Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৪,

বন্ধ আছে বিচার প্রক্রিয়া

শরিফ রুবেল

ডিসেম্বর ১৪, ২০২২, ০২:০৫ এএম


বন্ধ আছে বিচার প্রক্রিয়া

নৌ-দুর্ঘটনার মামলায় বিচারে গতি নেই। ধীর গতিতে চলছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল প্রক্রিয়াও। এতে বিচারপ্রার্থীদের অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হচ্ছে। বাড়ছে ভোগান্তিও। বিচার ছাড়াই পার হচ্ছে বছরে পর বছর। আবার বিচার প্রক্রিয়ায় গিয়েও মামলা ঝুলে যাচ্ছে। দেশে প্রতি বছরই ভয়াবহ নৌ-দুর্ঘটনা ঘটছে। তবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে এমন নজির নেই। এমন খবরও পাওয়া যায় না।

বিচারিক আদালত পেরিয়ে অধিকাংশ মামলাই উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশে আটকে আছে। শুধু স্থগিতাদেশ নয়, তদন্তে বিলম্ব, মামলায় সাক্ষী হাজির না হওয়া, রাষ্ট্রপক্ষের উদাসীনতাসহ নানা কারণে অনেক মামলার বিচার ঝুলে রয়েছে। পিনাক-৬, এমভি মিরাজ, এমভি বন্ধন, এমভি সারথীর মতো শত শত প্রাণহানির মামলার বিচারিক কার্যক্রম উচ্চ আদালতে স্থগিত রয়েছে।

এসব মামলার আসামি অধিকাংশই জামিনে রয়েছেন। কেউ কেউ আবার জামিন নিয়ে বিদেশেও পালিয়ে গেছেন। মামলা চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে এখন আদালতেও আসেন না বাদীরা। কেউ কেউ বিচারের আশাও ছেড়ে দিয়েছেন। এখনো প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক মদদপুষ্ট আসামিরা উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরছেন।

নৌ-আদালতে বেশির ভাগ মামলায় সাক্ষী উপস্থিত হয় না। এ ছাড়া রাষ্ট্রপক্ষের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণেও মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হচ্ছে। ২০০৩ সালের চাঁদপুরের মেঘনা ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় এমভি নাসরিন-১ ডুবে যায়। মারা যান ৪০২ জন যাত্রী। দেশের নৌ-দুর্ঘটনার ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা।

তবে নাসরিন ডুবির ১৯ বছর পার হলেও নিহতের স্বজনদের কান্না আজো থামেনি। বিচারের আশায় এখনো আদালতে ঘুরছে তাদের পরিবার। তবুও মেলেনি বিচার। মেলেনি ক্ষতিপূরণও। মামলাটি জজকোর্ট, হাইকোর্ট ও চেম্বার শেষে নিহতের পরিবারের শেষ আশা ঝুলে আছে আপিলে। শুধু এমভি নাসরিনের মামলাই নয়, গত ২০ বছরে অসংখ্য নৌ-দুর্ঘটনায় কয়েক হাজার মানুষ মারা গেলেও স্বজনরা আজো বিচার পাননি। বিচার না হওয়ায় দিন দিন বাড়ছে দুর্ঘটনা। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর সারি। আসামিরা প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে অধিকাংশ মামলারই বিচার প্রক্রিয়া এগোয়নি। দৃষ্টান্তমূলক সাজাও হয়নি। হতাহতের স্বজন পাননি কোনো ক্ষতিপূরণ।

এদিকে দুর্ঘটনা কমাতে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে সংশ্লিষ্ট আইনগুলো আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে নৌ-মন্ত্রণালয়ে ২০১৮ সালে প্রস্তাবিত সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। তবে চার বছরেও সুপারিশের কার্যকরী সমাধান আসেনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের একমাত্র নৌ-আদালতে বর্তমানে সাড়ে তিন হাজার মামলা বিচারাধীন। অধিকাংশ মামলায় পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে। অনেকদিন ধরেই বিচারক ছাড়া পড়ে আছে আদালতটি। বিচার কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে। বিচারক নিয়োগ দিতে একাধিকবার চিঠি দিয়েও কাজ হয়নি। ঢাকার সিএমএম আদালতের অধীন এই আদালতের বিচারক হন একজন যুগ্ম ও দায়রা জজ। তবে প্রায় এক মাস ধরে বিচারক না থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন নৌ-দুর্ঘটনায় শিকার হয়ে স্বজনহারা বিচারপ্রার্থীরা। এ আদালতে বর্তমানে ১৭০টি দুর্ঘটনাজনিত মামলা বিচারাধীন রয়েছে।

২০০৮ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে দায়ের করা ১৬টি মামলা বিচারাধীন। সাক্ষী না পাওয়ায় এসব মামলা নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। ১৬টি মামলার মধ্যে ১১টি দুর্ঘটনাজনিত, বাকি পাঁচটি অন্যান্য কারণে। মামলাগুলোর মধ্যে ছয়টির সাক্ষ্যগ্রহণ চলমান, দুটির যুক্তিতর্ক অব্যাহত রয়েছে, একটির কার্যক্রম হাইকোর্টে নির্দেশে স্থগিত, বাকি মামলাগুলোর বৈধতা নিয়ে হাইকোর্টে রিট করা হবে জানিয়ে বিচার কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লঞ্চ দুর্ঘটনায় প্রতি বছর শত শত মানুষের মৃত্যু বন্ধ করতে হলে প্রথমেই কঠোর শাস্তির বিধান করা উচিত। এ জন্য সর্বপ্রথম অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ-১৯৭৬ (ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স)-এর সংশোধন ও আধুনিকায়ন করতে হবে। লঞ্চ দুর্ঘটনার পর যে তদন্ত কমিটিগুলো হয়, সেগুলোর প্রতিবেদন প্রকাশ্যে আনতে হবে ও সরকারকে সুপারিশমালা যথাযথভাবে কার্যকর  করতে হবে। একটি গতিশীল ও কার্যকর নৌ-আইন, তদন্ত সংস্থা, প্রসিকিউশন ও আদালতই পারে নৌ-দুর্ঘটনায় কার্যকর শাস্তি নিশ্চিত করতে এবং এর মাধ্যমে নৌ-দুর্ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব বলে মত দেন তারা।

নৌ-আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) পারভীন সুলতানা বলেন, আসামিরা দু-এক বছর জেলে থাকার পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বের হয়ে আসেন।

তিনি বলেন, পিনাক-৬ মামলার আসামিরা উচ্চ আদালতে গিয়ে বিচার কার্যক্রম স্থগিত করে রেখেছেন। আমরা এ বিষয়ে জবাব দেয়ার পরও মামলার কার্যক্রম এখনো চালু হয়নি। শুধু পিনাকই নয়, নৌ-দুর্ঘটনার অনেক বড় বড় মামলা উচ্চ আদালতে এভাবে পেন্ডিং থাকছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নৌ-আদালতের প্রসিকিউটিং অফিসার বেল্লাল হোসাইন  বলেন, এসব মামলায় সাক্ষীদের অনেক সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। তা ছাড়া আইনগত নানা কারণে মামলা নিষ্পত্তি করতে দেরি হচ্ছে। সাক্ষী আদালতে হাজির না হলে বিচারকের কিছুই করার থাকে না।

তিনি বলেন, এই মুহূর্তে নৌ-আদালতে বিচারক নেই। পদোন্নতি হওয়ায় বিচারককে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। নতুন বিচারক যোগ দেয়ার পর পুরোনো মামলা নিষ্পত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া হবে। নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৫০ বছরে দুই হাজার ৫৭২টি নৌ-দুর্ঘটনায় ২০ হাজার পাঁচ শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। ৬৩৪টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৮৫৬টি মামলা হয়। নৌযানের ফিটনেস না থাকা ও চালকের অদক্ষতার কারণে সাধারণত দুর্ঘটনা ঘটে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নৌ-দুর্ঘটনার মামলায় চালক, সুকানি, খালাসিদের সাজা হয়েছে মাত্র দু-একটি ক্ষেত্রে। নৌ-অধিদপ্তরের প্রকৌশলীসহ কর্মকর্তারা নৌযানের ফিটনেস সনদপত্র ও ছাড়পত্র দেন। তবে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দায় এড়িয়ে যান। তাদের বিরুদ্ধে দুর্ঘটনার কারণে মামলা হয় না। সরকারি-বেসরকারি হিসাবে ২০২১ সালে নৌ-দুর্ঘটনা হয়েছে পাঁচ শতাধিক। ২০২০ সালে দেশে এক হাজার ২০৩টি নৌ-দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৯৫৩ জন। ২০১৯ সালে ৮২০টি দুর্ঘটনায় ৬৮৫ জন এবং ২০১৮ সালে ৫০৮টি দুর্ঘটনার ৪২৬ জন নিহত হন।

আপিল আদালতের প্রস্তাব : নৌ-আদালতের পাশাপাশি একটি আপিল আদালত স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে নৌ-অধিদপ্তর থেকে। সমপ্রতি এ সংক্রান্ত প্রস্তাব নৌ-মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আপিল আদালত হলে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা সহজ হবে। এতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। নৌ-আদালতে আসামিপক্ষের হয়ে সবচেয়ে বেশি মামলা পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি রাষ্ট্রপক্ষের দুর্বলতা ও সাক্ষী হাজির না হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

তিনি বলেন, বড় দুর্ঘটনার মামলাগুলো উচ্চ আদালতে স্থগিত হয়ে আছে। এর মধ্যে পিনাক-৬, এমভি মিরাজ, এমভি বন্ধন, এমভি সারথীর মামলা উল্লেখযোগ্য। মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তিতে রাষ্ট্রপক্ষের কার্যকর তেমন কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যায় না। সময়মতো সাক্ষীও হাজির হন না। এছাড়া আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় সামান্য কারণেই উচ্চ আদালতে চলে যান। উচ্চ আদালতে গিয়ে তারা বছরের পর বছর মামলা স্থগিত করে রাখেন। রাষ্ট্রপক্ষের উচিত বিষয়গুলোর দিকে নজর দেয়া।

ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, লঞ্চডুবির ঘটনা স্পষ্টত ফৌজদারি অপরাধ। দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। প্রচলিত যে আইনটি আছে সেটি অনেক দুর্বল। এটিকে আরও যুগোপযোগী ও শক্তিশালী করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

 

Link copied!