ডিসেম্বর ৪, ২০২২, ১২:২৪ এএম
- কষ্টার্জিত অর্থ হুন্ডিতে পাচার
- তিন মাসের ব্যবধানে কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ
- দুঃসংবাদ শুনিয়েছে বিশ্বব্যাংক
- কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারি উদ্যোগের ফল শূন্য
- নিট রিজার্ভ ২৫.৩৯ ও গ্রস রিজার্ভ ৩৩.৭৯ বিলিয়ন ডলার
চলমান ডলার সংকটের মধ্যেই প্রবাসী আয়ে নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে গত অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় রেমিট্যান্স অনেক কম এসেছে। এবার সেই তালিকায় নাম লিখিয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকা।
চলতি অর্থবছরের প্রতি মাসেই এসব দেশ থেকে প্রবাসী আয়ের ধারা নিম্নমুখী রয়েছে। কয়েকটি দেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের বিভিন্নমুখী উদ্যোগের পরও সুফল মিলছে না। ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে দামের বড় পার্থক্য হওয়ায় অবৈধ হুন্ডিতে অর্থ আসছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এর মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কষ্টার্জিত বৈদশিক মুদ্রা দেশে আসার আগেই পাচার হয়ে যাচ্ছে অন্য দেশে। মহামূল্যবান এ সম্পদ হারিয়ে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। সরকার বিরোধীদের নেতিবাচক প্রচারণাও এ ক্ষেত্রে অনেকটা ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসী শ্রমিকদের বেশির ভাগই অবস্থান করেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। বার্ষিক রেমিট্যান্সের অর্ধেকই আসে সেখান থেকে। রেমিট্যান্স সংগ্রহে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, লিবিয়া ও ইরান উল্লেখযোগ্য। কিন্তু গত বছর থেকে দেশগুলো থেকে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমতে শুরু করেছে।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠান সৌদি আরবের প্রবাসীরা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ওই দেশ থেকে এসেছে ৪৫৪ কোটি ডলারের প্রবাসী আয়। কিন্তু এক বছর আগেও এর পরিমাণটা ছিল অনেক বেশি।
তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৭২ কোটি ডলার পাঠিয়েছিলেন তারাই। সুতরাং এক বছরের ব্যবধানে ১১৮ কোটি ডলারের পার্থক্য তৈরি হয়েছে। চলতি অর্থবছরেও দেশটি থেকে আসা রেমিট্যান্স কমতে শুরু করেছে। প্রথম মাস জুলাইয়ে ৩৪ কোটি ডলার আসলেও চার কোটি ডলার কমে গত অক্টোবর মাসে এসেছে ৩০ কোটি ডলার। মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে গত অর্থবছরে ২০৭ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২৫৪ কোটি ডলার। এদেশ থেকেও এক বছরে তৈরি হয়েছে ৪৭ কোটি ডলারের ব্যবধান। চলতি অর্থবছরে কমতে কমতে এ দেশটি থেকে আসা প্রবাসী আয় প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এসেছিল ৩০ কোটি ডলার। চতুর্থ মাস অক্টোবরে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ডলারে।
এ ছাড়া কুয়েত থেকে এক বছরের ব্যবধানে রেমিট্যান্স কমেছে ৫৪ কোটি ডলার, ওমান থেকে ৪৮ কোটি, কাতার থেকে ৪৫ কোটি এবং বাহরাইন থেকে কমেছে ২০ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসের তুলনায় চতুর্থ মাসে এসব দেশ থেকে প্রবাসী আয় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমেছে। একই চিত্র যুক্তরাজ্যে। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে দেশটি থেকে এসেছিল ১৯ কোটি ডলার। কিন্তু অক্টোবরে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ কোটি ডলারে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা প্রবাসী আয় আগের অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে সামান্য কমেছে। তবে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ ধারা নিম্নমুখী। প্রতি মাসেই কমছে দেশটি থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতে ৩৬ কোটি ডলার আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। তিন মাসের ব্যবধানে এর পরিমাণ ১৩ কোটি ডলার কমে গেছে। গত অক্টোবরে দেশটি থেকে এসেছে মাত্র ২৩ কোটি ডলার।
খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, মালয়েশিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুরসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশে পাচারকারীরা বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতারাও রেমিট্যান্স পাচারের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। তাদের অনেকে এক দেশ থেকে রেমিট্যান্সের টাকা সংগ্রহের পর বিনিয়োগ করছেন আরেক দেশের বিভিন্ন খাতে। অনেক ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তি বর্তমানে বিদেশে পরিবারসহ বাস করছেন। তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহসহ ক্ষেত্রবিশেষে বিদেশে তাদের সম্পদ বা ব্যবসা-বাণিজ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন বা চাহিদা তৈরি হয়েছে। এই চাহিদা তারা পূরণ করছেন হুন্ডিচক্রের মাধ্যমে ও প্রবাসী আয় সংগ্রহ করে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ডলারের যৌক্তিক দাম নির্ধারণের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী তারা ব্যবস্থা নিয়েছে।
এছাড়া আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। ব্যাংকগুলোও বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। একই সাথে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে সব ধরনের অনিয়ম ও কারসাজি বন্ধে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ করছে।’ তবে এসব উদ্যোগের পরও রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতির ফলে দেশে চলমান ডলার সংকটের মধ্যে ধারাবাহিক কমতে থাকা প্রবাসী আয় অর্জনে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি।
কাগজপত্রে ছাড়, ডলারের দাম বৃদ্ধি ও প্রণোদনাসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েও যখন গতি ফিরছিল না তখন রেমিট্যান্স পাঠানোর চার্জ মওকুফ করে দেয় ব্যাংকগুলো। প্রবাসীদের টাকা পাঠাতে সুবিধার কথা বিবেচনা করে ছুটির দিনেও বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউস খোলা রাখা হচ্ছে।
সর্বশেষ সরাসরি মোবাইলে ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা আনার সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবুও কাঙ্ক্ষিত রেমিট্যান্স আসছে না। সদ্য শেষ হওয়া নভেম্বর মাসে আগের মাসের তুলনায় সামান্য বেড়েছে। অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এলেও পরের দুই মাসে ধস নামে।
এর আগে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়াতে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) যৌথভাবে ব্যাংকগুলোকে রেমিট্যান্স কেনার জন্য দাম নির্ধারণ করে দেয়। বর্তমানে ১০৭ টাকায় রেমিট্যান্স ও ১০০ টাকায় রপ্তানি বিলের মাধ্যমে আসা ডলার সংগ্রহ করছে ব্যাংক। এর সাথে আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। এতেও গত মাসগুলোতে কোনো কাজ হচ্ছিল না। তবে সর্বশেষ চার্জ মওকুফ ও ছুটির দিনে রেমিট্যান্স পাঠানোর সুযোগ দেয়ার পর নভেম্বর মাসে আগের তুলনায় রেমিট্যান্সের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, নভেম্বর মাসে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আগের দুই মাস সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে যথাক্রমে ১৫৩ কোটি ৯৬ লাখ এবং ১৫২ কোটি ৫৫ লাখ ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। যদিও অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স নিয়ে হতাশার কথা জানিয়েছে শুনিয়েছে বিশ্ব আর্থিক খাতের মোড়ল সংস্থা বিশ্বব্যাংক।
ওয়াশিংটনভিত্তিক এই উন্নয়ন সংস্থাটি বলেছে, চলতি ২০২২ সাল শেষে বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে অঙ্ক দাঁড়াবে ২১ বিলিয়ন (দুই হাজার ১০০ কোটি) ডলার। যা হবে ২০২১ সালের চেয়ে ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ কম। এই নেতিবাচক প্রবণতা আগামী ২০২৩ সালেও অব্যাহত থাকবে।
গত বছর দেশের প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২ দশমিক ২ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর (২০২১ সাল) বাংলাদেশে ২২ দশমিক ২০ বিলিয়ন (দুই হাজার ২২০ কোটি) আমেরিকান ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। সেই সুবাদে ওই বছরে প্রবাসী আয় প্রাপ্তিতে বিশ্বে সপ্তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। চলতি বছর শেষে তা ১২০ কোটি বা ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার কমে ২১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসবে। আর এতে প্রবাসী আয় প্রাপ্তিতে বিশ্বে নবম স্থানে নেমে যাবে বাংলাদেশ।
২০২০ সালে প্রবাসী আয় এসেছিল দুই হাজার ১৭৫ কোটি (২১.৭৫ বিলিয়ন) ডলার। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তথা মজুতের বড় উৎস রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। তবে গত অর্থবছরের তুলনায় রপ্তানি আয় ৩৫ শতাংশ বাড়লেও প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে। এর ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ এখন ৩৩ দশমিক ৭৯ ডলারে অবস্থান করছে। বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগকৃত অর্থ বাদ দিলে নিট রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৫ দশমিক ৩৯ ডলার।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘অবৈধ হুন্ডি বন্ধ না হলে প্রবাসী আয় বাড়ানো সম্ভব নয়। প্রবাসীদের অবৈধ চ্যানেল অর্থ পাঠানো বৃদ্ধির কারণে গত কয়েক মাস ধরে প্রবাসী আয় কমছে।’