Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৪,

ঢাবি শিক্ষকের নিষ্ঠুরতার বলি রুবিনা

মো. মাসুম বিল্লাহ

ডিসেম্বর ৪, ২০২২, ১২:৪১ এএম


ঢাবি শিক্ষকের নিষ্ঠুরতার বলি রুবিনা

ব্যক্তি জীবনে বেপরোয়া ঢাবির সাবেক সহকারী অধ্যাপক আজহার জাফর শাহ পুলিশি হেফাজতে চিকিৎসাধীন থাকলেও রুবিনা আক্তারকে ছাড়তে হলো পৃথিবী মায়া। যাকে এক কিলোমিটার পথ গাড়ির নিচে আটকিয়ে টেনে নিয়ে যান জাফর শাহ।

এতটাই বেপরোয়া ছিলেন জাফর শাহ, সে সময় কারও সিগন্যালই মানেননি তিনি। মানলে হয়তো গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যেতেন রুবিনা। নিষ্ঠুর-নির্দয়, অমানবিক জাফর শাহ বাঁচতে দিলেন না স্বামী হারিয়ে দিশাহারা রুবিনাকে। এতিম করলেন অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া তার একমাত্র ছেলে আরাফাত রহমানকেও।

পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বলছেন, এটি হত্যাকাণ্ড। এ ঘটনায় নির্বাক দেশের মানুষও। গতকাল শনিবার এ ঘটনায় নিহত রুবিনা আক্তারের ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

অন্যদিকে চালক আজহার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন বলে জানা গেছে। ২০১৮ সালে তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কারণে চাকরিচ্যুত হন। মারধরে আহত হওয়ার পর তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

শাহবাগ থানার ওসি নূর মোহাম্মদ বলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে শুক্রবার গভীর রাতে রুবিনা আক্তারের ভাই জাকির হোসেন সড়ক পরিবহন আইনে মামলা করেছেন। রুবিনাকে গাড়ির নিচে টেনে নেয়া চালক আজহার জাফর শাহকে মামলায় আসামি করা হয়েছে।

গতকাল দেবর নুরুল আমিনের সাথে মোটরসাইকেলে রুবিনা আক্তার রাজধানীর তেজগাঁওয়ের বাসা থেকে হাজারীবাগে বাবার বাড়ি যাচ্ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বিপরীতে টিএসসি অভিমুখী সড়কে একটি প্রাইভেটকার পেছন থেকে তাদের মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়। এতে নুরুল আমিন মোটরসাইকেলসহ একপাশে ছিটকে পড়েন। রুবিনা গাড়ির নিচে চাপা পড়েন।

এসময় গাড়ির বাম্পারে তার পোশাক আটকে যায়। চালক গাড়ির নিচে আটকে যাওয়া রুবিনাকে নিয়ে বেপরোয়া গতিতে টিএসসি হয়ে নীলক্ষেতের দিকে যান। নীলক্ষেতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তোরণের কাছে গাড়িটি আটকে রুবিনাকে জীবিত উদ্ধার করেন পথচারীরা। ঢামেকে নেয়ার কিছুক্ষণ পরই তিনি মারা যান। জানা গেছে, প্রতি সপ্তাহেই হাজারীবাগে বাবার বাসায় যাওয়া-আসা করতেন তিনি।

শুক্রবার বিকেলের এ ঘটনায় পথচারীরা যখন রুবিনাকে উদ্ধার করেন, ততক্ষণে গাড়ির সাথে তার আটকে থাকা দেহটি টেনে চালক এক কিলোমিটারের বেশি পথ চলে গেছেন। এতে তার শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। এসময় টিএসসি থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত সড়কের কোথাও কোথাও তার দেহের পড়ে থাকা অংশ দেখা যায়। নীলক্ষেত এলাকায় গাড়ির চালক আজহার জাফর শাহকে আটক করে মারধর করেন পথচারীরা। গাড়িটিও ভাঙচুর করা হয়।

রুবিনার দেবর নুরুল আমিন বলেন, পেছন থেকে ধাক্কা দিলে রুবিনা গাড়িটির নিচে আটকে পড়েন। ওই অবস্থাতেই গাড়িটি বেপরোয়া গতিতে সামনে ছুটে চলে। গাড়ির পেছনে ছুটতে থাকেন তিনি। দেখেন, গাড়ির বাঁ পাশের সামনের ও পেছনের চাকার মাঝখানে রুবিনা আটকে আছেন। নীলক্ষেতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গেট থেকে একটু সামনে পলাশী অভিমুখী সড়কে পথচারীরা গাড়িটি আটক করেন।

রুবিনার স্বজনরা বলেন, রুবিনার স্বামী ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান দুই বছর আগে মারা যান। অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া একমাত্র ছেলে আরাফাত রহমান খানকে নিয়ে তেজগাঁওয়ের হোন্ডা গলিতে থাকেন তিনি। স্বামীর মৃত্যুর পর বাড়িভাড়া ও স্বজনদের সহযোগিতায় ছেলেকে লেখাপড়া করাচ্ছিলেন। রুবিনার বাবা ল্যান্স নায়েক রফিকউল্লাহ। তারা পাঁচ বোন ও দুই ভাই। তাদের বাড়ি হাজারীবাগ এলাকায়। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি কিছুটা ভেঙে পড়েছিলেন।

রুবিনাকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে তার বোন সুলতানা লিপি বলেন, ‘এ হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই। আমার বোনের মতো শত শত মানুষ এভাবে রাস্তায় মারা যাচ্ছেন, বিচার হচ্ছে না। সরকারের কাছে একটাই দাবি, সরকার যেন এসব হত্যার বিচার করে।’

রুবিনার ভাই জাকির হোসেনও দায়ী চালকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। এদিকে রুবিনার মৃত্যুকে ‘হত্যাকাণ্ড’ উল্লেখ করে পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মো. শহিদুল্লাহ বলেন, ‘এটি অবশ্যই একটি হত্যাকাণ্ড’।

তিনি বলেন, সড়ক আইন অনুযায়ী রেকলেস ড্রাইভিংয়ে মৃত্যু ঘটানোর শাস্তির বিধান আছে। এই আইনে তার যেন সর্বোচ্চ শাস্তি হয় সেটি আমরা চেষ্টা করব। আজহার জাফর শাহর বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

গতকাল শনিবার রাজধানীর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাকিল আহাম্মদের আদালত এ আদেশ দেন। আদালতের আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করে শাহবাগ থানার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও) নিজাম উদ্দিন বলেন, আদালতে মামলার এজাহার ও এফআইআর (প্রাথমিক তথ্য বিবরণী) এলে বিচারক তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য করেন।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় সাবেক শিক্ষকের গাড়িচাপায় এক নারীর মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিতের দাবিতে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) এলাকার রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে প্ল্যাকার্ড হাতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসে বহিরাগত ও ভারী যান চলাচল বন্ধের দাবি জানান তারা।

গতকাল শনিবার দুপুরের দিকে এ কর্মসূচি পালন করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্যাম্পাসে নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র অধিকার পরিষদ ও ছাত্র ফেডারেশনের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাবেক শিক্ষার্থী-প্রতিনিধিদেরও একটি অংশ শুক্রবার রাতে নিরাপদ ক্যাম্পাস দাবিতে উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের বাসভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে।

নিরাপদ ক্যাম্পাস চেয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিভিন্ন দাবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড হাতে অবস্থান নেয়া শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের ছাত্র রিফাত শাওন। তিনি চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন নেতৃত্বাধীন স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক।  

অবস্থান কর্মসূচিতে রিফাত বলেন, ‘একটা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এত উচ্চগতিতে চলছে, সেই গাড়ির বাম্পারে একজন নারী আটকে আছেন এবং পরে তার মৃত্যু হলো— আমি এটি মেনে নিতে পারছি না। ক্যাম্পাসের ভেতরে এ ধরনের ঘটনা দুঃখজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতদের কারণে আমরা শিক্ষার্থীরা অতিষ্ঠ। শুক্র ও শনিবার ছুটির দিনে ক্যাম্পাসটা পার্কের মতো হয়ে যায়, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে পারে না। ক্যাম্পাসে যানবাহন চলাচলের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।’

এদিকে আইনজীবীরা বলছেন, সড়ক পরিবহন আইনে দায়ের করা এ মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। সড়ক পরিবহন আইনেও দুর্ঘটনা সংক্রান্ত অপরাধের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তির বেপরোয়া বা অবহেলাজনিত মোটরযান চালনার কারণে সংঘটিত দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতর আহত হলে বা তার প্রাণহানি ঘটিলে, ওই ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড, বা অনধিক পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’

চাকরিচ্যুত সেই শিক্ষক ব্যক্তিজীবনেও বেপরোয়া 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক সহকারী অধ্যাপক আজহার জাফর শাহ। যিনি গত শুক্রবার বিকালে নিজের প্রাইভেটকারের নিচে ফেলে পিষে হত্যা করেছেন রুবিনা আক্তার নামের এক নারীকে। ঘটনার সময় তাকে সামনে-পেছন এবং দুপাশ থেকে শতশত পথচারী গাড়ি থামানোর সংকেত দিলেও পালিয়ে যাওয়ার মানসিকতায় বেপরোয়া গতিতে এক কিলোমিটার পথ গাড়ি চালিয়ে যান তিনি। সংকেত মানলে হয়তো বেঁচেও থাকতে পারতেন রুবিনা। এ ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ জনতার গণধোলাইয়ের শিকার হন এ শিক্ষক। ঢাবির নিষ্ঠুর এই সাবেক শিক্ষকের ব্যক্তিগত জীবনের বিষয়ে এখন উঠে আসছে বিভিন্ন ভয়ংকর তথ্য।

জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সর্বশেষ ২০১৮ সালে এই জাফর শাহকে চাকরিচ্যুত করেছিল। ২০০৭ সাল থেকে প্রায় ১০ বছর অনিয়মিত থেকে বিভাগ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না রাখায় ২০১৭ সালের ২৬ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় তাকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়।

২০০৭ সালে তার বিরুদ্ধে অশিক্ষক সুলভ এবং অপেশাদারিত্বমূলক আচরণের অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে বিভাগীয় তদন্ত কমিটি তাকে কারণ দর্শানোর নোটিস দিলে তিনি সেই নোটিসের জবাব দেননি। তাই ২০০৭ সাল থেকেই তাকে বিভাগীয় ক্লাস নেয়া থেকে বিরত রাখা হয়। তারপর থেকেই তিনি বিভাগের সাথে যোগাযোগ রাখতেন না।

সবশেষ ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় তাকে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। সূত্র জানায়, ছাত্রীদের সঙ্গেও অশোভন আচরণের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

জাফর শাহের ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী গণমাধ্যমকে বলেন, ক্লাসসহ একাডেমিক কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে ২০১৮ সালে আজহার জাফর শাহকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তার বাসা কোথায়, তা জানা নেই। এ ঘটনায় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেবে।   
 

Link copied!