ডিসেম্বর ১, ২০২২, ০৩:১৫ এএম
গত জুলাই থেকে লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় তীব্র ভোগান্তিতে পড়ে দেশবাসী। তখন বলা হয়েছিল শীতকালে চাহিদা না কমা পর্যন্ত লোডশেডিং কমবে না। এখন শীতের আমেজ শুরু হওয়ায় বিদ্যুৎ প্রায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। রাজধানীতে লোডশেডিং প্রায় নেই বললেই চলে। রাজধানীর বাইরে সারা দেশেও বিদ্যুৎ প্রায় স্বাভাবিক। যদিও শীতের পর আবারও লোডশেডিং ফিরে আসা নিয়ে শঙ্কায় সাধারণ গ্রাহকরা।
প্রথম দিকে রাজধানীতে দিনে দু-এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং দেয়া হয়। কিন্তু দিন দিন লোডশেডিংয়ের সময় বাড়তে থাকে। গত অক্টোবরের শুরুর দিকেও লোডশেডিংয়ের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। তীব্র লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েন রাজধানীবাসী। রাজধানীর কোথাও কোথাও তিন ঘণ্টা আবার কোথাও চার ঘণ্টা করেও লোডশেডিং ছিল।
এমনকি রাতের বেলাতেও লোডিশেডিং দেয়া হয় অনেক এলাকায়। এ নিয়ে সব মহলেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। লোডশেডিং পরিস্থিতি নিয়ে উত্তপ্ত হয় জাতীয় সংসদও। গেল সংসদ অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে বিএনপির সংসদীয় দলের নেতা হারুনুর রশীদ অভিযোগ করেন, এই খাতে হরিলুট চলছে। বিষয়টি নিয়ে একদিন সংসদে সাধারণ আলোচনা হওয়া দরকার।
জবাবে সাধারণ আলোচনার পক্ষে একমত প্রকাশ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, জোট সরকারের আমলে দিনে ১৭ ঘণ্টা দেশ অন্ধকারে ছিল। বিদ্যুৎ চাওয়ায় গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কোম্পানিকে ৮৬ হাজার টাকা দেয়ার সত্যতা জানতে চান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। লোডশেডিং না থাকায় খুশি গ্রাহকরাও। তবে শীত চলে গেলে কি অবস্থা হয় তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। রাজধানীর একজন বাসিন্দা বলেন, কয়েকদিন আগে বিদ্যুৎ যাওয়া-আসার মধ্যে থাকত। এক সপ্তাহ ধরে যাচ্ছে না। আমরা চাই এই অবস্থা যেন সারা বছর থাকে।
এ বিষয়ে বিপিডিবি উপ-পরিচালক শামিম হাসান বলেন, শীতের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা কমছে। ফলে উৎপাদনে ঘাটতি পড়ছে না। আশা করছি আগামী তিন মাস এ ধারাবাহিকতাথাকবে। তবে তিন মাস পর কি হবে বলা যাচ্ছে না। সরকার চেষ্টা করা যাচ্ছে যেন লোডশেডিং না দিতে হয়। ডিসেম্বরে একটি কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে যাওয়ার কথা। সেটা উৎপাদনে গেলে আরও ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ হবে। ফলে অনেকটা চাহিদা পূরণ হবে। এদিকে পোশাক কারখানাগুলোতেও বিদ্যুতের সংকট অনেকটা কেটেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, পোশাক কারখানায় সামপ্রতিক সময়ে যে বিদ্যুৎ সমস্যা তৈরি হয়েছিল তার সমাধান হয়েছে। উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে কারখানায়। আশা করছি বিদ্যুতের মতো গ্যাস সংকটেরও সমাধান হবে।
প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ধৈর্য সহকারে এই সংকট মোকাবিলা করতে হবে। সবাইকে নিজ উদ্যোগে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে। পৃথিবীর অনেক উন্নত রাষ্ট্র, যাদের অনেক টাকা পয়সা আছে, তাদেরও লোডশেডিং হচ্ছে। ব্রিটেনে হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ায় হচ্ছে, জাপানে হচ্ছে। এরপর থেকেই রাজধানীতে শিডিউল করে লোডশেডিং শুরু হয়।
পরে চলতি নভেম্বরের শুরুতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছিলেন, নভেম্বর থেকে লোডশেডিং কমে আসবে। তিনি বলেন, আমরা মার্চ থেকে কী করব সেই পরিকল্পনা করছি। আমি মনে করি না ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি কোনো সমস্যা হবে। আস্তে আস্তে ভালো অবস্থানে যাব। আমি বলছি না, সম্পূর্ণ ভালো অবস্থানে যাব- তবে বিদ্যুতের ক্ষেত্রে আগের থেকে ভালো অবস্থা হবে।
তিনি বলেন, শতভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহের পরও আমাদের পরিস্থিতি ভালো ছিল। কিন্তু জ্বালানি সংকটে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছি না।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান বলেছেন, বিদ্যুতের বর্তমান পরিস্থিতি সাময়িক। খুব দ্রুত সমস্যা কেটে যাবে। শীত এলে বিদ্যুতের চাহিদা কমে আসবে। আগামী ডিসেম্বর থেকে এক এক করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হবে। একই সময়ে সঞ্চালন লাইনের কাজও শেষ হবে। সব মিলিয়ে আমরা আশা করছি, আগামী ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী সময়ে আমাদের লোডশেডিং থাকবে না।
তিনি বলেন, দেশে যত শিল্পকারখানা বাড়বে, বিদ্যুতের চাহিদা তত বাড়বে। সেই বিষয়টি বিবেচনা করেই মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে সোলার হতে পারে বড় সমাধান। সোলার দিয়ে চাহিদার বড় একটি অংশ মোকাবিলা করার চেষ্টা চলছে।
পিডিবি চেয়ারম্যান বলেন, বৈশ্বিক অস্থিরতা, ডলার ও জ্বালানি সংকট থেকে তো আমরা বিচ্ছিন্ন নই। যার কারণে জ্বালানি সাপ্লাই চেইনের ক্ষেত্রে কিছু বিঘ্ন হয় এবং হচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে সহসাই আমরা হয়তো এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করতে পারব বলে আশা করছি।
ডিপিডিসির বিকাশ দেওয়ান বলেন, সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী কোনো কোনো এলাকায় এক ঘণ্টা এবং কোনো কোনো এলাকায় দুই ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হচ্ছে। এ ছাড়া চাহিদার সঙ্গে উৎপাদন বাড়লেও বিদ্যুৎ ব্যবহারে সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বেশি। স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করা হয়েছে। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদনও কমছে। এদিকে, দেশে রিজার্ভ সংকট রয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল তেল ও গ্যাসের সংগ্রহ না করতে পারলে আসন্ন গরমে লোডশেডিং পরিস্থিতির আবারো অবনতি হতে পারে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো যত তাড়াতাড়ি উৎপাদনে আসবে পরিস্থিতির তত তাড়াতাড়ি উন্নতি হবে।
চলমান বিদ্যুৎ-জ্বালানি পরিস্থিতির বিষয়ে বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, দেশের বিদ্যুৎ খাত চরম সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অবস্থা খুবই শোচনীয়। এখন খুব বেশি কিছু করার নেই।
তিনি বলেন, শীতে বিদ্যুতে চাহিদা কিছুটা কমে, তখন লোডশেডিং পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হবে। কিন্তু এটা সমাধান নয়। জ্বালানির সংকট নিরসনের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দ্রুত উৎপাদনে আনার চেষ্টা করতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ ব্যবহারে কৃচ্ছ্রসাধন চালিয়ে যেতেই হবে।