অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
নভেম্বর ১৮, ২০২২, ০১:০৯ এএম
অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
নভেম্বর ১৮, ২০২২, ০১:০৯ এএম
সরকারের কাছে পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন ব্যবসায়ীরা। দামবৃদ্ধির আগ পর্যন্ত চলে এই সংকট। এরপর দাম বাড়লেই আর সংকট থাকে না। মুহূর্তেই পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে যায়। সংকটকালে ভোক্তা অধিকার অভিযান শুরু করলেও কোনো কুলকিনারা করতে পারে না।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পর্যাপ্ত মজুত সত্ত্বেও বাজারে সংকট থাকে। কিন্তু প্রভাবশালী মহলের সিন্ডিকেট ভাঙা অসম্ভব হয়ে পড়ে সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে। তাই দায়িত্ব পালনে লোক দেখানো কিছু অভিযান পরিচালনা করেই দায়মুক্ত হয় সরকারি দপ্তরগুলো।
প্রতিবারই ব্যবসায়ীদের খেয়ালখুশিমতো দাম নির্ধারিত হলেও গত রোজার ঈদের আগে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল সরকার। ফলে বাজার থেকে সয়াবিন তেল উধাও হয়ে যায়।
এরপর বাধ্য হয়ে দাম বাড়ানোর পরই বাজারে তেলের অভাব দূর হয়। এক কথায় সংকট সৃষ্টি করে নিজেদের ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণ করছেন ব্যবসায়ীরা। সরকারেরও করার কিছুই থাকছে না। ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ সব কিছুর নীরব দর্শক।
ডলারের দাম কিছুটা কমে এলে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১৪ টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। বাজারে কম দামের তেল আসতে সময় লাগে অন্তত ১৫ দিন। এরপর মাস না পেরোতেই ফের দাম বাড়াতে তৎপরতা শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু ডলারের দাম অপরিবর্তিত থাকলেও কেন তেল-চিনির দাম বাড়ল তার কারণ জানা সম্ভব হয়নি।
বাণিজ্য সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও ব্যবসায়ী নেতাদের একাধিকবার মুঠোফোনে কল করেও সাড়া মিলেনি। গত কয়েকদিন ধরে বাজারে সয়াবিন তেল ও চিনির সংকট চলছিল। সরকারের কাছে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে দামবৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়ার পর থেকে সংকট আরও প্রকট হতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে একসাথে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দুটির দাম বাড়ল।
গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র দামবৃদ্ধির খবর নিশ্চিত করে। বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১২ টাকা বাড়ানো হয়েছে। খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে বেড়েছে ১৪ টাকা। আর প্যাকেটজাত প্রতি কেজি চিনির দাম ১৩ টাকা বেড়েছে। নতুন এই দাম গতকাল থেকেই কার্যকর করার সিদ্ধান্ত হয়।
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গতকাল থেকে এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে । এত দিন এ দাম ছিল ১৭৮ টাকা। এ ছাড়া পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে হয়েছে ৯২৫ টাকায়। এত দিন দাম ছিল ৮৮০ টাকা, তার মানে নতুন করে বাড়ছে ৪৫ টাকা। অন্যদিকে খোলা সয়াবিনের দাম লিটারে ১৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে। তাতে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের নতুন দাম হচ্ছে ১৭২ টাকা। এত দিন প্রতি লিটার বিক্রি হয়েছে ১৫৮ টাকায়। আর প্রতি লিটার খোলা পাম তেল বিক্রি হবে ১২১ টাকায়।
অন্যদিকে প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনি ১০৮ টাকায় বিক্রি হবে। আগে দাম ছিল ৯৫ টাকা। তবে বেশ কিছু দিন আগেই বাজারে চিনির দাম শতক ছাড়িয়ে গেছে। বাজারে চিনির সংকটও দেখা দেয়। নতুন দর অনুযায়ী ৫০ কেজির চিনির বস্তার দাম হবে পাঁচ হাজার ১০০ টাকা। এ ক্ষেত্রে প্রতি কেজি চিনির দাম পড়বে ১০২ টাকা। এর আগে সর্বশেষ গত ৩ অক্টোবর দেশের বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমানো হয় লিটারে ১৪ টাকা।
জানা যায়, ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন গত বুধবার সয়াবিন তেলের দামবৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়। একইভাবে ওই দিনই চিনির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানায় চিনি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন। দাম বাড়ানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাথে একাধিকবার বৈঠক করে উভয় সংগঠনের নেতারা।
এর আগে চলতি ১ নভেম্বর আবার লিটারপ্রতি ১৫ টাকা দাম বাড়াতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেন ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম মোল্লা।
তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেন, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে টাকার অস্বাভাবিক দরপতনের ফলে সংগঠনভুক্ত সদস্যরা বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৯৩ টাকা করার প্রস্তাব করেছেন।
প্রসঙ্গত, খুচরা বাজারে চিনি ও ভোজ্যতেলের সরবরাহ নিয়ে টানাটানি চলছিল কিছু দিন ধরেই। আবার পাওয়া গেলেও তা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছিল। উৎপাদন ও সরবরাহ থাকলেও খুচরা বাজারে চিনির সংকট আছে বলে জানায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। তিনি গত বুধবার সরেজমিন রাজধানীর কারওয়ানবাজারে যান এবং ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলেন। বাজার পরিদর্শন করে তিনি দেখতে পান, তেল ও চিনি দুটোরই সংকট আছে খুচরা পর্যায়ে। শুধু খুচরা বাজারেই নয়, ডিলারদের কাছেও নেই চিনি। মিল থেকে চিনি দিচ্ছে না, আবার মিলাররা ক্রয়াদেশও বাতিল করছেন, এমন অভিযোগ করেছে ডিলাররা।
তবে ভোক্তার মহাপরিচালক জানিয়েছিলেন, মিল থেকে সরবরাহ স্বাভাবিক ছিল। অর্থাৎ পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও বাজারে সংকট তৈরি করছিল সিন্ডিকেট। সফিকুজ্জামান বলেন, আমাদের টিম মিল এলাকায় গেছে। তারা তথ্য নিয়েছে। উৎপাদন হচ্ছে কিন্তু বাজারে আসছে না। কোথাও না কোথাও যাচ্ছে। সেটি আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। কোন পর্যায়ে স্টক হচ্ছে সেটি বের করতে হবে। বাজারের খুচরা পর্যায়ে চিনি না থাকার বিষয়ে পাইকারি ব্যবসায়ী ও ডিলারদের অভিযোগ, মিল থেকে দিচ্ছে না। তবে দাম বাড়ালে সরবরাহ মিলবে বলে আশ্বাস পেয়েছিলেন তারা। আবার বাজারের কোথাও কোথাও চিনির দেখা মিললেও প্রতি কেজির দাম ১৮ থেকে ২০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছিল। বাজার স্বাভাবিক রাখতে চিনি প্রস্তুতকারী কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সরাসরি ট্রাকে করে চিনি ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছিল। খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করেছে একটি চক্র। গত রমজান মাসেও এ ধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছিল। দামবৃদ্ধির পর তেলের আর অভাব দেখা যায়নি।
ভোক্তারা বলছেন, আয় রোজগার বাড়লে দাম বাড়লেও সমস্যা হতো না। এখন হচ্ছে উল্টো, একদিকে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে অন্যদিকে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। তাই জনজীবনে চলছে নাভিশ্বাস। ব্যবসায়ীদের কাছে এখন জিম্মি সবাই। সংকটকালেও তারা অতি মুনাফা করে যাচ্ছে। এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ব্যবসায়ীরা লোকসান দেবে না এটি ঠিক।
তবে, কেউ কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অতি মুনাফা করছে কি-না তা খতিয়ে দেখা সরকারে দায়িত্ব। একই সাথে সরকারের উচিত গরিব মানুষকে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য সরবরাহ কার্যক্রম আরও বাড়ানো। তাহেল বর্তমান ঊর্ধব-মূল্যস্ফীতির বাজারে তারা কোনোমতে টিকে থাকতে পারবে। এর ফলে চাহিদাও কমবে। যা বাজার মূল্যে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। একই সাথে দামবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। মানুষের আয় বাড়ছে না; কিন্তু সব জিনিসের দাম বেড়েই চলেছে।
এদিকে বাড়ল সরকারিভাবে খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) করা আটার দাম। খোলা আটার দাম প্রতি কেজিতে ছয় টাকা ও প্যাকেট আটার দাম কেজিতে সাড়ে চার টাকা বাড়ানো হয়েছে। আগামী রোববার থেকে প্রতি কেজি খোলা আটা ভোক্তা পর্যায়ে ২৪ টাকায় বিক্রি হবে। এখন প্রতি কেজি খোলা আটার দাম ১৮ টাকা।
অন্যদিকে দুই কেজি প্যাকেটের আটা বিক্রি হবে ৫৫ টাকায়, এখন যার দাম ৪৬ টাকা। ফলে প্যাকেটের আটা প্রতি কেজিতে বেড়েছে সাড়ে চার টাকা। দুই কেজির প্যাকেট আটার দাম বেড়েছে ৯ টাকা। গত বুধবার ওএমএস কার্যক্রমে বিক্রি করা খোলা ও প্যাকেট আটার মূল্য পুনর্নির্ধারণ করে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। নতুন দাম আগামী ২০ নভেম্বর থেকে কার্যকর হবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
গত কিছুদিন ধরে আটা ও ময়দার বাজার ঊর্ধ্বমুখী। সরকারি বাণিজ্য সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবির বৃহস্পতিবারের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরীতে খোলা ও প্যাকেট আটা-ময়দা কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকায়। নিম্ন আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে সরকার ওএমএস কার্যক্রমের আওতায় চাল ও আটা বিক্রি করে থাকে। এক ব্যক্তি একসঙ্গে পাঁচ কেজি ওএমএসের খোলা আটা কিনতে পারেন।
পুনর্নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, খোলা আটার ক্ষেত্রে কেজিতে মিলারের কাছে গমের এক্স গুদাম মূল্য ১৯ টাকা, পেষাইসহ মিলারের কমিশন দুই টাকা পাঁচ পয়সা, ডিলারের কাছে আটা বিক্রি ২১ টাকা ৫০ পয়সা, ডিলারের কমিশন ও পরিচালন ব্যয় দুই টাকা ৫০ পয়সা। দুই কেজির প্যাকেজ আটার ক্ষেত্রে মিলারের কাছে গমের এক্স গুদাম মূল্য ৩৮ টাকা, পেষাই ও প্যাকেট করাসহ মিলারের কমিশন ১৩ টাকা, ডিলারের কাছে আটা বিক্রি ৫১ টাকা এবং ডিলারের কমিশন ও পরিচালন ব্যয় চার টাকা।