ডিসেম্বর ১১, ২০২২, ০১:১৫ এএম
করোনা-পরবর্তী বিশ্বঅর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, ঠিক সে সময় রাশিয়ার-ইউক্রেন হামলার মধ্য দিয়ে ভেঙে পড়ে সরবরাহ শৃঙ্খলা। জ্বালানি সংকটে পরিবহন ব্যবস্থায় ধস, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দর, ডলার সংকটে যখন দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ছে, সে সময় দেশের বিমা খাতের অনন্য মাইলফলক স্পর্শ করেছে চতুর্থ প্রজন্মের সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির বিগত বছরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ব্যবসা অর্জন করে বিমা খাতে রাখে অনন্য ভূমিকা। অর্থনীতির এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতেও কীভাবে এই সাফল্য ধরা দিলো— জানতে প্রতিষ্ঠানটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মীর রাশেদ বিন আমানের মুখোমুখি হয় দৈনিক আমার সংবাদ। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাহিদুল ইসলাম
আমার সংবাদ : কবে আপনার প্রথম ৫০০ কোটি টাকার মাইলফলক অর্জন করেন এবং এই অর্জনে কার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি বলে মনে করেন?
মীর রাশেদ বিন আমান : আমরা গত ২৯ নভেম্বর প্রথমবারের মতো ৫০০ কোটি টাকা গ্রোস প্রিমিয়াম অর্জন করি। বর্তমানে গ্রোস প্রিমিয়াম ৫২৩ কোটি টাকা। এই অর্জনে অবদান প্রকৃতপক্ষে এফএ, ইউনিট, ব্রাঞ্চ, আমাদের এক্সিকিউটিভ ও মোস্ট ইমপর্টেন্টলি আমাদের অ্যাডমিন সাইডে সার্ভিসিং যারা মেনটেইন করে তারা। কারণ এফএ, ইউএম, বিএম তারা বাড়তি ব্যবসা করলে বাড়তি ইনকাম পাচ্ছে, ক্যারিয়ারের জন্য গাড়ি পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের এমপ্লয়িরা নীরবে কাজ করে যাচ্ছে। অন্য কোম্পানিতে এমপ্লয়িদের সাথে মার্কেটিংয়ের লোকজন কথা বলতে ভয় পায়, অ্যাডমিনরা তাদের পাওনা আটকে রাখে। কিন্তু আমাদের এখানে মার্কেটিংকে উল্টো সম্মান দেয়। আবার অফিস করতে গিয়ে সময়ের আগেই তারা চলে আসছেন, আবার কাজ পেন্ডিং থাকলে অফিস শেষ হওয়ার পরও করছেন। ধরুন, ডিসেম্বর মাস এখনো কাঙ্ক্ষিত রিনুয়্যাল আসেনি, তখন নিজেদের তাগিদ থেকেই বেশি কাজ করছেন। সোনালীর প্রতি তাদের যে আন্তরিকতা, এটি কখনো টাকা দিয়ে কেনা যায় না, জোর করেও সম্ভব নয়। তবে আমাদের বোর্ডও সবদিক থেকে সাপোর্ট দিয়েছে। আসলে আমাদের বোর্ডসহ সবদিক থেকে যদি সাপোর্ট না পেতাম তবে এত তাড়াতাড়ি এই অর্জন সম্ভব হতো না। তাদের যদি এখান থেকে টাকা সরানোর চিন্তা থাকত বা উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির জন্য সিস্টেম, স্বচ্ছতার নিয়ত ও আন্তরিকতা না থাকত তাহলে কেউ কাজই করতে পারত না। অর্থাৎ সার্বিকভাবে সবার সমন্বয়ে এই অর্জন, সেটি আমাদের একজন পিয়ন থেকে বোর্ড চেয়ারম্যান পর্যন্ত সবার।
আমার সংবাদ : বৈশ্বিক ও দেশের বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যেও আপনাদের এই অর্জনকে কিভাবে দেখছেন?
মীর রাশেদ বিন আমান : দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে যেকোনো সাধারণ মানুষ কিছুটা ভয়ে আছে। এই সময়ে ব্যাংক খাতে টাকা উত্তোলন, লাইফ ইন্স্যুরেন্সে পলিসি সমর্পণ বেড়েছে। অর্থাৎ মানুষের মাঝে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা উঠিয়ে নেয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে। গত তিন মাসে আমাদেরও অনেক সারেন্ডার হয়েছে। লাইফ ইন্স্যুরেন্সে কোনো কোম্পানির প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম তেমন নেই। পুরনো কোম্পানিগুলোর বেশির ভাগেরই লাইফ ফান্ড কমেছে। এর মধ্যে সোনালী লাইফে প্রথম বর্ষ ও নবায়ন অর্জনের পাশাপাশি এমপ্লয়ি ও গ্রাহকদের মাঝে যে সন্তুষ্টির জায়গা তৈরি করেছে, সেদিক থেকে মনে করি বর্তমান পরিস্থিতিতেও এটি আশার আলো হিসেবে গণ্য হতে পারে। পরিস্থিতি যাই হোক, এর মধ্যে কেউ যদি ভালো করে, তবে সেলফ মোটিভেট হয়ে আমরা এগোতে পারি। বর্তমান পরিস্থিতিতে যেখানে অনেক পুরাতন কোম্পানি প্রথম বর্ষ প্রিমিয়ামে ১০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করতেও হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমাদের প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম ছিল ২২৬ কোটি টাকা। ৩০ নভেম্বরে এটি ৩১৫ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। গত বছর ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম ছিল ১৫৬ কোটি টাকার কিছু বেশি। এখন পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে আমাদের গ্রোথ শতভাগ। বর্তমানে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ে পুরো লাইফ ইন্স্যুরেন্স খাতে সোনালী লাইফ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। মাত্র ৯ বছরে আমরা এই অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। আবার গত বছর এই সময়ে নবায়ন ছিল ১০০ কোটি, যা এ বছর ২০৪ কোটি টাকা। গ্রোস প্রিমিয়াম গত বছর এই সময় পর্যন্ত ছিল ২৬০ কোটি, এখন ৫২৩ কোটি টাকা। ২০২১ সালে আমাদের গ্রোস প্রিমিয়াম যেখানে ৩১৯ কোটির কিছু বেশি ছিল, এখন সেখানে শুধু প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম থেকেই এসেছে ৩১৫ কোটি টাকারও বেশি। বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি বিবেচনা করা হয়, আশা করছি সোনালী লাইফ আশার আলো হয়ে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করার সক্ষমতা রাখে।
আমার সংবাদ : আপনাদের প্রিমিয়াম সংগ্রহের পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর আপনার দ্বিগুণ হারে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করছেন ও তা অর্জন করছেন। এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে কবে নাগাদ আপনারা প্রিমিয়াম সংগ্রহে শীর্ষে অবস্থান করতে পারেন বলে মনে করেন?
মীর রাশেদ বিন আমান : আমাদের প্রথম থেকেই লক্ষ্য ছিল শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের প্রতি। এ জন্যই এত চ্যালেঞ্জ নেয়া বা শ্রম দেয়া। আল্লাহর ওপর ভরসা করে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি যেন ২০২৫ সালের মধ্যে জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে সোনালী লাইফ সবার উপরে থাকতে পারে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ২০২৫ সালের মধ্যে আমাদের টার্গেট হচ্ছে বার্ষিক গ্রোস প্রিমিয়াম তিন হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করা। দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠান যেন শীর্ষে থাকতে পারে, এই টার্গেট সেট করে এখন থেকেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
আমার সংবাদ : গ্রোস প্রিমিয়ামের মধ্যে রিন্যুয়াল কত ও বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে রিনুয়্যাল সংগ্রহে কোনো প্রভাব পড়েছে কি-না?
মীর রাশেদ বিন আমান : এখন পর্যন্ত সংগৃহীত ৫২৩ কোটি টাকা গ্রোস প্রিমিয়ামের মধ্যে গ্রুপ বিমা মাত্র তিন কোটি টাকার কিছু বেশি। গত বছর এটি ছিল প্রায় তিন কোটি টাকা। আমরা মনে করি, মার্কেট পেনিট্রেশন করতে হলে একক/ব্যক্তি পলিসি বাড়াতে হবে। এ ছাড়া এফডি বাদে লাইফ পলিসির পরিমাণ ৫১৩ কোটি টাকা। গত বছর আমাদের নবায়ন প্রিমিয়ামের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮৯ শতাংশ, যা চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৮৫ শতাংশ। এ বছর নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহের টার্গেট ২৫০ কোটি টাকার মধ্যে ২০৬ কোটি টাকা এসেছে। ইনশাআল্লাহ, এবারও এই প্রবৃদ্ধি ৮৮ থেকে ৮৯ শতাংশের মধ্যে বা উপরে থাকবে বলে আশা করছি। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ অবশ্যই প্রভাব ফেলেছে, এর আগে ছিল করোনা মহামারি। পুরো বিশ্বের সাপ্লাই চেইন বলা যায় ভেঙে পড়েছে। কিন্তু তারপরও আমরা আশা করছি বছর শেষে আমরা আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ঠিকই অর্জন করতে পারব। সমস্যায় যে পড়িনি, প্রভাব যে পড়েনি তা নয়, তবে আল্লাহর রহমতে আমরা এই সমস্যাকে অনেকটাই ওভারকাম করতে পেরেছি।
আমার সংবাদ : এখন পর্যন্ত দাবি পরিশোধ ও ব্যবস্থাপনা ব্যয় কেমন?
মীর রাশেদ বিন আমান : গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত আমরা মোট দাবি পরিশোধ করেছি ৫১ কোটি টাকার বেশি, যা গত বছরের প্রায় দ্বিগুণ। গত বছর ছিল ২৯ কোটির বেশি। মনে করছি, বছর শেষে এটি ৬০ থেকে ৬৫ কোটি টাকায় থাকবে, যা গ্রোস প্রিমিয়ামের ১০ শতাংশের মধ্যে। আবার ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের ক্ষেত্রেও আমরা অনেকটাই এগিয়ে আছি, আলহামদুলিল্লাহ। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমাদের ব্যবস্থাপনা ব্যয় নির্ধারিত সীমার চেয়ে ৮৪ কোটি টাকা কম হয়েছে। নভেম্বর ও ডিসেম্বরে প্রিমিয়াম সংগ্রহের বিপরীতে আশা করছি ব্যয় সীমার চেয়ে ১০৫ কোটি টাকা কমিয়ে আনতে পারব। আমরা চিন্তা করছি যদি এক টাকাও সেভ করা যায়, তাহলে গ্রাহকসহ কোম্পানির সাথে জড়িত সবারই লাভ হবে।
আমার সংবাদ : বিমা খাতকে প্রযুক্তিতে রূপান্তরসহ অনেক দিক থেকেই আপনারা অনুকরণীয় হয়েছেন। সে ক্ষেত্রে কোনো চাপ অনুভব করেন কি-না?
মীর রাশেদ বিন আমান : সোনালী লাইফের হাত ধরে যেহেতু বিমা খাতের অনেকগুলো নতুন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, পরিবর্তন হয়েছে সে ক্ষেত্রে একটি চাপ থাকে। স্রোতের বিপরীত দিকে হাঁটতে গেলে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু চাপটা আমরা স্বেচ্ছায় নিয়েছি। যখন একটি পরিবর্তন হয়, পুরনো কিছু বদলে নতুন করে। যেটি আগে কখনোই ছিল না। তবে আমাদের অভিভাবক মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস, তার সমর্থন পেয়েছি বলেই আমরা পরিববর্তনের সূচনাটা করতে পেরেছি। প্রাথমিক অবস্থায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকেও চাপ ছিল, কিন্তু পরে তারাও আমাদের সবদিক দিয়ে সমর্থন দিয়েছেন। তবে বিমা খাতে এখনো অনেক কিছু করার বাকি আছে।
আমার সংবাদ : বছর শেষে লাইফ ফান্ড কি পরিমাণ থাকবে বলে আশা করছেন?
মীর রাশেদ বিন আমান : গত বছর পর্যন্ত আমাদের লাইফ ফান্ড ছিল ২৯৭ কোটি টাকার কিছু বেশি। এই বছর ৩০ সেপ্টেম্বরের অনিরীক্ষিত হিসেবে লাইফ ফান্ড ৪৭১ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আর সর্বশেষ ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এই ফান্ডে ৫২৫ কোটি টাকা আছে। বছর শেষে আশা করছি এটি ৫৭৫ কোটি থেকে ৫৮০ কোটিতে দাঁড়াবে। যেহেতু আমাদের ব্যয় কম, তাই লাইফ ফান্ডের কন্ট্রিবিউশন আর অ্যাডিশনের হারটা বেশি।
এআই/ইএফ