একটি মাইক্রোবাসে দাপিয়ে বেড়াত বলে জানিয়েছে পুলিশ। যেই চক্রের মূল হোতা আজিজুল হক ফকির, যিনি কি-না মাদারীপুর সিড়খাড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান মেম্বার!