Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪,

উচ্চঝুঁকিতে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস

মাহমুদুল হাসান

নভেম্বর ১৪, ২০২২, ০১:৩৫ এএম


উচ্চঝুঁকিতে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস

দোলা রাজধানীর একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত। ২০২১ সালে তিনি প্রথম সন্তানের মা হন। আনন্দের সেই মুহূর্তে তিনি গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আক্রান্ত হন। পরে তার পুত্র জাওয়াদের দেহেও টাইপ-১ ডায়াবেটিস শনাক্ত হয়।

আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য মতে, দেশে প্রায় এক কোটি ৩০ লক্ষাধিক মানুষ ডায়াবেটিস রোগী। তার মধ্যে অর্ধেকই নারী। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের প্রতি ১০০ জনের ২৬ জন নারী গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। এদের মধ্যে আবার ৬৫ শতাংশ নারী পরবর্তীতে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারী ও গর্ভস্থ শিশুদের পরবর্তীতে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সম্ভাবনা বেশি। এছাড়াও গর্ভকালীন ডায়াবেটিস যদি নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, তাহলে পরবর্তী সময়ে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি আরো বেশি।

এদিকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে পক্ষাঘাত, হূদরোগ, পায়ে পচনশীল ক্ষত, অন্ধত্ব ও কিডনি সংক্রান্ত জটিলতার মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে সচেতন করা। যাদের এখনো ডায়াবেটিস হয়নি তাদেরকে ডায়াবেটিস বিষয়ে সচেতন করে তোলা। পরিকল্পিত গর্ভধারণ ও গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস অনেকাংশেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান বলেন,  দেশের নারীদের মধ্যে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস মহামারি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এতে প্রসূতি মা ও গর্ভের সন্তান পরবর্তীতে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর দেশে দেশে টাইপ-১ ডায়াবেটিস বেশি থাকলেও বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগী বেশি।

তিনি বলেন, বারডেমে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ভিড় করে। আমরা সাধ্যমতো সেবার চেষ্টা করি। বারডেমে ৩০ শতাংশ শয্যা ও পরীক্ষা গরিব রোগীদের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকার বাডাসের পরামর্শে টাইপ ১ ডায়াবেটিস রোগীদের বিনামূল্যে ইনসুলিন দেয়া করেছে। এমন পরিস্থিতি আজ সোমবার ‘আগামীতে নিজেকে সুরক্ষায় ডায়াবেটিসকে জানুন’ প্রতিপাদ্য নিয়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস।

১৯৯১ সালে আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশন (আইডিএফ) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯১ সালে ১৪ নভেম্বরকে ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এদিন বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক বেন্টিং জন্ম নিয়েছিলেন এবং তিনি বিজ্ঞানী চার্লস বেস্টের সাথে একত্রে ইনসুলিন আবিষ্কার করেছিলেন।

দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ ডায়াবেটি সমিতির (বাডাস) আয়োজনে আজ সকাল ৮টায় রাজধানীর শাহবাগ মোড় থেকে রমনা পার্ক গেট পর্যন্ত ১০০টি রোড শোর আয়োজন করা হয়েছে। এরপর সকাল ১০টায় রোগী ও চিকিৎসকদের নিয়ে প্রশ্নোত্তর পর্ব পরিচালনার কথা রয়েছে।

এছাড়াও রমনা পার্ক গেট ও ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবরসহ বিআইএইচএস ও এনএইচএনের আওতাধীন বিভিন্ন কেন্দ্রে বিনামূল্যে ডায়াবেটিস নির্ণয় ও স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি পালন করার কথা জানিয়েছে বাডাস। এ ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দিবসটি পালন করা হবে।

বৈশ্বিক ডায়াবেটিস পরিস্থিতি : আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের (আইডিএফ) সর্বশেষ তথ্যানুসারে, বিশ্বে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ৫৪ কোটিরও বেশি। তার মধ্যে অর্ধেক মানুষ জানে না তার ডায়াবেটিস রয়েছে। ৫০ ভাগ রোগীর কোনো উপসর্গই থাকে না। গত বছর মৃত্যু হয়েছে ৬৭ লাখ মানুষের।  অথচ প্রায় ৭০ ভাগের রোগ প্রতিরোধযোগ্য।

বিশ্বের প্রতি ১০ জনে একজন ঘাতক রোগটিতে আক্রান্ত। আগামী ২০৩০ সালে সংখ্যাটি দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে ৬৪ কোটিতে এবং এখনই প্রতিরোধ করা না হলে ২০৪৫ সালে রোগীর সংখ্যা ৭৮ কোটিতে গিয়ে ঠেকবে বলে আশঙ্কা করা যাচ্ছে। ২০২১ সালে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৯৬৬ বিলিয়ন ডলার। তার মধ্যে শুধু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ব্যয় হয়েছে ৯ শতাংশ। বাংলাদেশের অবস্থা আরও নাজুক। দেশের চিকিৎসা খাতের মোট ব্যয়ের প্রায় ১৫ শতাংশ ব্যয় হয় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে।

আইডিএফ আরও জানায়, পৃথিবীতে যে পরিমাণ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তার মধ্যে প্রতি চার জনের তিন জনেরও বেশি নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশের নাগরিক। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ডায়াবেটিস বৃদ্ধির হার অত্যন্ত বেশি এবং তা প্রায় ২৫ শতাংশ। নারীদের মধ্যে বৈশ্বিকভাবে প্রায় দুই কোটি নারী গর্ভাবস্থায় হাইপারগ্লাইসেমিয়ায় (উচ্চ রক্তের গ্লুকোজ) আক্রান্ত। ডায়াবেটিসে আক্রান্তের দুই-তৃতীয়াংশ শহুরে আর তিন-চতুর্থাংশ কর্মজীবনকালের।

দেশের সর্বশেষ অবস্থা : বাংলাদেশ ডায়াবেটি সমিতি (বাডাস) আইডিএফের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিস আক্রান্ত। তার মধ্যে প্রায় অর্ধেক নারী। এদের মধ্যে আবার অর্ধেক মানুষ জানে না যে, তার ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে পক্ষাঘাত, হূদরোগ, পায়ে পচনশীল ক্ষত, অন্ধত্ব ও কিডনি সংক্রান্ত জটিলতার হারও দ্রুতবৃদ্ধি পাচ্ছে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকোর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের ১৯৫টি দেশে ২৫০টি রোগে মৃত্যু ও ভবিষ্যতে কোন রোগে বেশি মৃত্যু হবে, তার পূর্বাভাস দিয়েছেন। ওই অনুমিত হিসাবে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ডায়াবেটিসে ৩১ হাজার ৪৬০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের প্রতি ১০০ জনের ২৬ জন নারী গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়।

এদের মধ্যে আবার ৬৫ শতাংশ নারী পরবর্তীতে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারী ও গর্ভস্থ শিশুদের পরবর্তীতে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সম্ভাবনা বেশি। এ ছাড়াও গর্ভকালীন ডায়াবেটিস যদি নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, তাহলে পরবর্তী সময়ে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি আরো বেশি। এ অবস্থায় পরিকল্পিত গর্ভধারণ ও গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস অনেকাংশেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।

বাডাসে চিকিৎসাসেবার চিত্র : বাডাসের প্রতিষ্ঠান বারডেম, বিআইএইচএস ও ন্যাশনাল হেলথকেয়ার নেটওয়াকর্কের (এনএইচএন) ৩৫টি কেন্দ্র, ৬১টি অধিভুক্ত সমিতি, ২৯টি সাব এফিলিয়েটেড অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে দেশের ৫৯ লাখের বেশি রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে গত অর্থ বছরে বাডাসের ব্যয় হয়েছে প্রায় ৯০ কোটিরও বেশি টাকা।
 

Link copied!