নভেম্বর ২৫, ২০২২, ০১:৫৭ এএম
পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ২০ শতাংশ বাড়ার পর এবার বাড়ছে খুচরা পর্যায়ে। গত সোমবার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসি ১৯.৯২ শতাংশ দাম বৃদ্ধি করে। পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ার পর ওই দিনই গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে পশ্চিমাঞ্চলের বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ওয়েস্টজোন। পর্যায়ক্রমে বাকি পাঁচ কোম্পানিও দাম বাড়ানোর প্রস্তাব জামা দিয়েছে বিইআরসির কাছে।
যদিও গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম আপাতত বাড়ছে না, তাই উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি আরও বলেন, পাইকারি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। সোমবার সচিবালয়ে বিইআরসির পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণার পর তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।
এর আগে বিইআরসি বলেছিল— সব বিতরণ কোম্পানির প্রস্তাব হাতে পেলেই যাচাই-বাছাই করে গণশুনানিতে যেতে পারে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) আবেদনের ভিত্তিতে গত ১৮ মে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির জন্য গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রায় ৬৬ শতাংশ দাম বাড়ানোর আবেদন করে তারা। এ বিষয়ে গণশুনানি শেষে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ঘোষণা দেয়, বিদ্যুতের দাম আপাতত বাড়ছে না।
জানা যায়, বিগত অর্থবছরে বিডিপির বিপুল লোকসানে পড়ে। তাই তারা বিদ্যুতের দাম বাড়ার প্রস্তাব জমা দেয় বিইআরসির কাছে। সে হিসাবে বিইআরসি গণশুনানি করে। সার্বিক বিষয় যাচাই-বাছাই করে দেখল, আপাতত বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। পরে সংস্থাটি ভার্চুয়াল এক সংবাদ সম্মেলে বিদ্যুতের দাম অপরিবর্তিত থাকবে বলে জানায়।
ঠিক এক সপ্তাহ পর বিডিপি বিষয়টি রিভিউ করে। তারপর কোনো বাছবিচার না করে , কোনো শুনানি না করেই বিধি ভেঙে প্রায় ২০ শতাংশ দাম বৃদ্ধি করে। তবে বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার বৃদ্ধির ফলে লোকসানে পড়বে বাকি পাঁচটি বিতরণ কোম্পানি। এ জন্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব জমা দিয়েছে কোম্পানিগুলো। এতে ১৫-২০ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। জানুয়ারিতে শুনানি শেষ করে ফেব্রুয়ারিতেই দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে কোম্পানিগুলো।
নতুন দাম ঘোষণার পর বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, গ্রাহক পর্যায়ে এখনই দাম বাড়ছে না। জনগণের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এ বিষয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়লে তা গ্রাহক পর্যায়ে বাড়বে না, এটি কোনো দূরদর্শী বা যৌক্তিক কথা নয়। এটি কথার কথা। এ কথার কোনো ভিত্তি নেই। এই পয়সা যেভাবেই হোক, কোনো না কোনোভাবে ভোক্তার পকেট থেকেই নেয়া হবে। এখনই গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়বে না— এটি সরাসরি প্রতারণা।’
সরকার অযৌক্তিক ব্যয় না কমিয়ে এভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অযৌক্তিক ব্যয় কমানোর বিষয়টি তারা এড়িয়ে গেল। দুর্নীতির দায়, অদক্ষতার দায়সহ সবই আমরা দেখিয়ে দিলাম। অথচ সেটি না কমিয়ে সেখানে থেকে যে ঘাটতি হলো, সেটার হিসাব করে মূল্যবৃদ্ধি করা হলো।
এ বিষয়ে পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) এক কর্মকর্তা জানান, ইতোমধ্যে জমা দেয়া আবেদনে ২০ ভাগ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন তারা। মূলত পাইকারি দাম বাড়াতে খুচরা বিদ্যুৎ বিক্রির প্রভাব বিবেচনা করে এই দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিশনের সদস্য আবু ফারুক বলেন, বিতরণ কোম্পানিগুলো যদি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় তাহলে কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী আমরা তথ্য যাচাই-বাছাই করে গণশুনানি করব। এরপর কমিশন কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটি তখনকার বিষয়।
এদিকে বিদ্যুতের দাম নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল জানান, বিতরণ কোম্পানিগুলো পরবর্তী আদেশ না দেয়া পর্যন্ত গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়াতে পারবে না।
তিনি বলেন, বিতরণ কোম্পানিগুলো প্রস্তাব দেবে, গণশুনানি হবে, এরপর আদেশ দিলে দাম বাড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিদ্যুৎ খাতে ‘অযৌক্তিক’ ব্যয় না কমিয়ে সরকার জনগণের ব্যয়ভার বাড়িয়ে দিয়েছে। বরাবরই গতানুগতিক ঐকিক নিয়মে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস করার প্রতি নির্দেশনা থাকে না। এ খাতে অযৌক্তিক ব্যয় সমন্বয় করা হলে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির দরকার হতো না। এছাড়া কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রয়োজন না থাকলেও বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ অর্থ দেয়া হচ্ছে। এ কারণেই পিডিবির ঘাটতি বাড়ছে। এ ধরনের কাজের দায়ভার চাপানো হচ্ছে জনগণের ওপর।
তথ্যমতে, ২০১০ সাল থেকে গ্রাহক পর্যায়ে ৯ বার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির চিত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের গড় মূল্য ছিল তিন টাকা ৭৩ পয়সা। ২০২০ সালের মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাত টাকা ১৩ পয়সা। অর্থাৎ ১০ বছরে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে তিন টাকা ৪০ পয়সা বা ৯১ দশমিক ১৫ শতাংশ। প্রসঙ্গত, বিদ্যুৎ সঞ্চালনের দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) উপকেন্দ্র ১৫৮টি হয়েছে।
দেশে বিদ্যুৎ বিতরণের কাজটি করে চারটি কোম্পানি ও দুটি সংস্থা। এদের গ্রাহক চার কোটি। বিতরণের কাজটি করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবি, ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড-ওজোপাডিকো, নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড-নেসকো, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড আরইবি, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড-ডিপিডিসি ও ঢাকা ইলেকট্রিসিটি পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড-ডেসকো। এর মধ্যে দুই কোটি ৬০ লাখ গ্রাহক হলো আরইবির। আর এই আরইবির অঞ্চলেই রয়েছে ভোল্টেজ সমস্যা।